সম্প্রতি, আমেরিকার বোস্টনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন ফাঁসির আসামির উপর করা একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার ঘটনা সংক্রান্ত একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে প্রচার করা হচ্ছে। উক্ত পোস্টে দাবি করা হচ্ছে,
“আমেরিকার বোস্টনে ১৯৮৬ সালে একটি অদ্ভুত পরীক্ষা করা হয়৷ এক ফাঁসির আসামীকে ফাঁসির সাজা শোনানো হলো৷ কতিপয় বিজ্ঞানী সে আসামীর উপর একটি পরীক্ষা করার প্রস্তাব করলেন। কয়েদীকে শোনানো হলো ফাঁসির বদলে তোমাকে বিষাক্ত কোবরা সাপ দংশন করিয়ে হত্যা করা হবে।
কয়েদীকে চেয়ারে বসিয়ে তার হাত-পা বেঁধে দেয়া হলো, তারপর তার চোখে পট্টি বেঁধে বিষাক্ত কোবরা সাপ না এনে তার বদলে দুটি সেফ্টি পিন ফুটানো হলো। ফলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কয়েদির মৃত্যু হলো ৷ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে দেখা গেল সাপের বিষ রয়েছে তার শরীরের মধ্যে। প্রশ্ন হলো এই বিষ কোথা থেকে এলো, যা ঐ কয়েদীর প্রাণ কেড়ে নিল।
বলা হয়, সেই বিষ তার নিজের শরীর থেকেই উৎপন্ন হয়েছিল। আমাদের সংকল্প থেকে positive এবং negative এনার্জির সৃষ্টি হয়। আর সে এনার্জি আমাদের শরীরে হরমোন উৎপাদন করে ৷ ৭৫% রোগের মূল কারণ হলো আমাদের negative চিন্তাধারা। মানুষ নিজের চিন্তাধারা থেকে ভস্মাসূর হয়ে নিজ প্রজাতিকে বিনাশ করছে।
২৫ বছর বয়স পর্যন্ত আমরা ভাবি যে ‘মানুষ কি মনে করবে!’ ৫০ বছর আমরা ভয় পাই ‘মানুষ কি ভাববে!’ ৫০ বছর পরে আমরা বুঝতে পারি ‘কেউ আমার কথা চিন্তাই করেনি৷’ কিন্তু তখন তেমন কিছু করার থাকে না!আপনার চিন্তাধারা সর্বদা positive রাখুন এবং খুশী থাকুন।”

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
উক্ত পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আমেরিকার বোস্টন শহরে ১৯৮৬ সালে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামির উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানোর ঘটনাটি সত্য নয় বরং বহুকাল ধরে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ব্যতীতই উক্ত দাবিটি ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়ে আসছে।
এছাড়াও, ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া এই ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষেই ঘটেছিলো কিনা সে ব্যাপারে ঐতিহাসিকভাবে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। একইসাথে মানুষের শরীরে নিজে থেকে সাপের বিষ তৈরি হওয়ার ব্যাপারটিও পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক।
অনুসন্ধান
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি স্টেট বা রাজ্য রয়েছে যেখানে কয়েদিদের কোনো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়না। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম রাজ্য হচ্ছে ‘ম্যাসাচুসেটস’। আর বোস্টন হচ্ছে দাবিতে উল্লিখিত Massachusetts রাজ্যের প্রধান শহর।
FindLaw নামক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইন বিষয়ক ওয়েবসাইটের এই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে ১৯৮৪ সাল থেকে মৃত্যুদণ্ডকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ এই রাজ্যে কেউ ধরনের অপরাধ করলে তাকে অন্য কোনো কঠিন শাস্তি দেওয়া হলেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়না।

তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি ওয়েবসাইটেও Capital Punishment, 1984 শিরোনামের একটি আর্টিকেল পাওয়া যায় যেখানে ম্যাসাচুসেটস রাজ্য কর্তৃক আসামিদের মৃত্যুমৃত্যুদণ্ড আইন অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।

অর্থাৎ যেই রাজ্যে ১৯৮৪ সাল থেকে মৃত্যুদণ্ডের আইন প্রচলিত নয় সেখানে ১৯৮৬ সালে একজন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সাথে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালানোর দাবিটি ভিত্তিহীন।
শুধু তাই নয়, US Courts এর একটি অফিসিয়াল ডকুমেন্টস থেকে জানা যায়, ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে সর্বশেষ মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিলো ১৯৪৭ সালের মে মাসের ৯ তারিখে। ওইদিন Phillip Bellino এবং Edward Gertson নামক দুইজন আসামিকে শরীরে বিদ্যুতের শক দেওয়ার মাধ্যমে মৃত্যু কার্যকর করা হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, ম্যাসাচুসেটস রাজ্যে কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হতো ইলেট্রিক চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেয়ার মাধ্যমে; ফাঁসির মাধ্যমে নয়।

অর্থাৎ, ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের আইন অনুযায়ী যেখানে ১৯৮৪ সালের পর থেকে থেকে মৃত্যুদন্ড নিষিদ্ধ করা হয় এবং সর্বশেষ মৃত্যুদন্ডটিও ১৯৪৭ এ কার্যকর করা হয়।
মানুষের শরীরে কি নিজে থেকে ভেনম/ বিষ উৎপন্ন হতে পারে?
বিজ্ঞানভিত্তক ওয়েবসাইট লাইভ সায়েন্স এ “Could humans ever be venomous?” শীর্ষক শীর্ষক শিরোনামের একটি আর্টিকেল থেকে জানা যায়, “মানুষসহ সকল স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিষ গ্রন্থি তৈরি হতে পারে। গবেষকরা দেখতে পান স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দেহে থাকা হাউজ কিপিং নামক এক ধরনের জিন সরাসরি বিষ তৈরির সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেও এই জিনগুলোই বিষগ্রন্থির ভিত্তি তৈরী করে। আর এই জিনগুলো আমাদের লালাগ্রন্থিতেও রয়েছে।
গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল অনেকটা এরকম যে বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারায় বর্তমানে মানুষের দেহে নিজস্ব কোনো বিষগ্রন্থির দরকার না থাকলেও ভবিষ্যতে মানুষের দেহে বিষগ্রন্থি তৈরী হলেও হতে পারে। তবে এই সবকিছুই নির্ভর করবে মানুষের জীবনধারার উপর। মানুষের জীবনধারা, যদি আগের মতোই অব্যাহত থাকে তাহলে মানুষের দেহে বিষগ্রন্থি তৈরি না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি”। মূল গবেষণা পত্রটি দেখুন এখানে।
অর্থাৎ, সুদূর ভবিষ্যতে মানুষের মধ্যে বিষগ্রন্থি তৈরির সম্ভাবনা থাকলেও, এটি কেবলই সম্ভাবনা। তবে, “কোনো মানুষের শরীরে শুধুমাত্র সুচ ফোটানোর মাধ্যমে নিজে থেকেই যে হঠাৎ করে বিষ উৎপন্ন হতে পারে” এই ধরনের দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও, যদি ১৯৮৬ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামির সাথে সত্যিই কোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হতো আর মানুষে শরীরে নিজে থেকে সাপের বিষ তৈরী হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যেতো তাহলে সেই সময়ে উক্ত গবেষনা নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হতো এবং জার্নালে বিষয়টি নিয়ে রিসার্চ পেপার প্রকাশিত হতো। তবে অনুসন্ধানে সংবাদমাধ্যম সহ এমন কোনো নির্ভর যোগ্য তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি।
মূলত, বেশ কয়েকবছর ধরে কোনোরকম তথ্যসূত্র ছাড়াই ১৯৮৬ সালে বোস্টন শহরে একজন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামির সাথে হওয়া বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা সংক্রান্ত এই ঘটনাটি ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়ে আসছে। এই ঘটনার বাস্তবিক কোনো ভিত্তি নেই বরং এটি শুধুমাত্রই একটি মিথ।
উল্লেখ্য, ফাঁসির আসামি কে নিয়ে ভাইরাল ঘটনাটিকে Snopes, India Today সহ আরো বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন আখ্যায়িত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ফ্যাক্টচেকিং আর্টিকেলগুলো দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
প্রসঙ্গত, ইতোপূর্বে আন্তর্জাতিক বেশকিছু বিষয়ে ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “১৯৮৬ সালে বোস্টন শহরে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ফাঁসির আসামির শরীর সাপ মনে করে পিন ফোটানোর ফলে নিজে থেকেই সাপের বিষ তৈরি হয়েছে” শীর্ষক দাবি প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- FindLaw: The death penalty has been banned by Massachusetts courts since 1984.
- Bureau of Justice Statistics: Capital Punishment, 1984
- US Courts (.gov): PDF
- Live Science: Could humans ever be venomous?
- Research Papers: An ancient, conserved gene regulatory network led to the rise of oral venom systems.
- Rumor Scanner’s own analysis.