চবিতে শিবিরের গুলিতে শিশু ইফতি নিহতের দাবিটি ভুয়া, ভারতীয় শিশুর ছবি প্রচার

গত ৩০ আগস্ট দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে রোববার বেলা ৩টা পর্যন্ত দফায় দফায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সংলগ্ন জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের অন্তত ২২০ জন আহত হয়েছেন। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি কতিপয় অনলাইন ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি শিশুর ছবি সংযুক্ত করে প্রচার করা হয়েছে, “চবিতে শিবিরের গুলিতে শিশু ইফতি নিহত”।

আলোচিত দাবিতে প্রচারিত প্রতিবেদনের বিস্তারিত অংশে দাবি করা হয়, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) এলাকায় ভয়াবহ সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইফতি নামের এক শিশু নিহত হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কর্মীদের ছোড়া গুলিতেই এ মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। রোববার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট সংলগ্ন লন্ডনি বিল্ডিং এলাকায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুরো এলাকায় শোক ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।”

এরূপ দাবিতে অনলাইন ভিত্তিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন দিনপত্র, মুক্তিবার্তা৭১

আলোচিত দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি গ্রামবাসীদের সাথে হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় ইফতি নামের কোনো শিশু নিহত হয়নি। প্রকৃতপক্ষে সংঘর্ষে অনেকে আহত হলেও এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি কেউই নিহত হননি। এছাড়া, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত শিশুর ছবিটি আথার্ভা গোপাল তায়ড়ে নামের ভারতের মহারাষ্ট্রের ১৬ বছর বয়সী এক বালকের যে গত ৩ আগস্ট ভারতে আত্মহত্যা করে।

অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত প্রতিবেদনগুলোতে এক শিশুর ছবির সংযুক্তি পাওয়া যায়। শিশুটির ছবি রিভার্স সার্চে করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘এনডিটিভি’র ওয়েবসাইটে ‘Maharashtra Teen Jumps To Death From Hill As Mother Refuses To Buy Phone’ শিরোনামে গত ৪ আগস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে একটি শিশুর ছবির সংযুক্তি পাওয়া যায়, যার সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সংবাদে সংযুক্ত শিশুর ছবির সাথে তুলনা করলে হুবহু মিল পাওয়া যায়।

Comparison : Rumor Scanner

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি সাম্ভাজিনগরে রবিবার (৩ আগস্ট) এক ১৬ বছরের কিশোর পাহাড় থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে, কারণ তার মা তাকে মোবাইল ফোন কিনে দিতে রাজি হননি। কিশোরটির নাম আথার্ভা গোপাল তায়ড়ে। সে কয়েকদিন ধরে মাকে ফোন কিনে দিতে অনুরোধ করে আসছিল। কিন্তু, প্রতিবারই মা তা প্রত্যাখ্যান করেন। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আথার্ভা পুলিশ নিয়োগ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

রবিবারও আথার্ড আবার মায়ের কাছে ফোন চায়। কিন্তু মা অস্বীকার করলে, সে তিসগাঁও এলাকার একটি পাহাড়ে গিয়ে লাফ দেয়। স্থানীয়রা দ্রুত তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।” (অনূদিত)

এছাড়াও, এ বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘টিভি৯ তেলেগু’ এর ওয়েবসাইটেও গত ৪ আগস্টে আলোচিত শিশুর ছবির সংযুক্তিসহ একইরকম তথ্য সম্বলিত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়। পাশাপাশি, অনুসন্ধানে মূলধারার সংবাদমাধ্যম ‘মানবজমিন’ এর ওয়েবসাইটেও গত ৪ আগস্টে আলোচিত শিশুর ছবির সংযুক্তিসহ একইরকম তথ্য সম্বলিত আরেকটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।

এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে প্রচারিত ছবিটি আথার্ভা নামের ভারতীয় এক কিশোরের।

পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে সম্প্রতি গ্রামবাসীদের সাথে হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় ইফতি নামের শিশুর নিহতের দাবির সপক্ষে মূলধারার গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রকৃতপক্ষে সংঘর্ষে কারোরই নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটে গত ২ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “শনিবার (৩০ আগস্ট) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে পরদিন রোববার বেলা ৩টা পর্যন্ত দফায় দফায় ক্যাম্পাসসংলগ্ন জোবরা গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের অন্তত ২২০ জন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের প্রায় ২০০ জনই শিক্ষার্থী।”

উল্লেখ্য, সম্প্রতি গ্রামবাসীদের সাথে হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় কারোর মৃত্যুর খবর পাওয়া না গেলেও মূলধারার সংবাদমাধ্যম ‘সমকাল’ এর ওয়েবসাইটে গত ৩১ আগস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সূত্রে জানা যায়, “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত শতাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এদের মধ্যে দুই শিক্ষার্থী আইসিইউতে এবং এক শিক্ষার্থী ওয়ার্ডে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন।”

এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার টিম কালবেলার চবি প্রতিনিধি জাহিদুল হকের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, ‘এখন পর্যন্ত কেউ নিহত হয়নি।’

এছাড়াও, হাটহাজারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু কাউসার মোহাম্মদ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনিও জানান, তার জানামতে চবিতে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ নিহত হননি।

উল্লেখ্য যে, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত প্রতিবেদনে আরো দাবি করা হয়, “চবি প্রক্টর বলেন, “একটি শিশুর মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক।” এ বিষয়ে চবি প্রক্টর ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া অবধি তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

সুতরাং, চবিতে শিবিরের গুলিতে শিশু ইফতি নিহত দাবিতে ভারতীয় শিশুর ছবি প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img