সম্প্রতি, “উস্কানিমূলক পোশাক পরলে যৌন হয়রানির অভিযোগ আমলে নেবে না বাংলাদেশের আদালত” শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘নারী উস্কানিমূলক পোশাক পরলে তার করা যৌন হয়রানির অভিযোগ আমলে নেয়া হবে না’ শীর্ষক মন্তব্যটি বাংলাদেশের কোনো আদালতের নয় বরং উক্ত মন্তব্যটি ভারতের কেরালার এক আদালতের।
ফেসবুকে প্রকাশিত পোস্টগুলোর সূত্র ধরে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, দেশীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যম ‘চ্যানেল২৪‘ এর ওয়েবসাইটে গত ১৮ আগস্ট ‘উস্কানিমূলক পোশাক পরলে যৌন হয়রানির অভিযোগ আমলে নেবে না আদালত’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়াও উক্ত ঘটনাটি নিয়ে দেশীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যম ‘মানবজমিন‘ ও ‘ইনকিলাব‘ এর ওয়েবসাইট এবং মূলধারার অনলাইন পোর্টাল ‘বিডি মর্নিং’ ও ‘বিডি২৪রিপোর্ট’ এ প্রায় একই ধরণের শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। তবে সবগুলো প্রতিবেদন বিস্তারিত অংশেই এটি যে ভারতের আদালতের মন্তব্য সেটি উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী বিষয়টি যথাযথ যাচাই না করে শুধুমাত্র শিরোনামটি কপি-পেস্ট করে উক্ত মন্তব্যটি বাংলাদেশের আদালতের মন্তব্য দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করছেন।
এছাড়া, বাংলাদেশের অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারীরা শুধুমাত্র শিরোনামটি কপি-পেস্ট করে ফেসবুকে প্রচার করছেন। ফলে ঘটনাটি ভারতের হলেও ভারত শব্দটি উল্লেখ না করে বাংলাদেশে প্রচার করায় ঘটনাটি বাংলাদেশের কোনো স্থানের ভেবে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
পরবর্তীতে, আলোচিত ঘটনাটি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘সিএনএন’, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি, হিন্দুস্তান টাইমস, জি নিউজ ও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

মূলত, ২০২০ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ভারতের নন্দি সমুদ্র সৈকতে সমাজকর্মী ও লেখক সিভিক চন্দ্রনের বিরুদ্ধে এক যুবতী লেখিকাকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে। লেখিকার অভিযোগ সিভিক চন্দ্রন তাকে জোরপূর্বক একটি নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে যৌন হেনস্তা করেন। উক্ত বিষয়ে চলতি বছরের ২৯ শে জুলাই সিভিক চন্দ্রনের বিরুদ্ধে মামলা রেজিস্ট্রি করে পুলিশ।
সম্প্রতি উক্ত মামলার জামিন আবেদনের শুনানি চলাকালে ৭৪ বছর বয়সী সিভিক চন্দ্রন আদালতের সামনে অভিযোগকারীর কিছু ছবি উপস্থাপন করেন। উক্ত মামলায় সিভিকের জামিন অনুমোদন করে কেলারার কোজিকোড়ি সেশন আদালত রায় ‘রিজার্ভ’ রেখেই মামলার বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন।
আদালতের মতে, ওই নারী ‘যৌন উস্কানিমুলক পোশাক পরেছিলেন’। অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিন আবেদনের সঙ্গে যেসব ছবি উত্থাপন করেছেন সে অনুযায়ী অভিযোগকারী নিজেই পোশাক পরে নিজেকে ‘এক্সপোজ’ করেছেন। এগুলো যৌন উস্কানি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩৫৪ এ ধারা ব্যবহার করা যায় না।’
প্রসঙ্গত, গত ১৮ মে নরসিংদী রেলস্টেশনে পোশাকের কারণে এক তরুণীকে হেনস্তার অভিযোগে করা মামলায় গত ১৬ আগস্ট অভিযুক্ত মার্জিয়া আক্তারের (শিলা) জামিন শুনানি পরবর্তী সময়ে দেশীয় মূলধারার একাধিক গণমাধ্যম আসামি পক্ষের আইনজীবীর বরাত দিয়ে উক্ত মামলার বিষয়ে আদালতের বেশকিছু মন্তব্য প্রচার করে। গণমাধ্যমে প্রচারিত এমন কিছু সংবাদ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আসামি পক্ষের আইনজীবী দাবি করেছেন, ‘আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, গুলশান–বনানীর মতো এলাকায়ও কোনো মেয়ে এ ধরনের পোশাক পরে রাস্তায় বের হয় না। সেখানে গ্রামের মতো একটি জায়গায় পাবলিক প্লেসে এ রকম পোশাক পরা স্বাধীনতা হতে পারে না। যেমন খুশি তেমন পোশাকের নামে আমাদের সোসাইটির কালচারকে ধ্বংস করতে পারে না। ওই মেয়ে যে ধরনের পোশাক পরিহিত ছিল সেটা আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থার সঙ্গে বেমানান। যে কারণেই প্রতিবাদের শিকার হয়েছিল।’
গণমাধ্যমে উক্ত সংবাদ প্রচারের পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা শুরু হলে পরদিন ১৭ আগস্ট হাইকোর্ট বলেন, ‘আমরা (হাইকোর্ট) তো আদেশে পোশাক নিয়ে কিছুই লিখিনি, আমরা ভিডিও দেখে আইনজীবীদের কাছে শুধু জানতে চেয়েছি। ভিডিও দেখে রাষ্ট্রেপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছি, এমন ড্রেস পরে এমন গ্রাম এলাকায় যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ কিনা?’

গণমাধ্যমগুলোতে যেকোনো সংবাদকে চটকদার করে উপস্থাপন করার প্রবণতা লক্ষ্যনীয়। এ ঘটনাটিও তার ব্যতিক্রম নয়। ভারতের একটি ঘটনাকে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে যে যারা লিংকে গিয়ে মূল ঘটনা দেখবে না তারা সত্যিটাও জানবে না। এতেই ঘটনা নিয়ে পাঠক মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
উল্লেখ্য, রিউমর স্ক্যানার টিম পূর্বেও ভিনদেশের ঘটনাকে বাংলাদেশের ঘটনা সন্দেহে প্রচারিত তথ্যকে বিভ্রান্তিকর হিসেবে শনাক্ত করে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
অর্থাৎ, ‘নারী উস্কানিমূলক পোশাক পরলে তার করা যৌন হয়রানির অভিযোগ আমলে নেয়া হবে শীর্ষক’ ভারতের কেরালা আদালতের এক মন্তব্যকে বাংলাদেশের আদালতের মন্তব্য দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
চ্যানেল ২৪- ‘উস্কানিমূলক পোশাক পরলে যৌন হয়রানির অভিযোগ আমলে নেবে না আদালত’
মানবজমিন- ‘নারী উস্কানিমুলক পোশাক পরলে যৌন হয়রানির মামলা আমলে নেয়া হবে না’
ইনকিলাব- ‘উত্তেজক’ পোশাক পরলে যৌন হেনস্তা আমলযোগ্য নয়
বিডি মর্নিং- ‘নারী উস্কানিমুলক পোশাক পরলে যৌন হয়রানির মামলা আমলে নেয়া হবে না’
বিডি২৪রিপোর্ট- নারী উস্কানিমূলক পোশাক পরলে যৌন হয়রানির অভিযোগ আমলে নেবে না আদালত
CNN- Sexual assault accuser wore ‘provocative’ clothing, Indian judge rules
NDTV- If “Provocative Clothes”, Sex Harassment Charge Won’t Stand: Court
The Indian Express- Sexual harassment charge won’t stand if woman wore sexually provocative dresses: Kerala court
হিন্দুস্তান টাইমস- মহিলা উত্তেজক পোশাক পরলে যৌন হেনস্থা মামলা প্রাথমিকভাবে দাঁড়ায় না, বলছে কোর্টের পর্যবেক্ষণ
জি নিউজ- Kerala Court: উত্তেজক পোশাক পরলে মেয়েদের যৌন নিগ্রহের অভিযোগ তোলা অর্থহীন: আদালত
ডেইলি ক্যাম্পাস- গ্রামে এমন পোশাক পরা স্বাধীনতা হতে পারে না: হাইকোর্ট
ইনকিলাব- ‘যেমন খুশি তেমন পোশাক পরা স্বাধীনতা হতে পারে না’
আজকের পত্রিকা- নরসিংদী রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্তা: গ্রেপ্তার মার্জিয়ার হাইকোর্টে জামিন
ঢাকা টাইমস- নরসিংদী রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্তা: পোশাক নিয়ে যা বললেন হাইকোর্ট
বাংলা ট্রিবিউন- মামলার আদেশে পোশাক নিয়ে কিছুই লেখা হয়নি: হাইকোর্ট