নিজের দাড়িতেই পা পিছলে মৃত্যুর ঘটনায় প্রচারিত ব্যক্তির ভুল ছবি প্রচার

নিজের দাড়িতেই পা পিছলে মৃত্যু” শীর্ষক শিরোনামের কিছু তথ্য ও একটি ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।  

কী দাবি করা হচ্ছে? 

২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ডেইলি বাংলাদেশ’ এর ওয়েবসাইটে “নিজের নির্বুদ্ধিতার কারণে প্রাণ হারিয়েছেন যে ব্যক্তিরা” (আর্কাইভ) শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা দাড়ি বড় রাখতে পছন্দ করেন। সেসব ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন স্টেঞ্জার। দাড়ি লম্বা রাখা ছিল তার শখ। বেশ কয়েক বছর দাড়ি না কাটার ফলে তার দাড়ি দেড় মিটারেরও বেশি লম্বা হয়েছিল। তার দাড়ি এতোটাই লম্বা হয়েছিল যে, দাড়ি ভাঁজ করে তাকে পকেটে রাখতে হত। ১৫৬৭ সালে এই ব্যক্তি যে শহরে বাস করত সেখানে আগুন লেগে যায়। আর সিঁড়ি দিয়ে নামতে দিয়ে তার দাঁড়িয়েই পা বেঁধে পড়ে যান তিনি। ঘাড় ভেঙে সেখানেই মৃত্যু হয় তার।” 

প্রতিবেদনে স্টেঞ্জার নামক ব্যক্তিটির একটি ছবিও যুক্ত করা হয়েছে। 

একই দাবিতে ভারতীয় একটি ব্লগিং প্লাটফর্মে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন প্রহর ইন (আর্কাইভ)।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। 
আর্কাইভ ভার্সন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিজের দাড়িতেই পা পিছলে মৃত্যুর ঘটনায় প্রচারিত ছবির ব্যক্তিটি হান্স স্টেইনিঞ্জার নয় বরং উক্ত ব্যক্তির নাম হান্স নিলসন লাংসেথ। 

কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, ভারতীয় মিডিয়া হাউজ ‘STSTW MEDIA’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ৪ জুলাই “The Peculiar Tale of Hans Langseth and his Long Beard” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, নরওয়েতে জন্ম নেওয়া হান্স নিলসন লাংসেথের (Hans Nilsen Langseth) সবচেয়ে অত্যাশ্চর্য বৈশিষ্ট্য ছিল তার দাড়ি, যার কারণে তিনি গিনেসেও নাম লিখিয়েছিলেন। ১৭ ফুট ৬ ইঞ্চি লম্বা (৫.৩৩ মিটার) দাড়ির এই ব্যক্তিকে প্রায়ই হান্স স্টেইনিঞ্জার সাথে গুলিয়ে ফেলে বিভ্রান্তি তৈরি করতে দেখা যায়। 

স্টেইনিঞ্জার ১৫৬৭ সালের দিকে অস্ট্রিয়ার ব্রানাউ অ্যাম ইন নামে পরিচিত একটি ছোট্ট শহরের মেয়র ছিলেন। স্টেইনিঞ্জারেরও দীর্ঘ দাড়ি ছিল, লম্বায় সাড়ে চার ফুট। 

বলা হয়ে থাকে, এক অগ্নিকান্ডে নিজের দাড়িতে পা পিছলে সিঁড়ি থেকে নিচে পড়ে গিয়ে ঘাড় ভেঙে মৃত্যু হয় স্টেইনিঞ্জারের।

তবে কেউ কেউ দাবি করে থাকেন যে তিনি তার নিজের দাড়িতে নয়, বরং আগুনে পুড়েই মারা গিয়েছিলেন।

তাকে সমাধিস্থ করার আগে তার দাড়ি সংগ্রহ করে শহরের ঐতিহাসিক যাদুঘরে সংরক্ষণ করূ হয়েছিল। এটি ৪৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংরক্ষিত রয়েছে।

তবে বিভ্রান্তি শুরু হয় যখন কিছু ব্যক্তি হান্স নিলসন লাংসেথের ছবিকে হান্স স্টেইনিঞ্জার হিসাবে দাবি করতে শুরু করে। 

তবে এই দাবি সত্য হওয়া সম্ভব নয়। ‘STSTW MEDIA’ বলছে, প্রথম ক্যামেরাটি ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, হান্স স্টেইনিঞ্জারের ছবি তোলাও তখন স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব ছিল না। 

প্রতিবেদনে হান্স নিলসন লাংসেথের একটি ছবি যুক্ত করা হয়েছে, যার সাথে হান্স স্টেইনিঞ্জার দাবিতে প্রচারিত আলোচিত ছবিটির হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। 

ছবির ক্যাপশনে ফটোগ্রাফার হিসেবে Jorgenson, Nils C. নামে এক ব্যক্তির নাম রয়েছে। 

পরবর্তীতে এই নামের সূত্র ধরে প্রথমে ‘উইকিপিডিয়া কমন্স‘ এবং পরে মিডিয়া শেয়ারিং সাইট ‘Digital Horizons‘ এ মূল ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে মূল ছবির টাইটেল হিসেবে ‘হান্স নিলসন লাংসেথ’ এর নামই উল্লেখ পাওয়া যায়। 

তাছাড়া ইউরোপীয় টেলিভিশন সংবাদ নেটওয়ার্ক ‘euronews’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ২৫ জুন “World’s longest beard goes on display” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “হান্স নিলসন লাংসেথের বিশ্বের দীর্ঘতম দাড়ি যুক্তরাষ্ট্রে প্রদর্শিত হয়েছে।”

প্রতিবেদনে সংযুক্ত এ সংক্রান্ত একটি ভিডিওতে আলোচিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

এছাড়া, হান্স নিলসন লাংসেথের (HANS LANGSETH) নামে পরিচালিত ওয়েবসাইটেও উক্তি ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, ৬৬ বছর বয়সে তা এই ছবিটি তোলা হয়েছিল। অর্থাৎ, ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯১২ সালে (তার জন্ম ১৮৪৬ সালে)। 

মূলত, ১৫৬৭ সালের দিকে অস্ট্রিয়ার একটি ছোট্ট শহরের মেয়র হান্স স্টেইনিঞ্জার তার দীর্ঘ দাড়ির জন্য পরিচিত ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, একটি অগ্নিকান্ডে তার নিজের দাড়িতে পা পিছলে পড়ে গিয়ে তিনি মারা যান। ক্যামেরা আবিস্কার না হওয়ায় স্টেইনিঞ্জারের সে সময়কার কোনো ছবি পাওয়া যায় না। কিন্তু হান্স নিলসন লাংসেথ নামে আরেক দীর্ঘ দাড়ির অধিকারী এক ব্যক্তির ১৯১২ সালে তোলা একটি ছবিকে হান্স স্টেইনিঞ্জারের ছবি দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে, যা আংশিক মিথ্যা। 

উল্লেখ্য, ১৮১৬ সালে প্রথম ছবি তোলার ক্যামেরা আবিষ্কৃত হয়। 

প্রসঙ্গত, ঘন ঘন শেভ করলে দাড়ি গজানোর বিষয়ে পূর্বে ফ্যাক্টফাইল প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, নিজের দাড়িতেই পা পিছলে মৃত্যুর ঘটনার দাবিতে ভিন্ন ব্যক্তির ছবি প্রচার করা হচ্ছে; যা আংশিক মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img