বৃহস্পতিবার, অক্টোবর 3, 2024
spot_img

মৈথুনের দৃশ্য নয়, এটি সাপদের কম্ব্যাট ডান্সের ভিডিও

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দুইটি সাপের একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, ভিডিওটিতে “সাপেদের মৈথুন” প্রদর্শিত হচ্ছে। উক্ত দাবিটি কতিপয় মূলধারার গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয়েছে।

যমুনা টিভিতে উক্ত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন যমুনা টিভি (ফেসবুক)। 

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে গণমাধ্যমের ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে সাপেদের মৈথুন নয় বরং কম্ব্যাট ডান্স প্রদর্শিত হচ্ছে। সাধারণত নিকটবর্তী নারী সাপের সাথে কে মিলন করবে তা নির্ধারণ করতে এই কম্ব্যাট ডান্স বা যুদ্ধ নৃত্যটি হয়ে থাকে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে সাপটির গঠনগত বৈশিষ্ট্যের সাথে Indian Rat Snake বা দাঁড়াশ সাপের মিল পাওয়া যায়। মূলধারার সংবাদমাধ্যম দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধ অনুসারে, বাংলাদেশের এক অতিপরিচিত বিষহীন সাপ হচ্ছে দাঁড়াশ সাপ। হলুদ বাদামি বা হালকা বাদামি কিংবা জলপাই বাদামি বর্ণের সাপটি প্রায় তিন মিটার বা তার থেকেও বেশি লম্বা হতে পারে। সাধারণত এ সাপকে মানুষের আবাসস্থলের আশপাশে, চাষের জমি, বন-জঙ্গল বা ছোটো ঝোপঝাড়ে দেখতে পাওয়া যায়। তাছাড়া, দেশীয় সংবাদমাধ্যম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ফিচার বিভাগে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার ও বন্যপ্রাণী গবেষক আদনান আজাদের লেখা নিবন্ধতে সংযুক্ত দাঁড়াশ সাপের ছবির সাথেও আলোচিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত সাপের মিল পাওয়া যায়। 

Comparison : Rumor Scanner

অধিকতর নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার  যোগাযোগ করে সাপে কাটা বিষয়ে সতর্কতা, প্রকৃতি সংরক্ষণের মতো বিষয় নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের এইচআর অ্যান্ড রেস্কিউ কোর্ডিনেটর তাসবীন শাকীবের সাথে। তিনি সাপটি দাঁড়াশ বা Indian Rat Snake বলে নিশ্চিত করেন। 

সাপ ও সাপের উদ্ধার নিয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম Snake Rescue Team Bangladesh এর প্রেসিডেন্ট মোঃ রাজু আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনিও সাপটি দাঁড়াশ বলেই নিশ্চিত করেন।

দাঁড়াশ সাপ বা Indian Rat Snake এর এরকম কার্যকলাপের বিষয়ে অনুসন্ধান করলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি মেইলে ২০১৩ সালের ৩ মার্চ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায় যেখানে Rat Snake সাপের উল্লিখিত কার্যকলাপকালীন একাধিক ছবি পাওয়া যায়, যার সাথে আলোচিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত সাপের কার্যকলাপের মিল পাওয়া যায়৷ 

Comparison : Rumor Scanner

এই প্রতিবেদন জানা যায়, প্রদর্শিত ছবিতে নিজের এলাকা নির্ধারণ করতে ও সঙ্গীকে অপরের থেকে সরাতে রেট স্ন্যাক সাপ দুইটি একে অপরের সাথে লড়াই করছে৷ উক্ত লড়াইয়ে যে হারবে সে চলে যাবে এবং যে জিতবে সে নারী সাপের সাথে মিলিত হবে। উক্ত প্রজাতির সাপ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ইন্দো-চীন অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়। উক্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে, প্রদর্শিত কার্যকলাপকে অনেকেই ভুলবশত মৈথুন ভাবে কিন্তু প্রদর্শিত সাপ দুইটির মধ্যে দুইটিই পুরুষ সাপ।

বন্যজীবন ও প্রাকৃতিক ইতিহাস বিষয়ক বৈশ্বিক টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ওয়াইল্ড বা Nat Geo Wild এর ইউটিউব চ্যানেলেও Rat Snake জাতীয় সাপের একইরকম কার্যকলাপকালীন অবস্থায় ধারণকৃত একটি ভিডিও ২০১৮ সালে প্রকাশিত হতে দেখা যায়৷ ভিডিওটির বর্ণনায় বলা হয়, সাপদেরকে দেখে মনে হতে পারে তারা প্রজনন নৃত্য করছে। তবে আদতে এটি পুরুষ সাপদের মধ্যে যুদ্ধ বা Combat রীতি। 

Comparison : Rumor Scanner

বর্ণনায় বলা হয়, শ্রীলঙ্কায় ধারণকৃত এই ভিডিওটিতে তাদেরকে কোনো এক নারী সাপ ফেরোমন নিঃসরণ করে আকৃষ্ট করেছে। এরপর তারা লড়াই করে নির্ধারণ করছে সেই নারী সাপের সাথে কে মিলিত হবে। এটি অনেকটাই কুস্তির মতো। এখানে লক্ষ্য হলো প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারানো।

ফেরোমন সাপদের আকৃষ্ট করতে পারে এমন তথ্য একাধিক গবেষণাতেও পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র সরকার কর্তৃক পরিচালিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ মেডিক্যাল লাইব্রেরি National Library of Medicine এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল থেকে জানা যায়, Brown Tree Snake এর উপর ফেরোমনের প্রভাব দেখা যায়। গবেষণাটিতে উক্ত প্রজাতির সাপদের কম্ব্যাট রীতির ব্যাপারেও উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া, ১৬৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত পাবলিশিং হাউজ ব্রিলে প্রকাশিত একটি গবেষণার ফলাফল থেকে পুরুষ ইউরোপীয়ান হুইপ সাপের প্রতিও ফেরোমনের প্রভাব আছে সম্পর্কে জানা যায়। এক্ষেত্রে নারী সাপের নিঃসৃত ফেরোমন তাদের কাছে অগ্রাধিকার পেতে দেখা যায়।

বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্সে একইরকম কার্যকলাপকালীন সময়ে ধারণকৃত একটি ভিডিও সংযুক্তিসহ একটি প্রতিবেদন ২০১৭ সালের ২ জুন তারিখে প্রকাশ করা হয়। ভিডিওটিতে দুইটি বিষধর ব্ল্যাক ম্যাম্বা সাপকে অনুরূপভাবে লড়াই করতে দেখা যায়৷ লড়াইটি সম্পর্কে অ্যাডভোকেট ফর স্নেক প্রিজার্ভেশন (ASP) এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও ডিরেক্টর অফ এজুকেশন মেলিসা আমারেলো লাইভ সায়েন্সকে বলেন, লড়াইটি দেখে লাগছে দুইটি পুরুষ সাপ একটি নারীর জন্য এখানে লড়াই করছে। নারী সাপকে পেতে সাপ এমন লড়াই করে থাকে৷ আমারেলোর ধারণা, কাছে কোথাও একটি নারী ব্ল্যাক ম্যাম্বা সাপ রয়েছে। নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সাপ এরকম লড়াই করে থাকে। তাছাড়া একই প্রতিবেদনে আমারেলো বলেন, অনেকেই এই যুদ্ধ লড়াইকে নারী ও পুরুষ সাপের পাণিপ্রার্থনা ভেবে গুলিয়ে ফেলে।

অনেকটা একই রকম কার্যকলাপ করতে দেখা যায় রেটল স্ন্যাক জাতের সাপকেও। আমেরিকান ম্যাগাজিন নিউজউইকের ওয়েবসাইটে ২০২১ সালে এমন একটি কার্যকলাপকালীন দৃশ্য নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়৷ ভিডিওটি ধারণ করেছিলেন বায়োলজি গ্র্যাজুয়েট জাস্টিন হ্যারিস যা ভার্জিনিয়ার ডিপার্টমেন্ট অফ ওয়াইল্ডলাইফ রিসোর্সেসের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজেও প্রকাশিত হয়েছে। ভার্জিনিয়া ডিপার্টমেন্ট অফ ওয়াইল্ডলাইফ রিসোর্সেসের তথ্য মতে, ভিডিওটিতে পুরুষ সাপ দুইটিকে কম্ব্যাট ডান্সরত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। এরকম আচরণ করার কারণ হলো লড়াইয়ের জয়ী পুরুষ সাপ নিকটবর্তী নারী পুরুষ সাপের সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাবে। এই আচরণটি একাধিক জাতীয় সাপের মধ্যে দেখা যায়।

এ বিষয়ে নিউজ উইককে হ্যারিস বলেন, “নিকটবর্তী নারী সাপ ফেরোমন নিঃসৃত করে মিলনের জন্য পুরুষ সাপকে আকৃষ্ট করে থাকে।” এবং এজেন্সির মতে, “এই লড়াইয়ে জয়ী সাপটি নিকটবর্তী নারী সাপটির সাথে মিলিত হতে পারে।”

আলোচিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত সাপদের কার্যকলাপের বিষয়ে ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক কনজারভেশন ফাউন্ডেশনের এইচআর অ্যান্ড রেস্কিউ কোর্ডিনেটর তাসবীন শাকীব এবং স্ন্যাক রেস্কিউ টিম বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মোঃ রাজু আহমেদ রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন, আলোচিত ভিডিওটিতে মৈথুন নয় বরং কম্ব্যাট ডান্স প্রদর্শিত হয়েছে। তাসবীন শাকীব জানান, “ভিডিওতে যে সাপ দুইটি দেখা যাচ্ছে সেগুলো Indian Rat snake, বাংলায় বলা হয় দাঁড়াশ সাপ। এটা মেটিং বা মৈথুন না, কম্ব্যাট ড্যান্সের দৃশ্য। মূলত এই যুদ্ধের মাধ্যমে যে সাপ জয়ী হবে সে সেই এলাকায় থাকা স্ত্রী সাপের সাথে মিলন করবে। এখানে (ভিডিওটিতে) দু’টোই পুরুষ সাপ। সাধারণ মানুষের কাছে এটা “সাপের শঙ্খ লাগা” হিসেবে পরিচিত। এটাকে তারা সাপের মিলন মনে করে। সব সময় যে দুটো সাপের মধ্যে কম্ব্যাট ড্যান্স হবে এমনটাও না। অনেক সময় তিন থেকে চারটা সাপের মধ্যে এ যুদ্ধ হতে দেখা যায়। মূলত যখন মেটিং সিজন আসে তখন ওই এলাকার সব পুরুষ সাপ নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রমানের যুদ্ধে নেমে পরে, জয়ী হয় একজনই। সে একজন সে এলাকায় স্ত্রী সাপের সাথে মিলনের সুযোগ পায়। 

যে সাপ অধিক সময় নিজেকে উপরে রাখতে পারে সে বিজয়ী গণ্য হয়। কম্ব্যাট ড্যান্সের সময় সাপ একপ্রকার যুদ্ধে থাকে তাই সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়, অপরদিকে সাপের মিলন খুবই ধীর-স্থিরতার মধ্যে দিয়ে হয়। তাই খুব একটা মানুষের চোখে পড়ে না।”

রাজু আহমেদ জানান, “ভিডিওটিতে প্রদর্শিত কার্যকলাপটি মেটিং বা মৈথুন নয়৷ এটি কম্ব্যাট ডান্স। এটি মূলত এলাকায় আধিপত্য ও কে নারী সাপের সাথে মিলিত হবে তা ঠিক করতে করা হয়৷ এখানে সাপগুলো নিজের মাথা উঁচু করে রাখতে চায়। যে শেষ পর্যন্ত মাথা উঁচু করে রাখতে পারবে সে জয়ী হবে এবং ঐ এলাকার নারী সাপগুলোর সাথে মিলিত হওয়ার সুযোগ পাবে।”

কম্ব্যাট রীতি বা ডান্সে একটি সাপ তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাপের চেয়ে মাথা উঁচু করতে রাখতে চায় এমন তথ্য অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের অ্যাকাডেমিক রিসার্চ প্ল্যাটফর্ম অক্সফোর্ড অ্যাকাডেমিকে ২০১৫ সালের ১ আগস্ট তারিখে “Communication and Displays of Snakes” শিরোনামে প্রকাশিত জার্নাল আর্টিকেলেও পাওয়া যায়। জার্নাল আর্টিকেলটি মূলত ১৯৭৭ সালে আমেরিকান জুলজিস্টে প্রকাশিত হয়েছিল এবং লিখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ওকলাহোমার জুলজি বিভাগের চার্লস সি কার্পেন্টার। তাছাড়া, আলোচিত ভিডিওটিতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে সাপ দুইটি নিজেদের মাথা উঁচু করে রাখতে চাচ্ছে যা কার্যকলাপটি কম্ব্যাট ডান্সের পক্ষে সায় দেয়।

তাছাড়া, তাসবীন শাকীব দাঁড়াশ সাপের মিলনের দৃশ্যের একটি ভিডিও রিউমর স্ক্যানারকে সরবরাহ করেন এবং জানান যে মিলন শান্ত অবস্থায় হয়ে থাকে। উক্ত মিলনের দৃশ্যের সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত দৃশ্যের সুস্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

Comparison : Rumor Scanner

সুতরাং, সাপেদের মৈথুন দাবিতে প্রচারিত দাবিটি বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img