সম্প্রতি দুই জোড়া জুতার ছবি কোলাজ করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যবহৃত জুতা দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত হচ্ছে।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত জুতার ছবিগুলো হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যবহৃত জুতার ছবি নয়, বরং এর মধ্যে একটি ছবি প্রায় ৬ হাজার বছর পুরনো একটি জুতার এবং অপরটি প্রায় ১০ হাজার বছর পুরনো কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তির জুতার ছবি৷ উক্ত জুতাদ্বয়কে কোনোরকমের তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জুতা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে প্রথম ছবিটির ক্ষেত্রে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি অবলম্বন করে স্প্যানিশ জনপ্রিয় ইতিহাস সাময়িকী Historia National Geographic এর ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে “THEY DISCOVER THAT THE OLDEST SANDALS IN SOUTHERN EUROPE ARE THOSE FOUND IN A CAVE IN GRANADA” (স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভাষান্তরিত) শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত প্রথম জোড়া জুতার ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, প্রচারিত জুতা জোড়া ইউরোপীয় দেশ স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলের আন্দালুসিয়া অঞ্চলের গ্রানাডা শহরের The Bat Cave এ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এবং জুতা জোড়া দক্ষিণ ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন৷
উক্ত বিষয়ে জনপ্রিয় বিজ্ঞান সংবাদ ওয়েবসাইট Live Science এ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে “9,500-year-old baskets and 6,200-year-old shoes discovered in Spanish bat cave” শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে গবেষকদের বরাতে জানানো হয়, Cueva de los Murciélagos বা Bat Cave নামের উক্ত গুহায় পাওয়া ৭৬টি বস্তু বিশ্লেষণ করা হয় এবং উক্ত জুতা জোড়ার বয়স ৬২০০ বছর৷
তাছাড়া এ বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় বেলজিয়ামের সবচেয়ে জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম The Brussels Times এ ২০২৩ সালের ২ অক্টোবর তারিখে “Europe’s oldest shoes identified in Spain” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, ১৯ শতকে খননকারী দ্বারা প্রাপ্ত জুতা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণা করা হয় এবং জানা যায়, জুতা জোড়া ৬০০০ বছর পুরনো। স্যান্ডালগুলো বোনা ঘাস ব্যবহার করে বানানো হয়েছিল। গুহায় নিম্ন আর্দ্রতা এবং সতেজ বাতাসের চলাচল থাকায় জুতা অত্যন্ত ভালো অবস্থায় ছিল। জুতা ছাড়াও একটি ঝুড়ি এবং আরো বিভিন্ন জিনিসপাতি গবেষকদের বিশ্লেষণ করার বিষয়েও উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়।
পাশাপাশি এ বিষয়ে আমেরিকান জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম NBC News এর ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর তারিখে “The world’s oldest shoes? Sandals found in bat cave are thousands of years old, study finds” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটিতে বিজ্ঞানীদের বরাতে জানানো হয়, উল্লিখিত জুতা ৬২০০ বছর পুরনো পর্যন্ত হতে পারে৷ এছাড়াও প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, গবেষকরা রেডিওকার্বন ডেটিং ব্যবহার করে ঝুড়ি এবং ২২টি স্যান্ডেলসহ মোট ৭৬টি জিনিসের গবেষণা করেন।
উল্লেখ্য যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে ছিলেন আজ থেকে প্রায় সাড়ে ১ হাজার ৪ শত বছর পূর্বে। অর্থাৎ, এটি নিশ্চিত যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে আসারও প্রায় কয়েক হাজার বছর পূর্বে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবির জুতা ব্যবহার করা হয়েছিল। তাছাড়া, হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের জীবনের সিংহভাগ সৌদি আরবে কাটালেও ছবিতে ব্যবহৃত প্রথম জুতার জোড়াটি ইউরোপের স্পেনের একটি অঞ্চলে পাওয়া গিয়েছে।
ছবিতে ব্যবহৃত দ্বিতীয় ছবিটির ক্ষেত্রেও একইভাবে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি অবলম্বন করে Ancient Pages নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ২২ জুন তারিখে “World’s Oldest Shoes: Some Look Surprisingly Modern” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত দ্বিতীয় জোড়া জুতার ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, মুহাম্মদ (সা.) এর জুতা দাবিতে প্রচারিত দ্বিতীয় ছবিটি এ যাবতকালের সবচেয়ে পুরাতন স্যান্ডেল যার বয়স ৯,০০০ বছরেরও বেশি। উক্ত স্যান্ডেল ১৯৩৮ সালে নৃবিজ্ঞানী লুথার ক্রেসম্যান যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগনের রক কেভে আবিষ্কার করেন। গুহাটির ভেতর ক্রেসম্যান ডজনখানেক স্যান্ডেল এবং স্যান্ডেলের টুকরো খুঁজে পান৷ ক্রেসম্যানের বিশ্বাস ছিল স্যান্ডেলগুলো প্রাচীন, তবে যেহেতু তখনও রেডিও কার্বন পদ্ধতি বিকশিত হয়নি, তাই ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা সম্ভবপর হয়নি। অতঃপর রেডিও কার্বন পদ্ধতির বদৌলতে জানা যায়, স্যান্ডেলগুলোর তন্তুর বয়স ৯০০০ বছরেরও অধিক। উল্লেখ্য, উক্ত প্রতিবেদনে স্যান্ডেলের ছবির ক্রেডিট ইউনিভার্সিটি অফ ওরেগনকে দেওয়া হয়৷
অধিকতর অনুসন্ধানে উক্ত বিষয়ে The Madras Pioneer নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ১০ মার্চ তারিখে “Fort Rock Cave excavations uncover history” শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, ১৯৩৮ সালের গ্রীষ্মকালে ফর্ট রক কেভে প্রায় ৭৫ জোড়া স্যান্ডেল খুঁজে পাওয়া যায়। স্যান্ডেলগুলো University of Oregon Museum of Natural and Cultural History এ সংরক্ষণ করে রাখা আছে। ইউনিভার্সিটি অফ ওরেগনের নৃবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ডক্টর লুথার এস. ক্রেসম্যান ও তার কিছু ছাত্রদের করা এই খননে পাওয়া জুতাগুলো উত্তর আমেরিকায় প্রায় ৯০০০ বছর পূর্বে মানুষের অস্তিত্ব প্রমাণ করে।
অতঃপর, এরই সূত্র ধরে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধান করলে ইউনিভার্সিটি অফ ওরেগনের ওয়েবসাইটে “The World’s Oldest Shoes” শিরোনামে এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। নিবন্ধটি পড়ে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা যায় এবং জানা যায়, উক্ত স্যান্ডেলের বয়স ৯,৩০০ থেকে ১০,৫০০ বছর।
অর্থাৎ, পুনরায় এটি নিশ্চিত যে, হযরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে আসার অন্তত ৮ হাজার বছর পূর্বে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবির জুতা ব্যবহার করা হয়েছিল। তাছাড়া, দ্বিতীয় জুতার প্রাপ্তির স্থান আমেরিকা যা হযরত মুহাম্মদ সা. এর জীবদ্দশার সিংহভাগ কাটানো সৌদি আরবের চেয়ে অনেক দূরে অবস্থিত।
পাশাপাশি, কি-ওয়ার্ড সার্চ করেও প্রচারিত দাবির স্বপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মূলত, দক্ষিণ স্পেনের গ্রানাডায় খুঁজে পাওয়া প্রায় ৬০০০ বছর পূর্বের এক জোড়া জুতা এবং আমেরিকার ওরেগনে খুঁজে পাওয়া প্রায় ৯০০০ বছর পূর্বের আরেক জোড়া জুতার ছবি একত্রিত করে কোনোরকমের বিশ্বাসযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ব্যবহৃত জুতা দাবিতে প্রচারিত হচ্ছে।
অর্থাৎ, ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির ব্যবহৃত জুতার ছবিকে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জুতা দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।