সম্প্রতি দেশে ছিনতাই ও ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে, যার প্রেক্ষিতে দেশব্যাপী ধর্ষণবিরোধী নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে। এই পরিস্থিতিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক জনকণ্ঠ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল “গত ৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণ” প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ‘ট্রেন্ড টক’ নামের একটি ফেসবুক পেজের পোস্টের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। একই শিরোনামে মানবকণ্ঠ-ও প্রতিবেদন প্রকাশের পর পরবর্তীতে সরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি পোস্টেও ‘৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণ’ দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
এদিকে গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে বিভিন্ন সময়সীমা উল্লেখ করে ধর্ষণের সংখ্যা সম্পর্কিত একাধিক দাবি ভাইরাল হতে দেখা গেছে। প্রথমদিকে “গত ৪৮ ঘণ্টায় ১৭ ধর্ষণ” শীর্ষক একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে, এরপর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে “৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণ” দাবিটি ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়। তবে এটিই শেষ নয়—এর আগে পরেও “৪৮ ঘণ্টায় ৫০ ধর্ষণ”, “৬৫ ঘণ্টায় ৭৪ ধর্ষণ” সহ বিভিন্ন সংখ্যাসংবলিত আরও অনেক পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে।

জনকন্ঠের ৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণ শিরোনামের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ
জনকন্ঠ গতকাল ২৪ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ‘গত ৬৫ ঘন্টায় ৭২ ধর্ষণ’ অনলাইনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে সূত্র হিসেবে ট্রেন্ড টক নামের একটি পেজের পোস্ট লিংক উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে লেখা হয়—“গত ৬৫ ঘন্টায় ৭২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সিংগাইরে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ, অটোরিকশা থেকে নামিয়ে গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ, অবকাশ কেন্দ্রে বেড়াতে গিয়ে ধ’র্ষণের শিকার মাদ্রাসাছাত্রী, চলন্ত বাসে ডাকাতি-ধর্ষণ, শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী, স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া মেটানোর আশ্বাস দিয়ে নারীকে ধর্ষণ, ভিডিও ধারণ, ট্রলারে মাওয়া ঘাট পার হতে গিয়ে গৃহবধূ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার, বাবা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার এ ধরণের শিরোনামে সংবাদের চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে।”
জনকন্ঠ তাদের এ প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা অবনতি জনিত কারণে ঘটেছে এমন ৮টি ধর্ষণের উদাহরণ উল্লেখ করে। এই ৮টি ঘটনার বিশ্লেষণ:
- সিংগাইরে দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থীকে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ: এই ধর্ষণের ঘটনাটি গত বছরের আগস্টের, সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে সংবাদ হয়েছে। এছাড়াও, এটি প্রেমজনিত, তাই, এই উদাহরণটি সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা অবনতি জনিত ঘটনার সাথে যায় না।
- অটোরিকশা থেকে নামিয়ে গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণ : এই ঘটনাটি ঘটেছে গত ৬ ফেব্রুয়ারি।
- অবকাশ কেন্দ্রে বেড়াতে গিয়ে ধ’র্ষণের শিকার মাদ্রাসাছাত্রী : এই ঘটনাটি গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ঘটেছে।
- চলন্ত বাসে ডাকাতি-ধর্ষণ : গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীগামী একটি বাসে এই ঘটনা ঘটেছে। তবে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও, ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছে পুলিশ এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়াও, Ekhon TV এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, সেই ভুক্তভোগী নারী বিষয়টি অসত্য বলে জানিয়েছেন।
- শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল আনতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী : ২১শে ফেব্রুয়ারি সকালের ঘটনা।
- স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া মেটানোর আশ্বাস দিয়ে নারীকে ধর্ষণ: ঘটনাটি গত বছরের ১১ নভেম্বর ঘটেছে, সম্প্রতি সংবাদ হয়েছে।
- ট্রলারে মাওয়া ঘাট পার হতে গিয়ে গৃহবধূ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার : এই ঘটনাটি গত ১৭ ফেব্রুয়ারির ঘটেছে বলে মামলা সূত্রে জানা গেছে।
- বাবা কর্তৃক ধর্ষণের শিকার : এই ঘটনাটি নৈতিকভাবে চরম অবক্ষয় জনিত হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি সংক্রান্ত ঘটনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এছাড়াও, এই ঘটনার বিস্তারিত থেকে জানা গেছে, অনেক আগে কয়েকবার ধর্ষণ করার পর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আবার ধর্ষন করতে গেলে সেসময় এই ব্যক্তি এলাকাবাসীর কাছে আটক হন।
অর্থাৎ, জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে উল্লেখিত ঘটনার কোনোটিই প্রতিবেদন প্রকাশ এর সময় থেকে গত ৬৫ ঘণ্টায় ঘটেনি। এর মধ্যে সবচেয়ে কাছাকাছি একটি ঘটনা ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘটেছে।
সামাজিক মাধ্যমের ধর্ষণ দাবির তথ্য বিশ্লেষণ
আগেই জেনেছি জনকণ্ঠ একটি ফেসবুক পোস্টের ভিত্তিতে তাদের প্রতিবেদনটি করেছিল। ‘Trend Talk’ নামের ওই ফেসবুক পেজ থেকে গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাত ১১ টার দিকে ‘65 ঘণ্টায় 72 ধর্ষণ’ শীর্ষক পোস্টটি করা হয়েছিল এবং ওই পোস্টের কমেন্টে বিভিন্ন ধর্ষন ঘটনার নিউজের স্ক্রিনশট প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছিল। পোস্টটি ডিলিট করে দেয়ায় পোস্ট এবং কমেন্টসগুলোর স্ক্রিনরেকর্ড দেখা যাবে এখানে।
নিচে ওই পোস্টের কমেন্টের ঘটনাগুলির বিশ্লেষণ করা হলো:
গণনা করে দেখা গেছে ‘৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণ দাবির ওই পোস্টে ‘ট্রেন্ড টক’ পেজটি ৫১টি স্ক্রিনশট দিয়েছে, এর মধ্যে একটি ঘটনার সংবাদের স্ক্রিনশট তারা ৫ বার দিয়েছে, আরেক ঘটনার ৪ বার সহ বেশ কয়েকটি ঘটনার স্ক্রিনশট ২ এবং ৩ বার করে বেশ কয়েকবার দিয়েছে।
তারিখ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কেবল একটি ঘটনাই ৬৫ ঘণ্টার টাইমফ্রেমে পড়েছে, এছাড়া ২০ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯ ফেব্রুয়ারির ঘটনার স্ক্রিনশট রয়েছে। বাকিগুলো এর চেয়েও পুরোনো। অর্থাৎ, ৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণের দাবি করে এই পেজটি উক্ত টাইমফ্রেমে কেবল একটি ঘটনাই দেখিয়েছে।
আরো দেখা গেছে, এই তালিকায় গুম ভিক্টিমের স্ত্রীকে র্যাব কর্মকর্তা অলেপ উদ্দিনের ধর্ষণের ঘটনা সংক্রান্ত সংবাদের স্ক্রিনশট, নারী ফুটবলারকে ধর্ষণের হুমকিতে নারী পরিষদের প্রতিবাদের সংবাদ এবং সম্প্রতি এক নারীর আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগ কর্তৃক ধর্ষণের অভিযোগের সংবাদের স্ক্রিনশটও তারা কমেন্টে উল্লেখ করেছে।
অর্থাৎ, ৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণ ঘটার ভাইরাল দাবিটি অতিরঞ্জিত, বিভ্রান্তিকর এবং এটি সঠিক নয়।
৩ দিনে কতটি ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে?
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ‘৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণের’ দাবিটি ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়ে যাওয়ায়, রিউমর স্ক্যানার তিন দিনে কতটি ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে সেটি অনুসন্ধানের চেষ্টা করে। এই পরিসংখ্যানে যাতে কোনো ঘটনা বাদ না পড়ে যায় এজন্য রিউমর স্ক্যানার তার ফেসবুক গ্রুপে একাধিক পোস্ট করে সদস্যদের থেকেও তিন দিনে ঘটেছে এমন ধর্ষণ সংবাদের তথ্য চেয়ে সহায়তার অনুরোধ করে।
সদস্যদের দেওয়া তথ্য এবং রিউমর স্ক্যানার এর অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, ২১, ২২ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি—এই তিন দিনে মোট ৮টি ধর্ষণের ঘটনা এবং আরও একটি ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে, বাস্তবে আরও কিছু ঘটনা ঘটতে পারে, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি বা অনুসন্ধানে ধরা পড়েনি। তবে অনুসন্ধানে এর বাইরে আমরা চেষ্টা করেও আর কোনো সংবাদ পাইনি। এই পরিসংখ্যান থেকে আমরা উক্ত তিন দিনের ধর্ষণ সংক্রান্ত ঘটনার একটি ধারণা নিতে পারি। এই ধারণা থেকেও ‘৬৫ ঘণ্টায় ৭২ ধর্ষণ’ দাবিটি বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেই প্রতীয়মান হয়।
তাই ফেসবুকে ধর্ষণ নিয়ে প্রচারিত এসব পরিসংখ্যানের বেশিরভাগই নির্ভরযোগ্য নয় এবং ভুলভাবে তৈরি, যা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। ফলে, সামাজিক মাধ্যমে এমন ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়া অতিরিক্ত ভীতি ও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি করতে পারে।
তথ্যসূত্র
- রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ