বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেওয়া হয়নি

সরকারি সকল গ্রেডের চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে গত পহেলা জুলাই থেকে টানা আন্দোলন চলছে যা ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্যের পর তীব্র আকার ধারণ করে। আন্দোলনকারীদের দমাতে এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীকেও রাস্তায় নামায় সরকার। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রতিবেদনের ভিডিও সংযুক্ত করে দাবি প্রচার করা হচ্ছে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়েছে। 

 জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়নি বরং এ সংক্রান্ত দাবিতে ডয়চে ভেলের যে ভিডিও প্রতিবেদন প্রচার করা হয়েছে তাতেও এমন কোনো তথ্য নেই। প্রতিবেদনে আন্দোলনকারীদের দমাতে জাতিসংঘের ইউএন লেখাযুক্ত সাঁজোয়া যান ব্যবহার করায় জাতিসংঘ উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানানোর বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে দাবিকৃত পোস্টে সংযুক্ত মূল ভিডিওটি জার্মান ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্রডকাস্টার ডয়চে ভেলের ইউটিউব চ্যানেল DW News এ “Bangladesh deploys UN-marked vehicles to quell student protests ” শিরোনামে ২৩ জুলাই তারিখে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ভিডিও প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দমাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জাতিসংঘের লোগোযুক্ত সাঁজোয়া যান ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এমন কার্যক্রমের সমালোচনা করেছে মানবাধিকার সংস্থা। তাছাড়া এ বিষয়ে নিজের উদ্বেগ ও প্রতিবাদ জানিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানিয়েছেন, জাতিসংঘে যেসব দেশ সৈন্য ও পুলিশ সদস্য পাঠায় তারা জাতিসংঘের নির্ধারিত ম্যান্ডেটের অধীনে শান্তিরক্ষা কিংবা রাজনৈতিক মিশনে শুধু জাতিসংঘের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে। 

উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনে কোথাও বলা হয়নি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। বরং, উক্ত সংবাদ প্রতিবেদনেই ডয়চে ভেলের অনুসন্ধান বা তদন্ত টিমের একজন বলেন, ডয়চে ভেলে এর আগে জাতিসংঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশী কিছু মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর সম্পৃক্ততা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। জাতিসংঘ নিজে তদন্ত করবে বলে জানিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত (প্রতিবেদনটি ধারণকালীন সময় পর্যন্ত) জাতিসংঘের তরফ থেকে কোনো কিছুই ঘটেনি। তিনি বলেন, তার মনে হয়, জাতিসংঘ এ বিষয়ে উভয় সঙ্কটে আছে। কারণ বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অবদান রাখা শীর্ষস্থানীয় একটি দেশ।

ইউএন লেখাযুক্ত সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান ব্যবহার করার বিতর্ক নিয়ে আরো নানা গণমাধ্যমেও সংবাদ প্রচার হয়েছে। এ বিষয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ২২ জুলাই জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত এক নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিককে এ সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন করা হলে জবাবে মি. ডুজারিক বলেন, “জাতিসংঘে যেসব দেশ সৈন্য ও পুলিশ সদস্য পাঠায় তারা জাতিসংঘের নির্ধারিত ম্যান্ডেটের অধীনে শান্তিরক্ষা কিংবা রাজনৈতিক মিশনে শুধু জাতিসংঘের প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা গভীর উদ্বেগের বিষয়টি বাংলাদেশে আমাদের সহকর্মীদের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।”

উক্ত প্রতিবেদনেও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেওয়ার কোনো ঘোষণার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি। 

উল্লেখ্য, এ বিষয়ে পরবর্তীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘জাতিসংঘের কোনো যান ব্যবহৃত হচ্ছে না। আমি এখানে বিষয়টি পরিষ্কার করি। এগুলো (যান) জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ভাড়া দেওয়া হয়েছিল। লোগোটা মোছা হয়নি, ভুলে। সেই লোগোগুলো এখন মুছে দেওয়া হয়েছে।’ 

এ বিষয়ে সর্বশেষ গতকাল (২৯ জুলাই) জাতিসংঘের একটি প্রেস ব্রিফিংয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক জানান, জাতিসংঘের ইউএন লেখাযুক্ত সামরিক যানবাহন রাস্তা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য তারা আমলে নিয়েছে। এরপর তিনি এ বিষয়ে তার কয়েকদিন আগের বক্তব্যই পুনরায় বলেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘের সৈন্য এবং পুলিশ দিয়ে সাহায্যকারী দেশগুলো কেবল তখনই জাতিসংঘের প্রতীক এবং সরঞ্জামগুলো ব্যবহার করবে, যখন তারা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বা জাতিসংঘের রাজনৈতিক মিশনের অংশ হিসাবে কাজ করবে।

তিনি গতকালের প্রেস ব্রিফিংয়েও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করেননি।

এছাড়া গণমাধ্যম বা বিশ্বস্ত সূত্রেও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়ে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মূলত, সরকারি সকল গ্রেডের চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে গত পহেলা জুলাই থেকে শুরু হওয়া টানা আন্দোলন গত ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্যের পর তীব্র আকার ধারণ করে। আন্দোলনকারীদের দমাতে এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করা হয়৷ এ সময় সেনাবাহিনী জাতিসংঘের ইউএন লেখাযুক্ত সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে যা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন বা জাতিসংঘের অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করার অনুমতি নেই। এই বিষয়ে জার্মান ভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলে ভিডিও প্রতিবেদন  প্রকাশ করে। উক্ত ভিডিও সংযুক্ত করে দাবি প্রচার করা হচ্ছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাদ দেওয়ার কোনো ঘোষনা এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ দেয়নি। তবে, ইউএন লেখাযুক্ত সাঁজোয়া যান ব্যবহার করায় জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ ও প্রতিবাদ করে ব্যাখ্যা চেয়েছিল।

সুতরাং, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে বাদ দেওয়া হয়েছে শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img