সম্প্রতি, “মরক্কোতে বোরকা, হিজাব ও নিকাব ব্যবহার নিষিদ্ধ” এমন একটি দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে,এখানে ও এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মরক্কোতে জনসাধারণের হিজাব, নিকাব ও বোরকার ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই বরং সেখানে কেবল আফগানি বোরকার আমদানি, তৈরি ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
মরক্কোতে কি বোরকা নিষিদ্ধ?
মরক্কোতে বোরকা নিষিদ্ধ শীর্ষক বিষয়টি যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে সেটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, অনুসন্ধানে দেখা যায় মরক্কোতে বোরকার উৎপাদন ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বোরকা ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা নেই।
কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাতে ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি “Reports: Morocco bans sale of full-face veil” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়।
সংবাদ বিবরণীতে বলা হয়, ‘মরক্কো নিরাপত্তাজনিত কারণে নিকাব প্রস্তুতকরণ, বাজারজাতকরণ ও বিক্রয়করণ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে।’
তবে সংবাদের কোথাও বোরকা ব্যবহার করতে পারবে না এমন কিছুর উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ডয়েচ ভেলেতে ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর “Morocco stops sale, production of full-face veil” শীর্ষক শিরোনামে আরেকটি সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত সংবাদে উল্লেখ করা হয়, স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, মরক্কোর কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার কারণে বোরকা তৈরি এবং বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। যদিও এই পদক্ষেপের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনও আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি, নতুন ব্যবস্থাগুলি আগামী সপ্তাহে কার্যকর হতে চলেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের বরাত দিয়ে নিউজ ওয়েবসাইট “Le360” লিখেছে, “আমরা রাজ্যের সব শহর ও শহরে এই পোশাকের আমদানি, উৎপাদন এবং বিপণন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ নিয়েছি।”
এছাড়াও, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি এবং নিউইয়র্ক টাইমস এ সেসময় প্রকাশিত প্রতিবেদনেও একই তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনগুলোতে কেবল মরক্কোতে বোরকার উৎপাদন এবং বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে সেখানে বোরকা ব্যবহার করতে পারবে না এমন কিছু উল্লেখ নেই।
পরবর্তীতে অনুসন্ধানে U.S. Department of State কর্তৃক ২০২২ সালের ২১ জুন আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা রিপোর্ট-২০২১ ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর ওয়েবসাইটে ‘2021 Report on International Religious Freedom: Morocco’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মরক্কোর ধর্মীয় স্বাধীনতার রিপোর্ট খুঁজে পাওয়া যায়।
সেখানে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৭ সালে মরক্কোতে বোরকা আমদানি, উৎপাদন এবং বিক্রয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর ছিল। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিষেধাজ্ঞার ন্যায্যতা হিসাবে নিরাপত্তা উদ্বেগ উল্লেখ করেছে। তবে এই নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তিদের বোরকা পরা বা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বাড়িতে তৈরি করতে বাধা দেয়নি।’
অর্থাৎ, ২০২২ সালে প্রাকশিত ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর প্রতিবেদনে ২০১৭ এর বোরকা প্রোডাকশন ও বিক্রয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বলা হয় এই নিষেধাজ্ঞা ব্যক্তিদের বোরকা পরিধানে বা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য বাড়িতে তৈরি করতে বাঁধা দেয়নি।
সুতরাং, মরক্কোতে বোরকা ব্যবহার বা পরিধানে নিষেধাজ্ঞা নেই। তাই মরক্কোতে বোরকা নিষিদ্ধ বিষয়টির এভাবে প্রচার বিভ্রান্তিকর।
উল্লেখ্য, জনসাধারণের জন্য বোরকা পরিধান নিষিদ্ধ না হলেও উক্ত রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয়, কর্তৃপক্ষ জাতীয় টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপক এবং ইউনিফর্ম পরা পুলিশ ও সেনা সদস্যদের হিজাব বা বোরকা পরতে নিষেধ করেছে।
মরক্কোতে কি নিকাব নিষিদ্ধ?
মরক্কোতে নিকাব নিষিদ্ধ শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয়। অনুসন্ধানে দেখা যায় মরক্কোতে নিকাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা নেই।
অনুসন্ধানে AFP তে ২০২২ সালের ১৬ নভেম্বর “Morocco does not ban the niqab, but rather the manufacture and sale of the Afghani burqa” শীর্ষক শিরোনামে আরবি ভাষায় প্রকাশিত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে নিকাব নিষিদ্ধ হওয়ার দাবিটিকে মিথ্যা চিহ্নিত করে উল্লেখ করা হয়,
“২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আফগানী বোরকা সেলাই ও বাজারজাত করার জন্য মরক্কোর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিলো। সেই সময়ে মরক্কোর গণমাধ্যমেে প্রচারিত সংবাদগুলোতে নিকাব নিষিদ্ধ শীর্ষক কোন কথা উল্লেখ করা হয়নি। আওকাফ ও ইসলামি বিষয়ক মন্ত্রী আহমেদ আল-তৌফিক এএফপিকে জানিয়েছেন, “মরক্কোতে নিকাব পরা নিষিদ্ধ করার কোন সিদ্ধান্ত নেই”।
অর্থাৎ মরক্কোতে নিকাব নিষিদ্ধ নয়।
তবে ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর কিছু সংবাদে মরক্কোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাতিষ্ঠানিক ড্রেস কোডের বাইরে নিকাব পরিধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত সংবাদ পাওয়া যায়। তেমনি Morocco World News পোর্টালটির একটি সংবাদে দৈনিক আল আহদাথ আল মাগরিবিয়ার বরাতে বলা হয়েছে, স্কুলে পুরো মুখের পর্দার উপর নতুন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে নীতি ও নির্দেশকদের অবহিত করে মরক্কোর সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি মন্ত্রীর নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।
তবে, স্কুলের প্রাতিষ্ঠানিক ড্রেস কোড মানাতে স্কুলে নিকাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার ওপর ২০১৭ সালের সংবাদ পাওয়া গেলেও সর্বসাধারণের জন্য নিকাব নিষিদ্ধের কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। উপরন্তু AFP এর সাম্প্রতিক সময়ের ২০২২ এর নভেম্বরের ফ্যাক্টচেক অনুযায়ী এবং সেই ফ্যাক্টচেকে একজন মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী মরক্কোতে নিকাব নিষিদ্ধ নয়।
আবার কেউ কেউ মরক্কোতে হিজাব নিষিদ্ধ শীর্ষক দাবি প্রচার করলেও তার পক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। মরক্কোতে হিজাব নিষিদ্ধ নয়। মরক্কোতে হিজাব পরা এবং না পরার ওপর কোন বাধ্যবাধকতা এবং নিষেধাজ্ঞা পাওয়া যায়নি।
মূলত, ২০১৭ সালে মরক্কো সরকার নিরাপত্তাজনিত কারণে মরক্কোতে নিকাব তৈরী ও বিক্রির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত মরক্কোতে প্রতি বছর প্রায় ১০ মিলিয়ন পর্যটক ভ্রমণ করে। নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় দেশটিতে ২০১৭ সালে বোরকার উৎপাদন এবং বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। বোরকার উৎপাদন এবং বিক্রির ওপর এই নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিই সম্প্রতি বিশ্বকাপে মরক্কোর ধারাবাহিক জয়ের প্রেক্ষিতে মরক্কোতে হিজাব-নিকাব-বোরকা ব্যবহার নিষিদ্ধের দাবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
নিচের ছবিতে বোরকা, নিকাব ও হিজাবের পার্থক্য দেখে নেয়া যাক-
সুতরাং, মরক্কোতে হিজাব-নিকাব-বোরকা নিষিদ্ধ শীর্ষক দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত তথ্যগুলো বিভ্রান্তিকর।