“আফ্রিকার দেশগুলোর বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন” শীর্ষক কোনো মন্তব্য বারাক ওবামা করেননি

সম্প্রতি, গত ১৪ মে শনিবার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস সম্মেলন কক্ষে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দশ উদ্যোগে নারীর ক্ষমতায়ন’ বিষয়ক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে বক্তব্য প্রদান করেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি উল্লেখ করে বলেন, “আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তো তার বাবার দেশ কেনিয়াতে গিয়ে বলেছিলেন, আফ্রিকার দেশগুলোর বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।”

পরবর্তীতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের এই বক্তব্যটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানেএখানে।

Screenshot from Kalerkantho
Screenshot from Daily Inqilab

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কেনিয়ায় গিয়ে কখনও আফ্রিকার দেশগুলোকে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেন নি বরং বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কেনিয়ায় একমাত্র রাষ্ট্রীয় সফরের এক বক্তব্যে বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ের নির্বাচন ব্যবস্থায় কেনিয়ার আবিষ্কৃত উশাহিদি নামের প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

মূলত, কেনিয়া বারাক ওবামার জন্মভূমি হলেও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি কেবলমাত্র একবারই কেনিয়া সফরে গিয়েছিলেন। এটিই ছিলো কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রথম কেনিয়া সফর। বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবার ২০১৫ সালের ২৪ জুলাই কেনিয়ার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় সফরে যান।

Screenshot from BBC News website

সেই সফরে ২৫ জুলাই নাইরোবিতে কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়ার সঙ্গে বৈশ্বিক উদ্যোক্তা বিষয়ক এক যৌথ সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন বারাক ওবামা। সেই বক্তব্যের ৮ মিনিট ১০ সেকেন্ড সময়কালে কেনিয়ার প্রযুক্তিতে পারদর্শী তরুণ উদ্যোক্তাদের কথা বলতে গিয়ে ওবামা বলেছিলেন,

“বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন, লক্ষ লক্ষ মানুষ এম-পেসা [কেনিয়ার মোবাইল মানি ট্রান্সফার সার্ভিস] দিয়ে অর্থ পাঠায় এবং সঞ্চয় করে… জিম্বাবুয়ে থেকে বাংলাদেশে, নাগরিকরা ক্রাউড-সোর্সিং প্ল্যাটফর্ম উশাহিদি ব্যবহার করে নির্বাচন নিরাপদ রাখতে কাজ করে – এবং এটি একটি দুর্দান্ত ধারণা যা এখানে কেনিয়া থেকে শুরু হয়েছিল।”

উশাহিদি হলো একটি ওপেন সোর্স সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন যা ব্যবহারকারীর তৈরি করা প্রতিবেদনগুলোকে সংযুক্ত এবং ডেটা ম্যাপ করতে ব্যবহার করা হয়। কেনিয়ার তরুণদের তৈরি করা এই প্রযুক্তি জিম্বাবুয়ে এবং বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে এই কথা উল্লেখ করতে গিয়েই মূলত তিনি সেই বক্তব্যে বাংলাদেশের উদাহরণ উল্লেখ করেন এবং এরপর তিনি আরো বলেন “এটি একটি দুর্দান্ত ধারণা যা কেনিয়া থেকে শুরু হয়েছিলো“। ওবামার সেদিনের ঐ বক্তব্যের হোয়াইট হাউসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে লিখিত প্রতিলিপি দেখুন এখানে

Screenshot from WhiteHouse archive website

উশাহিদি’র অফিসিয়াল ওয়েবসাইটেও সেই বক্তব্যটি খুঁজে পাওয়া যায়।

গুজবের সূত্রপাত

এই তথ্যের সূত্র খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৫ সালের ২৬ জুলাইতে “US President Barack Obama Praises Bangladesh” শীর্ষক শিরোনামে সময় টিভির কর্তৃক প্রকাশিত ভিডিও প্রতিবেদন এবং ICT Division এর ইউটিউব চ্যানেলে চ্যানেল টোয়েন্টি ফোরের একটি ভিডিও প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া। মূলত, সে সময়ে বারাক ওবামার উক্ত বক্তব্যকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রায় সকল মূলধারার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো।

তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেসকল প্রতিবেদনগুলোতে বারাক ওবামার ঐ বক্তব্যকে বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে সে সময় বিস্তারিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলো রিউমর স্ক্যানার।

বারাক ওবামার বক্তব্য বিকৃত করে সেসময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার ফলে বিভিন্ন সময়ে একাধিক মন্ত্রী কর্তৃক উক্ত বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বক্তব্য প্রদান করতে দেখা গেছে।

যেমন, গত ২৫ জানুয়ারি ২০২২ এ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বিসিসি অডিটোরিয়ামে ‘সুবর্ণজয়ন্তী ওয়েবসাইট’ ও ‘সুবর্ণজয়ন্তী অনলাইন কুইজ’ প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্বের রোল মডেল।বাংলাদেশের উন্নতির জন্য বারাক ওবামা তার দাদার দেশ কেনিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানকে বলেছেন- ফলো শেখ হাসিনা, ফলো বাংলাদেশ।” তার এই বক্তব্য নিয়ে সেসময় রিউমর স্ক্যানারের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন দেখুন এখানে

মূলত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কেনিয়া সফরের সেই বক্তব্যে জিম্বাবুয়ে এবং বাংলাদেশের নির্বাচনে কেনিয়ার তৈরি সফটওয়্যার ব্যবহৃত হচ্ছে বলে কেনিয়ার তরুণদের প্রশংসা করতে গিয়েই বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তার সেই বক্তব্য গণমাধ্যমে সেসময় বিকৃতভাবে প্রচারের ফলেই বিভিন্ন সময়ে এটি প্রচারিত হয়ে আসছে।

এছাড়া নির্ভরযোগ্য কোনো দেশীয় বা আন্তজার্তিক গণমাধ্যমে বারাক ওবামা কেনিয়ায় গিয়ে আফ্রিকার দেশগুলোকে বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন বলে করা কোন মন্তব্যের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি।

অর্থাৎ, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এর সাম্প্রতিক সময়ে দেয়া “আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তো তার বাবার দেশ কেনিয়াতে গিয়ে বলেছিলেন, আফ্রিকার দেশগুলোর বাংলাদেশের কাছ থেকে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন।” শীর্ষক বক্তব্যটি ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img