বাংলাদেশের খেলা দেখতে আসা অস্ট্রেলিয়ান সমর্থকের ছবির সাথে ভুয়া গল্প প্রচার

সম্প্রতি, “ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এই লোকটির নাম মিরিয়াদস। উনি একজন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। তিনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত তরুণীকে বিয়ে করেন এবং তার গর্ভে আসে এই দুই সন্তান কিন্তু ভাগ্যের কি পরিহাস তিনি তার স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলেন দ্বিতীয় সন্তান জন্মের সময়। তখন থেকেই তিনি বাংলাদেশকে ভালবাসেন। তাই বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে তিনি সবসময় সাপোর্ট করেন।” শীর্ষক একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। 

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের জার্সি পরে দুই সন্তানসহ নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশকে সমর্থন করতে মাঠে খেলা দেখতে আসা অস্ট্রেলিয়ান বাবার আলোচিত ছবিটির সাথে প্রচারিত গল্পটি সত্য নয় বরং ভুয়া নাম জুড়ে দিয়ে এই কল্পিত গল্প তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে। 

অনুসন্ধানে ‘Arafat un-official‘ নামের একটি ফেসবুক পেজে এই গল্পের প্রথম পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। গত ২৪ অক্টোবর সন্ধা ৭.৫২ মিনিটে তাদের পেজে এই ছবি যুক্ত করে গল্পটি যেভাবে লেখা হয় ঠিক সেভাবেই পরবর্তীতে কপি আর শেয়ারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পোস্টটি পর্যবেক্ষণ করে এলোমেলো বাক্যের গঠন এবং যতিচিহ্নের ব্যবহার না করার বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়।

পরবর্তীতে গল্পটির সত্যতা জানতে চেয়ে পেজটির সাথে যোগাযোগ করা হলে রিপ্লাইয়ে তারা জানায়,

“সরি ব্রো, এই পোস্টের কোন অথেনটিক সোর্স আমাদের কাছে নাই। কালেক্টেড পোস্ট।”

অর্থাৎ, এই গল্পটির যে অরজিনেটর বা যে পেজের পোস্টের মাধ্যমে গল্পটি ছড়িয়ে পড়েছে তারা জানাচ্ছে তাদের এই পোস্টের কোন অথেনটিক সোর্স নেই। একই সাথে তারা পোস্টটি কালেক্টেড পোস্ট হিসেবে দাবি করলেও আমাদের ম্যানুয়াল এবং ফেসবুকের সার্চিং টুলস ‘Crowdtangle’ সার্চে তাদের পোস্টটি এই গল্পের প্রথম পোস্ট হিসেবে পাওয়া যায়।

অনুসন্ধানে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কাভার করতে যাওয়া দেশীয় গণমাধ্যগুলোর ফেসবুক পেজে এ বিষয়টি নিয়ে কোন সংবাদ প্রকাশ হয়েছে কি না তা যাচাই করতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার কোন গণমাধ্যমেই এ নিয়ে কোন স্টোরি পায়নি। স্বভাবতই খেলা যেহেতু হচ্ছে অস্ট্রেলিয়াতে সেক্ষেত্রে এ গল্পটি মিডিয়ার মাধ্যমেই উঠে আসার কথা। কিন্তু এই গল্পের প্রচার কোন মিডিয়াতে হয়নি। কেবল লাইভ থেকে স্ক্রিনশট নিয়ে গল্পটি জুড়িয়ে দিয়ে ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।

পরবর্তীতে অনুসন্ধানে গত ৬ দিন আগে খেলা ভিত্তিক একটি গ্রুপে “ভাষা হারিয়ে ফেলছি। এই ৩ জনকে নিয়ে। ভালোবাসা অবিরাম।” শীর্ষক ক্যাপশনে সেই ছবিটি সম্বলিত ব্যাপক ভাইরাল একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। সেই পোস্টটিতে এখন পর্যন্ত ৫ লক্ষাধিক মানুষ লাইক/রিয়্যাক্ট করেছেন।

সেই পোস্টের কমেন্ট সেকশন থেকে সেই অস্ট্রেলিয়ান সমর্থকের মন্তব্য পাওয়া যায়। Jeff McClintock নামের সেই ব্যক্তি কমেন্টে লিখেছেন– 

This is my family. We are all Australian, but lived in Bangladesh for four years many years ago. We still support the Bangladesh cricket team, so went to see them play against the Netherlands in Hobart. It was very exciting to finally see players like Shakib, Fizz and Litton Das playing live. The atmosphere in the crowd was amazing with so many Bangladeshis there and it was wonderful that Bangladesh won the game!”

অর্থাৎ, লোকটি জানাচ্ছেন ‘এটা তার পরিবার এবং তারা সবাই অস্ট্রেলিয়ান। অনেক বছর আগে বছর চারেক তারা বাংলাদেশে বাস করেছিলো। সেইসূত্রে তারা এখনও বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে সমর্থন করে, তাই হোবার্টে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিলো।’

পাশাপাশি, সেদিন বাংলাদেশি এক সমর্থকের সেলফিতে তোলা তিনি অন্য একটি ছবি কমেন্টের রিপ্লাইয়ে দিয়েছেন যা প্রমাণ করে তিনিই সেই ব্যক্তি।

তার কমেন্টের রিপ্লাইতে ছবি পাওয়ার পরে নিশ্চিত হওয়ার পরও আমরা বিষয়টি সম্পর্কে নিজস্ব অনুসন্ধান এবং তার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। তার নাম ধরে অনুসন্ধান করে তার মন্তব্যের সত্যতা পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে বাংলাদেশে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসির ২০০৮ সালে প্রকাশিত তাদের ওয়েবসাইটের একটি প্রেস রিলিজে ‘Jeff McClintock’ নামের সেই ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া যায়। তার ফেসবুক প্রোফাইলের ছবি এবং অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসির ওয়েবসাইটের ছবি পর্যবেক্ষণ করে একই ব্যক্তি হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে রিউমর স্ক্যানার টিম।

অনুসন্ধানে অস্ট্রেলিয়ান গণমাধ্যম ‘ABC’ তে ২০০৪ সালে “Postcard: Bangladesh” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ‘Jeff McClintock’ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জেফ ম্যাকক্লিনটক TEAR অস্ট্রেলিয়ার সাথে বন্যা ত্রাণে ২০০৪ সালে বাংলাদেশে এসে কাজ করছেন। তিনি তার স্ত্রী লিয়া, সন্তান ক্যালাম (৫) এবং মাতিলদা (৩) কে নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং রাজধানী ঢাকায় বাস করেছেন।

Symbiosis International এর ওয়েবসাইট থেকে জানা যায় জেফ ম্যাকক্লিনটক Symbiosis International এর Manager, Operations এবং তিনি Symbiosis এর Bangladesh প্রকল্পে কাজ করেছেন।

পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ান একটি ওয়েবসাইটে Eye Health Heroes tell their story প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে তার স্ত্রী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় তার স্ত্রীর নাম Leah McClintock. প্রতিবেদনে Leah McClintock সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়,

“OPSM Launceston-এর একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হলেন Leah McClintock। তিনি বাংলাদেশে আই কেয়ার সার্ভিস নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং সেবাগুলি সহজলভ্য করতে গত এক দশকের বেশির ভাগ সময় ব্যয় করেছেন। মিসেস ম্যাকক্লিনটক ২০০৪ সালে স্থানীয় সাহায্য ও উন্নয়ন সংস্থা সিম্বিওসিসের সাথে কাজ করার জন্য আমন্ত্রিত হওয়ার পর তার স্বামী জেফ এবং দুটি ছোট সন্তানসহ ঢাকায় চলে আসেন। তিনি Optometry Giving Sight এর অর্থায়ন স্থানীয় একটি কমিউনিটি চক্ষু স্বাস্থ্য কোর্স গ্রহণ করেন এবং SPECS নামে একটি আই-কেয়ার প্রোগ্রাম তৈরি করেন, যার মাধ্যমে কম সেবা পায় এমন সুবিধাবঞ্চিত অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করে প্রাথমিক চক্ষু-যত্ন পরিষেবা ও চোখের স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান, স্কুল ভিশন স্ক্রীনিং এবং অস্ত্রোপচারের জন্য রেফারেল প্রদান করেন।

তিনি ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেসে বসবাস করেছেন এবং গ্রামীণ এলাকায় প্রোগ্রামটি প্রতিষ্ঠা করার জন্য স্থানীয় কর্মীদের সাথে কাজ করেছেন।”

পরবর্তীতে Jeff Mcclintock এর লিংকড-ইনের About থেকে জানা যায় তার এক স্ত্রী এবং চার সন্তান রয়েছে। 

Jeff এবং Lean দম্পতি ২০০৪ সালে যখন বাংলাদেশে আসেন তখন তাদের সন্তান সংখ্যা ছিলো দুই, যাদের নাম Calum এবং Matilda এবং পরবর্তীতে তারা আরো দুটি সন্তান লাভ করেছেন। পরবর্তীতে অনুসন্ধানে আমরা এই দম্পতির অন্য দুই সন্তানের নামও জানতে পেরেছি।

The Examiner ওয়েবসাইটে Penny-farthings rolled out to help Bangladesh eye car charity Symbiosis শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, Jeff McClintock এর অপর দুই সন্তানের নাম Sean McClintock এবং Meg McClintock এবং তার এই দুই সন্তান বাংলাদেশী চক্ষু বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণের জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে পেনি-ফার্থিং সাইকেল চালানো একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো।

Sean এবং Meg এর ছবির সাথে তাদের পিতা Jeff McClintock এর সাথে বাংলাদেশের জার্সি পরিহিত বাচ্চা দুটির চেহারার মধ্যেও মিল লক্ষ্য করা যায়। 

অর্থাৎ তার রিপ্লাইয়ে দেয়া ছবির পাশাপশি নিজস্ব অনুসন্ধানেও এটি নিশ্চিত হওয়া যায় যে Jeff McClintock নামের সেই ব্যক্তির করা মন্তব্যটি সত্য। দুই সন্তানসহ বাংলাদেশের জার্সি পরিহিত অবস্থায় বাংলাদেশকে সমর্থন দিতে মাঠে আসা সেই ব্যক্তিই তিনি এবং তার স্ত্রীর নাম Leah McClintock, ২০০৪-২০০৮ সাল অব্দি তারা বাংলাদেশে বসবাস করার মাধ্যমে এখানে নানান জনকল্যাণমূলক কাজ করছেন।

মূলত, জেফ ম্যাকক্লিনটক এবং লিয়া ম্যাকক্লিনটক দম্পতি কর্মসূত্রে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করেছেন এবং এ দেশে নানান সেবামূলক কাজ পরিচালনা করেছেন। সেই সূত্রে নিজ দেশ অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হওয়ার সুবাদে বাংলাদেশ এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যকার ম্যাচটি জেফ ম্যাকক্লিনটক তার পরিবারসহ বাংলাদেশকে সমর্থন  দিতে বাংলাদেশের জার্সি পরে মাঠে এসেছিলেন। ম্যাচের লাইভ চলাকালে বাংলাদেশের জার্সি পরিহিত অস্ট্রেলিয়ান বাবা ও দুই সন্তানের খেলা দেখতে আসার বিষয়টি টিভি স্ক্রিনে দেখানো হলে তার স্ক্রিনশট নিয়ে ভুল নাম দিয়ে গল্প তৈরি করে প্রচার করা হয়। তবে সেই ব্যক্তির নাম মিরিয়াদস নয় বরং জেফ ম্যাকক্লিনটক, তার স্ত্রী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত নয় বরং খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান এবং তিনি দুই সন্তান জন্মদানের পর মারাও যাননি। 

সুতরাং, বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ড ম্যাচে সন্তান সহ এক পিতার বাংলাদেশের জার্সি গায়ে জড়িয়ে হোবার্টে বাংলাদেশকে সমর্থন দিতে আসার একটি ছবির সাথে সংযুক্ত গল্পটি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img