সুখের এবং কষ্টের কান্নায় আলাদা চোখ দিয়ে প্রথমে পানি ঝরার দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি, ‘সুখের কান্নায় ডান চোখে, কষ্টের কান্নায় বাম চোখে আগে পানি আসে’ শীর্ষক শিরোনামে একটি ফটোকার্ড সম্বলিত তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।

কষ্টের কান্নায়

খানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

যা দাবি করা হচ্ছে

ফেসবুকে প্রচারিত উক্ত ফটোকার্ডটিতে বলা হয়েছে, “আপনি জানলে অবাক হবেন! আমরা যখন সুখে কান্না করি তখন সেটা প্রথম ডান চোখ দিয়ে পানি ঝরে, এবং কষ্টের কান্না করলে প্রথম বাম চোখ দিয়ে পানি ঝরে থাকে। আর এই পানি কি শুধুই পানি! এতে রয়েছে শ্লেষ্মা, তেল, ইলেক্ট্রোলাইট-এর এক জটিল মিশ্রণ। যেটি ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোেধী, যা চোখকে বিভিন্ন ইনফেকশন থেকে রক্ষা করে থাকে।”

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সুখের ও কষ্টের কান্নায় যথাক্রমে ডান ও বাম চোখে প্রথমে পানি আসে শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই ভিত্তিহীনভাবে উক্ত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানার আগে রিউমর স্ক্যানারের পাঠকদের বোঝার সুবিধার্থে চোখের অশ্রু সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো-

অশ্রু কীভাবে উৎপন্ন হয়?

চোখের গোলকের বাইরের অংশে অবস্থিত ল্যাক্রিমাল গ্রন্থিতে অশ্রু উৎপন্ন হয়। এই গ্রন্থি টিয়ার ফিল্মের মধ্যম স্তর নিয়ে গঠিত। স্বাস্থ্যকর অশ্রু চোখকে শুকিয়ে যাওয়া থেকে বাধা দেয়। চোখের কর্নিয়াকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। মানুষের মনে বিভিন্ন ধরনের অনুভূতির প্রকাশ হিসেবে ল্যাক্রিমাল গ্রন্থি অশ্রু উৎপন্ন করে। মানুষ যখন কাঁদে তখন তরল চোখের বাইরে বের হয়ে আসে, যাকে আমরা অশ্রু বলি।

অশ্রুর ধরন

মানুষের চোখের সুস্থতার জন্য অশ্রু একটি অপরিহার্য জিনিস। অশ্রুর সাথে মানুষের আবেগের সংযোগ রয়েছে। মানুষের চোখ থেকে ৩ ধরনের অশ্রু উৎপন্ন হয়।

বেসাল টিয়ার্স

এটি চোখের মৌলিক অশ্রু। বেসাল টিয়ার্স চোখের পাতা নাড়াচাড়া করতে সাহায্য করে। কারণ এর মাধ্যমে চোখ পিচ্ছিল থাকে। এটি তিনটি লেয়ারের সাহায্যে তৈরি হয় যার সবচেয়ে ভেতরেরটি মিউকাস লেয়ার, মাঝেরটি অ্যাকুয়াস লেয়ার আর ওপরেরটি তৈলাক্ত লিপিড লেয়ার। এই লেয়ারগুলো চোখের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। এরা চোখকে ভেজা রাখে, বাইরের ময়লা এবং ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।

ইরিটেন্ট টিয়ার্স বা রিফ্লেক্স টিয়ার্স

চোখকে ধোঁয়া, ধুলাবালি বা জ্বালাপোড়ার হাত থেকে এই অশ্রু সাহায্য করে। এটি চোখকে পরিষ্কার রাখে। যখন চোখে জ্বালাপোড়া তৈরি হয়, তখন এই টিয়ার তৈরি হয়ে চোখের জ্বালাপোড়ার জন্য দায়ী পদার্থকে চোখ থেকে বের করে দেয়। এটি ব্যক্টেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করে।

ইমোশনাল টিয়ার্স

মানুষের দুঃখ, কষ্ট, ভয়, আনন্দ এবং অন্যান্য সংবেদনশীল অবস্থার প্রতিক্রিয়ায় এই অশ্রু তৈরি হয়। এ কান্নায় অনেক বেশি মাত্রার হরমোন এবং প্রোটিন থাকে।

চোখের বিভিন্ন স্তর

মানবদেহের এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটিতে কয়েকটি স্তর রয়েছে। এরমধ্যে একটি হল আভ্যন্তরীণ বা শ্লেষ্মা স্তর, যা অশ্রুকে চোখের কাছে আটকে রাখে। আরেকটি স্তর হল, জলীয় মাঝারি স্তর। এটি চোখের সবচেয়ে পুরু স্তর। এই স্তরটি চোখকে হাইড্রেটেড রাখে, ব্যাক্টেরিয়া দূর করে এবং কর্নিয়াকে রক্ষা করে। তৃতীয় স্তরটি হল, বাইরের তৈলাক্ত স্তর, যা চোখের চোখের অশ্রু পৃষ্ঠকে মসৃণ রাখতে সাহায্য করে।

এবার আসি আলোচিত দাবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে। আমরা কি ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে যুক্তরাষ্টের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা পলিটিফ্যাক্টের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রকাশিত চোখের অশ্রু সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই।

উক্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনটিতে যুক্তরাজ্যের চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান ক্লিভল্যান্ডের এক প্রতিবেদনের বরাতে জানানো হয়, কষ্ট বা সুখের জন্য কান্না আলাদা আলাদা হয় না। অর্থাৎ, অশুনালিতে চোখের জলের পরিবর্তন হয় না, একইভাবে থাকে।

উক্ত বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা চেকইওরফ্যাক্টকে আমেরিকান একাডেমি অব অপথালমোলজি জানায়, ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির সময়ে আলাদা চোখ থেকে প্রথমে পানির আসার দাবিটির কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মেলেনি।

এছাড়াও, স্বাস্থ্যবিষয়ক অন্যকোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে সুখের কান্না করলে প্রথম ডান চোখ দিয়ে পানি ঝড়ে এবং কষ্টের কান্না করলে বাম চোখ দিয়ে পানি ঝড়ার  তথ্যটির সত্যতা পাওয়া যায়নি।

মূলত, সাম্প্রতিক সময়ে ‘সুখের কান্না করলে প্রথমে ডান চোখ দিয়ে পানি ঝরে এবং কষ্টের কান্না করলে প্রথমে বাম চোখ দিয়ে পানি ঝরে’ শীর্ষক দাবিতে একটি ফটোকার্ড সম্বলিত তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে উক্ত দাবির সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আমেরিকান একাডেমি অব অপথালমোলজির মতে, ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির সময়ে আলাদা চোখ থেকে প্রথমে পানির আসার দাবিটির কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মেলেনি।

সুতরাং, সুখের কান্না করলে প্রথম ডান চোখ দিয়ে পানি ঝরে এবং কষ্টের কান্না করলে প্রথমে বাম চোখ দিয়ে পানি ঝরে শীর্ষক দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img