কাবা শরীফের কোনো ইমাম রমজানের শেষ দশ দিনের বিশেষ আমল নিয়ে এই পরামর্শগুলো দেননি

মুসলমানদের কাছে সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত কাবা শরীফ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহর ঘর বলে পরিচিত এই কাবা শরীফের ইমামের ফর্মুলা বা পরামর্শ দাবিতে কিছু তথ্য গেল বেশ কয়েক বছর ধরে ইন্টারনেটে বিদ্যমান। 

দাবি করা হচ্ছে, কাবা শরিফের বর্তমান ইমাম শায়খ আবদুর রহমান আল সুদাইস রমজানের শেষ দশকের প্রতিদিন তিনটি বিশেষ আমল করার কথা বলেছেন।

১. প্রতিদিন এক দিরহাম (এক টাকা) দান করুন, যদি দিনটি লাইলাতুল ক্বদরের মাঝে পড়ে, তবে আপনি ৮৪ বছর বা ১০০০ মাস পর্যন্ত প্রতিদিন এক টাকা দান করার সাওয়াব পাবেন।

২. প্রতিদিন দুই রাকা’আত নফল সালাত আদায় করুন, যদি দিনটি লাইলাতুল ক্বদরের মাঝে পড়ে, তবে আপনি ৮৪ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন দুই রাকা’আত নফল সালাত আদায় করার সাওয়াব পাবেন।

৩. প্রতিদিন তিনবার সূরা ইখলাস পাঠ করুন, যদি দিনটি লাইলাতুল ক্বদরের মাঝে পড়ে, তবে আপনি ৮৪ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন এক খতম ক্বুর’আন পাঠের সাওয়াব পাবেন।

এ সংক্রান্ত পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, 

তিনি আরো বলেন, এ কথাগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিন, যারা আপনার এ কথা শুনে আমল করবে, আপনিও তাদের আমলের সমপরিমাণ সাওয়াব পাবেন ইনশাআল্লাহ্। কারণ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ভালো কাজের পথপ্রদর্শনকারী আমলকারীর সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে, কিন্তু আমলকারীর সাওয়াবে কোনো ঘাটতি হবে না।” (মুসলিম, ২৬৭৪)

রিউমর স্ক্যানার টিমের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২০২৩ সাল থেকে বর্তমান ইমাম শায়খ আবদুর রহমান আল সুদাইসের নামে এই মন্তব্যগুলো প্রচার হলেও এর পূর্বে কাবার আরেক ইমাম শায়খ মাহের আল-মুয়ায়ক্বিলির নামেও একই দাবি প্রচার হয়েছে। 

কাবা শরীফের

উক্ত দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন ডেইলি বাংলাদেশ

একই দাবিতে বিগত সময়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন জাগোনিউজ২৪ (২০২০), আওয়ার ইসলাম (২০১৯)।

চলতি বছর (২০২৪ সালে) উক্ত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলো দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে বিগত বছরগুলোর ফেসবুক পোস্ট দেখুন ২০২৩, ২০২২, ২০২১, ২০২০, ২০১৯, ২০১৮, ২০১৭, ২০১৬। 

একই দাবিতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ইউটিউবের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

একই দাবিতে টিকটকের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কাবা শরীফের ইমাম শায়খ আবদুর রহমান আল সুদাইস বা শায়খ মাহের আল-মুয়ায়ক্বিলি রমজানের শেষ দশকের প্রতিদিন তিনটি বিশেষ আমল করার কথা বলেছেন শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং কাবার কোনো ইমামই এ সংক্রান্ত কোনো পরামর্শ দেননি। নির্ভরযোগ্য সূত্র এবং হারামাইন শরীফের অফিশিয়াল সূত্রের বরাতে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে রিউমর স্ক্যানার।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে এ সংক্রান্ত দাবিটির সূত্রপাত খোঁজার চেষ্টায় ইসলামি বক্তা আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহর ফেসবুক পেজে একই দাবির পোস্টের সন্ধান পাওয়া যায়। ২০২১ সালের ০২ মে প্রকাশিত এই পোস্টে জনাব সাইফুল্লাহ দাবি করেন, এটি মাসজিুল হারামের ইমাম শায়েখ মাহির মুকাইকিলির খুতবা হিসেবে দেওয়া বক্তব্য। এই পোস্টের সূত্র হিসেবে তিনি এর অনুবাদক হিসেবে আলী হাসান তৈয়ব নামে এক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেন। 

Screenshot: Facebook 

আমরা জনাব আলী হাসান তৈয়বের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। 

তিনি আমাদের বলছিলেন, “এটা শায়খ মাহেরের একটি আরবী পত্রিকায় পেয়েছিলাম। কিন্তু এটা তিনি কোন খুতবায় বা কোথায় তিনি বলেছেন তা নিশ্চিত হতে পারিনি।”

তার পরামর্শ, ওই কথাগুলো উনি বলুন আর না বলুন, কথাগুলো হাদিস বা সুন্নাত মনে না করে শুধু একটি আমলের কৌশল হিসেবে নিলে কোনো সমস্যা হবে না। 

ফেসবুক এডভান্স সার্চ পদ্ধতির অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২৭ মে নাজিম উদ্দীন নামে এক ব্যক্তির পোস্টে আলোচিত দাবিটিকে মিথ্যা বলে অভিহিত করা হয়েছে। এটিই বাংলা ভাষায় আমাদের অনুসন্ধানে এ সংক্রান্ত সম্ভাব্য প্রথম পোস্ট হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। তবে পোস্টের এডিট হিস্টোরি যাচাইয়ে দেখা যায়, মিথ্যা সাব্যস্ত করা অংশ এবং ইমামের ফর্মুলাগুলো ২০১৯ সালের জুলাইয়ে পোস্টে যুক্ত করা হয়। তার পূর্বে একটি ছবি যুক্ত ছিল পোস্টে, যা সেসময় সরিয়ে নেওয়া হয়৷ ছবিতে কী ছিল তা জানা সম্ভব হয়নি।

Screenshot collage: Rumor Scanner

জনাব নিজামের পোস্টের দিন তিনেক পর সে বছরের ৩০ মে চট্টগ্রামের লোহাগড়া কলাউজান শাহ রশিদিয়া ফাজিল মাদ্রাসার বর্তমান অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল মুহছেন আলোচিত দাবিতে পোস্ট করেন যা বর্তমানে সচল থাকা এ সংক্রান্ত পোস্টগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে আমাদের কাছে। পরের বছর ইংরেজি ভাষাতেও একই দাবিতে পোস্ট নজরে আসে আমাদের।

Screenshot collage: Rumor Scanner 

অর্থাৎ, অন্তত ২০১৬ সাল থেকে কাবা শরীফের দুই ইমামের নামে একই মন্তব্য বা ফর্মুলা প্রচার হয়ে আসছে। 

এ বিষয়ে ফেসবুকেই প্রাসঙ্গিক নানা কিওয়ার্ড সার্চের পর ২০১৬ সালের ২০ জুন সংযুক্ত আরব আমিরাত ভিত্তিক পেজ ‘ইনকারেক্ট আহাদিত ডিফিউজড’ এর একটি পোস্ট নজরে আসে আমাদের।

পোস্টে বলা হয়, কাবার ইমামের নাম ব্যবহার করে প্রচারিত তথ্যগুলোর কোনো সত্যতা নেই। একই ধরণের পরামর্শ এর আগে মিশরের ইসলামিক ব্যক্তিত্ব আমর খালেদের নামেও প্রচারের কথা উল্লেখ করা হয় পোস্টে। 

Screenshot: Facebook 

২০১৬ সাল বা তার পরবর্তী সময়ে কাবার কোনো ইমাম এ সংক্রান্ত বক্তব্য দেওয়ার তথ্য সৌদি আরবের গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে না পেয়ে আমরা যোগাযোগ করেছিলাম সৌদি আরবের ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান ‘No Rumors’ এর প্রতিষ্ঠাতা রায়ান আদিলের সাথে। তিনি বলছিলেন, কাবার কোনো ইমামই এমনটা বলেননি। এটা একটা প্রতারণার শামিল। 

রায়ান বলছিলেন, আপনি যদি খেয়াল করে থাকেন দেখবেন পোস্টগুলোতে ইমামের বক্তব্যে দিরহামের বিষয় এসেছে। কিন্তু সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সৌদি রিয়াল সৌদি আরবের সরকারী মুদ্রা, দিরহাম নয়। 

এদিকে আমাদের অনুসন্ধান চলাকালীন হারামাইন শরীফ ভিত্তিক ভেরিফাইড পেজ ‘ইনসাইড দ্যা হারামাইন’ থেকেও জানানো হয়, ভাইরাল বিষয়টি সঠিক নয়৷ 

Screenshot: Facebook 

মূলত, রমজানের শেষ দশদিনের জন্য কাবা শরীফের ইমামের ফর্মুলা বা পরামর্শ দাবিতে কিছু তথ্য গেল বেশ কয়েক বছর ধরে ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। দাবি করা হচ্ছে, কাবা শরীফের বর্তমান ইমাম শায়খ আবদুর রহমান আল সুদাইস রমজানের শেষ দশ দিনের প্রতিদিন তিনটি বিশেষ আমল করার কথা বলেছেন। ২০২৩ সাল থেকে বর্তমান ইমাম শায়খ আবদুর রহমান আল সুদাইসের নামে এই মন্তব্যগুলো প্রচার হলেও এর পূর্বে কাবার আরেক ইমাম শায়খ মাহের আল-মুয়ায়ক্বিলির নামেও একই দাবি প্রচার হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাবার কোনো ইমামই এ সংক্রান্ত কোনো পরামর্শ দেননি। নির্ভরযোগ্য সূত্র এবং হারামাইন শরীফের অফিশিয়াল সূত্রের বরাতে বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, রমজানের শেষ দশ দিনের প্রতিদিন তিনটি বিশেষ আমল বিষয়ে কাবা শরীফের ইমামের মন্তব্য দাবিতে প্রচারিত তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

  • IncotrectAhadithDiffused: Facebook Post 
  • Statement from Ryan Adil, No Rumors 
  • Inside the Haramain: Facebook Post
  • Rumor Scanner’s own investigation 

আরও পড়ুন

spot_img