ভিডিওটি বরিশালে মুসলিমদের হামলায় হিন্দু পরিবারের আহাজারির দৃশ্যের নয়

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও সংযুক্ত করে গত বছর বাংলাদেশের বরিশালের গৌরিনাদে হিন্দু পরিবারের ওপর মুসলিমদের হামলা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।

ভিডিও সংযুক্ত করে ক্যাপশনে দাবি করা হচ্ছে, “এই হৃদয়বিদারক বেদনা বাংলাদেশের হিন্দু পরিবারের। গত বছর বরিশাল জেলার গৌরিনাদে হিন্দু পরিবারের উপর ইসলামী হামলা। ইসলামের দৃষ্টিতে কাফেরদের উপর অত্যাচার করা উত্তম কাজ। আল্লাহর কাছে নাম্বার পাওয়া যায়। এটাই লেখা, ফলাফল দেখুন?

ইসলামিক দেশ পাকিস্তানে হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে

ইসলামী দেশ বাংলাদেশে হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে

আর ভারতে ও হিন্দুদের হত্যা হচ্ছে।

ধর্মের দাবিতে ধর্ম-ধর্ম একসঙ্গে থাকতে পারে না এর জন্য দায়ী কংগ্রেস। ইসলামের জন্য আলাদা জায়গা চেয়ে মহম্মদরা ভাগ হয়ে গেছে কিন্তু নেহেরু-গান্ধী ভারত ছাড়তে দিল না এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুটোই ইসলামের হাতে তুলে দিল। রাম রাম”

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

উক্ত দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার নয়, বরং ভিডিওটি পাকিস্তানের। 

ভিডিওটি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা শেষে এ বিষয়ে অনুসন্ধানে এক্সে (সাবেক টুইটার) Voice of Pakistan Minority নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে ২০২২ সালের ২২ মার্চ তারিখে হুবহু একই ভিডিওটি প্রচার হতে দেখা যায়।

ভিডিওটির ক্যাপশনে বলা হয়, “ওয়াহিদ বক্স লাশারির দ্বারা নির্মমভাবে হত্যা হলেন পূজা কুমারী। কারণ, সে অপহরণ করতে বাধা দিয়েছিল যা পরবর্তীতে জোরপূর্বক ধর্মান্তর এবং বিয়েতে রূপান্তরিত হতো। তার পরিবারের অবস্থা দেখুন। কেন #হিন্দু এবং #খ্রিস্টান মেয়েরা এরকম নৃশংসতার মুখোমুখি হচ্ছে #JusticeForPoojaKumari”

Comparison : Rumor Scanner
Comparison : Rumor Scanner

উক্ত ক্যাপশন থেকে প্রাসঙ্গিক শব্দ নিয়ে কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে এ বিষয়ে উক্ত সময়ের একাধিক সংবাদ পাওয়া যায়। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম Dawn, Ary News, The Express Tribune এও উক্ত বিষয়ে সংবাদ প্রচার হতে দেখা যায়। ভারতের Times Now, Hindustan Times সহ একাধিক গণমাধ্যম এ বিষয়ে সংবাদ প্রচার করে। আন্তর্জাতিকভাবে কাতার ভিত্তিক গণমাধ্যম আল জাজিরা, মানবাধিকার সংগঠন CSW ও ক্যাথোলিক প্রেস এজেন্সি দ্বারা পরিচালিত নিউজ এজেন্সি Asia News এও এই বিষয়ে সংবাদ খুঁজে পাওয়া যায়। 

পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন এর প্রতিবেদন থেকে শুক্কুর স্টেশন হাউস অফিসার (SHO) বাশির জাগিরানির বরাতে জানা যায়, খুনি ওয়াহিদ বক্স লাশারিকে চিহ্নিত করা হয়েছে, সে দুইজন সহযোগী নিয়ে পূজা কুমারীর ঘরে প্রবেশ করে গুলি চালায়। কর্মকর্তারা জানান, লাশারি উক্ত কিশোরীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্তু মেয়েটি অসম্মতি জানায়। পুলিশ লাশারিকে গ্রেফতার করে স্থানীয় আদালতে পেশ করলে আদালত ১০ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে।

আল জাজিরার বরাতে জানা যায়, ঘটনাটি পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের রাজধানী করাচি থেকে প্রায় ৪৭০ কিলোমিটার দূর শুক্কুর জেলার রোহরি শহরে ঘটেছে।

উক্ত ঘটনা নিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও জাতীয় পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গরাও নিন্দা জানিয়েছেন। 

অধিকতর অনুসন্ধানে কানাডিয়ান আমেরিকান ম্যাগাজিন ভাইসে এ বিষয়ে উক্ত বছরের ৩১ মার্চ তারিখে প্রকাশিত একটি সংবাদ পাওয়া যায়। সংবাদটিতে ভিক্টিম পূজার সাথে পূজার মা রাবিয়া ওয়াদের ছবি ফিচার করা হয়। পূজার মায়ের পোশাক ও বেশভূষার সাথে উক্ত ভিডিওটিতে আহাজারিরত নারীর সাথে তুলনা করলে মিল পাওয়া যায়, যা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ভিডিওটি বাংলাদেশের নয়, বরং পাকিস্তানের এবং ভিডিওটি মেয়েকে হারানোর পর মায়ের আহাজারির দৃশ্যের। 

Comparison: Rumor Scanner

তাছাড়া, বরিশালে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের দাবি করে পোস্টকারী দুজন सनातन हितकारिणी न्यासThakur Prakash Singh এর ফেসবুক প্রোফাইল পর্যবেক্ষণ করে জানা যায়, তারা দুজনই ভারতীয় এবং ভারতের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি তথা বিজেপির কর্মী।

Collage : Rumor Scanner

মূলত, ২০২২ সালে পাকিস্তানের রোহরি শহরে বিয়ের প্রস্তাবে অসম্মতি জানানোর কারণে একজন হিন্দু কিশোরিকে গুলিবিদ্ধ করে হত্যা করে ওয়াহিদ বক্স লাশারি নামের এক ব্যক্তি। সেই মেয়ে হারানো মায়ের আহাজারির ভিডিও ব্যবহার করে তা গতবছর বাংলাদেশের বরিশাল জেলার গৌরনদী এলাকায় হিন্দু পরিবারের ওপর মুসলিমদের হামলার দৃশ্য দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত ০২ মে বরিশালের গৌরনদীতে উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ সহ অন্তত ৪ জন আহত হন। আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের এ রাজনৈতিক সংঘর্ষে গুরুতর জখম হওয়া সৈকত গুহ’র স্ত্রী বিপাশা গুহর হাসাপাতালে বিলাপ করার একটি ভিডিও যুক্ত করে এ ঘটনাকে এক্সের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতন হিসেবে প্রচার করা হয়েছে৷ এ বিষয়ে বিস্তারিত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।

সুতরাং, বাংলাদেশের বরিশালের গৌরনদীতে হিন্দু পরিবারের ওপর মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক হামলা মর্মে প্রচারিত দাবিটি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img