ভারতীয় কর্মীদের ভিসা বাতিল শীর্ষক তথ্যটি মিথ্যা

সম্প্রতি, “পণ্য বয়কটের পর এবার ভারতীয় কর্মীদের ভিসা বাতিল।” শীর্ষক শিরোনামে একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। 

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

এছাড়া, মূলধারার সংবাদমাধ্যম ইত্তেফাকে বিষয়টি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি দেখুন এখানে।  

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, হযরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির দুই নেতার অবমাননাকর মন্তব্যের জেরে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ভারতীয় পন্য বয়কট করার বিষয়টি সত্য হলেও উক্ত ঘটনার জেরে ভারতীয় কর্মীদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে শীর্ষক দাবিটি সত্য নয়।

গুজবের সূত্রপাত

আলি আল জামাল নামের ইয়েমেনের এক ব্যক্তির টুইট ঘিরে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। কিওয়ার্ড সার্চ করার মাধ্যমে @Alialjamal1978 ইউজারের সেই টুইটার অ্যাকাউন্টের টুইটটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

আরবি ভাষায় করা সেই টুইটটি গুগলের সাহায্যে অনুবাদ করলে পাওয়া যায়,

I had the residence permit of all non-Muslim Indian workers and handed them all their dues with return tickets irrevocably and I will stop all dealings and purchase of goods made in India and this is the weakest of faith.

অর্থাৎ Ali Al Jamal নামের ইয়েমেনের এই ব্যক্তি (যদিও তার টুইটারে লোকেশন কানাডা দেওয়া) তার টুইটে লিখেছেন, তার কাছে সমস্ত অমুসলিম ভারতীয় শ্রমিকদের বসবাসের অনুমতি ছিল এবং তিনি তাদের সমস্ত বকেয়া রিটার্ন টিকিটের সাথে হস্তান্তর করেছেন। পাশাপশি তিনি ভারতের সাথে লেনদেন এবং ভারতে তৈরি পণ্য ক্রয় বন্ধ করে দেবেন বলেও লিখেছেন।

আলি আল জামালের এই টুইটকে সূত্র ধরেই মূলত ভারতীয় কর্মীদের ভিসা বাতিল দাবিটি ছড়িয়ে পড়ে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, আলি আল জামাল নামের সেই ব্যক্তি ইয়েমেনে থাকা ভারতীয়দের রেসিডেন্স পারমিট বাতিল করতে পারে এমন কোনো দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তি নন।

অনুসন্ধানে Ali Al Jamal এর ফেসবুক আইডি খুঁজে পাওয়া যায়, তার ফেসবুক আইডিতে তার করা টুইটটি নিয়ে একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। 

টুইটটির স্ক্রিনশট যুক্ত করে তিনি সেই ফেসবুক পোস্টে আরবি ভাষায় লিখেছেন-

توضيح هااااااام.. بخصوص هذة التغريده“👇

الى جميع الاصدقاء والاحباب 

اولا هذة التغريدة كان الهدف منها فقط للتحفيز وتشجيع من لهم القدرة على هذا العمل مقاطعة المنتجات الهندية وطرد العمالة الهندوسية

ثانيا #لمكايدة_السافل_مودي_ولإغاضته ولكي يعلموا بأن كلامه البذيء مردود عليه فقط والمشاركه في الهاشتاق #الا_رسول_الله_يامودي هو #لنصرة_نبينا_محمد_عليه_الصلاة_والسلام 

انا ليس تاجر ولا رجل اعمال كما يتصور البعض انا انسان بسيط جدا وفقير واعمل موظف والحمدالله”

যা গুগলের সহায়তায় অনুবাদ করলে পাওয়া যায় –

Haaaaaam clarification.. about this tweet 👇 To all friends and loved ones First, this tweet was intended only to motivate and encourage those who have the ability to do this work, to boycott Indian products and expel Hindu workers. Secondly, to deceive Modi and to anger him, so that they know that his obscene words are only acceptable to him, and to participate in the hashtag #Except_Messenger_of_God_Yamudi is to support our Prophet Muhammad, peace and blessings be upon him. I am neither a merchant nor a businessman, as some imagine, I am a very simple and poor person and I work as an employee, thank God.

অর্থাৎ আলি আল জামালের করা টুইটটি ঘিরে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হলে তিনি তার ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, তিনি বণিক বা ব্যবসায়ী নন, যা কেউ কেউ মনে করছে। তিনি খুব সাধারণ, গরীব ব্যক্তি এবং তিনি একজন কর্মচারী হিসাবে কাজ করছেন। 

ফেসবুক পোস্টটিতে তার করা টুইটটির উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি লিখেছেন, তার টুইটটির উদ্দেশ্য ছিল প্রথমত শুধুমাত্র তাদের অনুপ্রাণিত করা এবং উৎসাহিত করা যাদের এই কাজ (ভারতীয় পণ্য বয়কট এবং হিন্দু শ্রমিকদের বহিষ্কার করা।) করার ক্ষমতা আছে। দ্বিতীয়ত, মোদিকে ধোঁকা দেওয়া এবং তাকে রাগান্বিত করা, যাতে তারা জানে যে তার অশ্লীল কথা কেবল তার কাছেই গ্রহণযোগ্য এবং হ্যাশট্যাগ প্রতিবাদে অংশ নেয়া। 

অর্থাৎ, যে টুইটটি ঘিরে ভারতীয় কর্মীদের ভিসা বাতিল দাবিটি করা হচ্ছে সেই টুইটকারী নিজে নিশ্চিত করে জানিয়েছেন যে তার এমন কিছু করার ক্ষমতা নেই বরং যাদের ক্ষমতা আছে তিনি তাদের অনুপ্রানিত করতে বিষয়টি টুইট করেছিলেন।

উল্লেখ্য, রিউমর স্ক্যানার টিম ব্যক্তিটির টুইটার আইডিতে দেয়া ইউজার ‘alialjamal1978’ এর সূত্র ধরে তার ফেসবুক এবং ইন্সটাগ্রাম আইডি খুঁজে পায় যেখানে ‘1978’ লেখাটির উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়াও তার ফেসবুক আইডিতে সংযুক্ত জিমেইল আইডি এবং জন্মসাল এর ক্ষেত্রেও একই মিল লক্ষ্য করে উক্ত ফেসবুক আইডিটি একই ব্যক্তির তা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়।

ভারতীয় কর্মীদের ভিসা বাতিল সংবাদের সাথে ইয়েমেনের মারিব শহরের গভর্নরের ছবি প্রচার 

ভারতীয় কর্মীদের ভিসা বাতিল দাবিটি প্রচারের সাথে ইয়েমেনের মারিব শহরের গভর্নরের ছবি প্রচার করা হচ্ছে। বেশকিছু অনলাইন পোর্টাল এবং ফেসবুকে দাবিটির সাথে ইয়েমেনের মারিব শহরের গভর্নর সুলতান আল আরাদাহ এর ছবি সংযুক্ত করে প্রচার করেছে। 

ভিসা

ছবির ব্যাক্তিটি সুলতান আল আরাদাহ তার প্রমাণ-

মূলত আলিআল জামাল তার টুইটার অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল ফটোতে সুলতান আল আরাদাহ এর ছবি ব্যবহার করছেন। যার ফলে সুলতান আল আরাদাহ এর ছবিকে আলিআল জামাল হিসেবে ধরে উক্ত দাবির সাথে প্রচার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ছবিটি সুলতান আর আরাদাহর এবং আলিআল জামাল এর সোস্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তিনি সুলতান আল আরাদাহ এর ছবি তার প্রোফাইল ফটোতে অথবা কভার ফটোতে ব্যবহার করে থাকেন। তবে টুইটার হেডার এবং ফেসবুক প্রোফাইল পিকচারে আলিআল জামাল তার নিজের ছবি রেখেছেন। 

মূলত, আলি আল জামাল ইয়েমেনের একজন সাধারণ নাগরিক। তিনি তার টুইটারে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মাসহ দুই নেতার অবমাননাকর মন্তব্যের জেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ভারতীয় নাগরিকদের রেসিডেন্স পারমিট বাতিল করতে পারে এমন ক্ষমতাবানদের অনুপ্রাণিত এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে রাগানোর উদ্দ্যেশে একটি টুইট করেছিলেন, যা পরবর্তীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। আদতে তিনি একজন সাধারণ নাগরিক এবং এমন কিছু করার ক্ষমতা তার নেই যা তিনি পরবর্তীতে এক ফেসবুক পোস্টে নিশ্চিত করেছেন।

Also Read: ভারতের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলের ভিডিওটি পুরাতন

এছাড়াও কোন সংবাদমাধ্যমে সাম্প্রতিক ঘটনার জেরে ভারতীয় কর্মীদের ভিসা বাতিল শীর্ষক কোন সংবাদ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নি।

উল্লেখ্য, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মাসহ দুই নেতার অবমাননাকর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আরব বিশ্ব। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভারতীয় পণ্য বর্জনের দাবি উঠেছে। উক্ত ঘটনার ফলে অবমাননাকর মন্তব্যকারী বিজেপির মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং দিল্লি শাখার গণমাধ্যম প্রধান নবীন কুমার জিন্দালকে বহিষ্কার করেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। 

সুতরাং, ভারতীয় কর্মীদের ভিসা বাতিল করা হয়েছে শীর্ষক দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img