২০৫০ সালের মধ্যে হিন্দু ধর্ম বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্ম হবে শীর্ষক দাবি আমেরিকান গবেষকরা করেননি

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে, “ব্রেকিং নিউজ আমেরিকার গবেষকরা বলেছে। 2050 সালের মধ্যে হিন্দু ধর্ম হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্ম”।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০৫০ সালে হিন্দু ধর্ম বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্ম হবে শীর্ষক দাবি আমেরিকান গবেষকরা করেছেন মর্মে কোনো বিশ্বস্ত তথ্যপ্রমাণ নেই। তাছাড়া, নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণাতেও এমন দাবির সপক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে আমেরিকান গবেষকদের মর্মে প্রচারিত আলোচিত দাবিটির সপক্ষে কোনো বিশ্বস্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

শীর্ষস্থানীয় বা নির্ভরযোগ্য কোনো আমেরিকান গবেষকদের এমন কোনো দাবি না পাওয়া গেলেও আমেরিকান নির্দলীয় থিংক ট্যাঙ্ক পিউ রিসার্চ সেন্টারের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে ২০১৫ সালের ২ এপ্রিল তারিখে “The Future of World Religions: Population Growth Projections, 2010-2050” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে বিগত দিনের নানা বিষয়ের উপর ভিত্তি করে ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিকভাবে কোন ধর্মের অবস্থান কোথায় হবে তার একটি সম্ভাবনা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে। বৈশ্বিক জনসংখ্যার পরিবর্তন একই গতিতে চলতে থাকলে ২০১০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ৩৫% বেড়ে ৯.৩ বিলিয়ন হতে পারে। একই সময়ে মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে পারে ৭৩% এবং বৃহৎ ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলাম ধর্মই একমাত্র ধর্ম যারা বিশ্বের জনসংখ্যা বাড়ার হারের চেয়ে (৩৫%) বেশি হারে বাড়বে। খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের সংখ্যাও বাড়বে, তবে তুলনামূলক কম গতিতে (৩৫%)। ফলস্বরূপ, সব গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী ঠিকঠাক চললে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে খ্রিষ্টান ও মুসলিম ধর্মের মানুষজন প্রায় সমান হয়ে যাবে যা ইতিহাসে সম্ভবত প্রথমবারের মতো হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ মুসলিম জনসংখ্যা হতে পারে ২.৮ বিলিয়ন, বিশ্বের জনসংখ্যার ৩০% এবং খ্রিস্টান হতে পারে ২.৯ বিলিয়ন, বিশ্বের জনসংখ্যার ৩১%। হিন্দুদের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার ৩৪%। অর্থাৎ, বৃহৎ ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের দিক দিয়ে হিন্দু ধর্ম তৃতীয় অবস্থানে। 

Screenshot : Pew Research Center

বৈশ্বিকভাবে, মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রজনন হার বা ফার্টিলিটি রেট সর্বোচ্চ। একজন মুসলিম নারী গড়ে ৩.১ টি শিশুর জন্ম দেন যা প্রতিস্থাপন হার বা রিপ্লেসমেন্ট লেভেল (২.১) এর বেশ উপরে৷ 

উল্লেখ্য, প্রজনন প্রতিস্থাপন হার বা রিপ্লেসমেন্ট লেভেল হচ্ছে একটি প্রজন্মের পর পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে একজন নারীর জীবদ্দশায় সাধারণত সর্বনিম্ন যে কয়টি সন্তানের জন্ম দেওয়া প্রয়োজন তার একটি সংখ্যা৷ সাধারণত মৃত্যু হার, বিশেষত শিশু মৃত্যুর হারের সাথে সামঞ্জস্য করে একজন নারী ২.১টি শিশুর জন্ম দিলে সেই জনগোষ্ঠী প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্থিতিশীল থাকবে ধরা হয়৷ তবে, অনুন্নত দেশ বা মৃত্যু বিশেষত শিশু মৃত্যুর হারের উপর ভিত্তি করে এই সংখ্যার তারতম্য হতে পারে। সাধারণত এই সংখ্যা ২.১ ধরা হয়।

প্রজনন হারের দিকে দ্বিতীয় স্থানে আছে খ্রিষ্টান ধর্ম (২.৭)। হিন্দুদের প্রজনন হার ২.৪ যা বৈশ্বিক গড় হারের (২.৫) প্রায় সমান। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে জনসংখ্যা বাড়ার দিক দিয়েও হিন্দু ধর্মের অবস্থান তৃতীয়। 

Screenshot : Pew Research Center

আমেরিকান প্রতিষ্ঠানটির উক্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত গবেষণা বা দাবি অনুসারে, ২০৫০ সালে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী সবচেয়ে বেশি হবে (মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১.৪%), দ্বিতীয় স্থানে থাকবে মুসলিম (মোট জনসংখ্যার ২৯.৭%) এবং অসম্বন্ধীয় বা Unaffiliated জনসংখ্যাকে পেরিয়ে তৃতীয় বৃহৎ ধর্ম হতে পারে হিন্দু ধর্ম (মোট জনসংখ্যার ১৪.৯%)। উল্লেখ্য, Unaffiliated বলতে নাস্তিক বা যারা কোনো ধর্মের সাথেই যুক্ত নয় তাদেরকে বুঝানো হয়েছে। তাদের সংখ্যা ২০১০ সালে তৃতীয় সর্বোচ্চ হলেও ২০৫০ সালে তারা চতুর্থ হবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১০ সালে হিন্দুদের জনসংখ্যা Unaffiliated জনসংখ্যার চেয়ে কম ছিল।

Screenshot : Pew Research Center

উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০৭০ সাল নাগাদ মুসলিম ও খ্রিস্টান জনসংখ্যা সমান হতে পারে এবং তার পরবর্তী সময়ে ইসলাম ধর্ম বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্ম হতে পারে। 

Screenshot : Pew Research Center

তথ্য ও ভিজ্যুয়ালাইজেশন নিয়ে কাজ করা জার্মান প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা ২০১৫ সালের এপ্রিলে এ বিষয়টি গ্রাফের সাহায্যে বুঝায় যেখানে গ্রাফের সাহায্যে বুঝানো হয়, ২০৫০ সালে খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী সংখ্যা সর্বোচ্চ, দ্বিতীয় ইসলাম ধর্মের অনুসারী সংখ্যা এবং তৃতীয় হিন্দু ধর্মের অনুসারী সংখ্যা হতে পারে। 

Screenshot : Statista

এরই প্রেক্ষিতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এবং হিন্দুস্তান টাইমস ২০১৫ সালে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল যেখানে তারা জানিয়েছে ২০৫০ সাল নাগাদ হিন্দু ধর্ম বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ ধর্ম হতে পারে এবং কোনো একক দেশে সর্বোচ্চ মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণের হিসেবে ইন্দোনেশিয়াকে পার করে ফেলতে পারে ভারত৷ 

২০১৭ সালের ৫ এপ্রিল তারিখে “The Changing Global Religious Landscape ” শিরোনামে পিউ রিসার্চ সেন্টার আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে খ্রিষ্টান মায়েদের ঘরে সবচেয়ে বেশি শিশুর জন্ম হলেও আগামী দশকগুলোতে মুসলিম শিশুর সংখ্যা খ্রিষ্টান শিশুর সংখ্যাকে পার করে ফেলতে পারে। বৈশ্বিকভাবে মুসলিমদের তুলনামূলক যুবক-যুবতী জনগোষ্ঠী ও উচ্চ প্রজনন হারের কারণে ধারণা করা যাচ্ছে, ২০৩০ এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে মুসলিমদের জন্ম হওয়া শিশুর সংখ্যা (২২৫ মিলিয়ন) খ্রিষ্টানদের জন্ম হওয়া শিশুর সংখ্যার (২২৪ মিলিয়ন) চেয়ে তুলনামূলক কিছুটা বেশি হবে। তবে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কষ্টকর এবং জটিল যে শিশু বড় হয়েও তার মায়ের ধর্মেই থাকবে কি না।

উক্ত প্রতিবেদন থেকে এছাড়াও জানা যায়, মুসলিম জনসংখ্যা তুলনামূলক বেশি গতিতে বাড়ছে যার ফলশ্রুতিতে ২০৬০ সাল নাগাদ মুসলিমদের জনসংখ্যা খ্রিস্টান জনসংখ্যার সমান হতে পারে। অর্থাৎ, আমেরিকান প্রতিষ্ঠানটির উক্ত গবেষণা বা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে খ্রিষ্টানদের পেরিয়ে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার বা সবচেয়ে বড় ধর্ম হওয়ার দিক দিয়ে ইসলাম ধর্ম সবচেয়ে এগিয়ে আছে এবং হিন্দু ধর্ম তৃতীয় অবস্থানে আছে এবং বেশ পিছিয়ে আছে৷ 

এ বিষয়ে ভারতের নানা বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ ও মতামত প্রকাশকারী প্ল্যাটফর্ম, আইডিয়াস ফর ইন্ডিয়ায় ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বে হিন্দুদের আবাসস্থলের সবচেয়ে বড় দেশ ভারতেও হিন্দুদের প্রজনন হার ২০১৯ সালেও মুসলিমদের চেয়ে কম। ভারতে হিন্দু এবং মুসলিম দুই ধর্মেরই প্রজনন হার কমতে থাকলেও ভারতের ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেল্থ সার্ভে (NFHS-5) এর সর্বশেষ ২০১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্যতেও মুসলিমদের প্রজনন হার হিন্দুদের চেয়ে বেশি দেখা যায়। 

সুতরাং, আমেরিকান গবেষকরা বলেছেন, ২০৫০ সালে হিন্দু ধর্ম বিশ্বের সবচেয়ে বড় ধর্ম হতে যাচ্ছে শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img