হত্যাকাণ্ডের শিকার সাইফুল ইসলাম চিন্ময়ের আইনজীবী ছিলেন না

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ ও বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ ব্রহ্মচারীকে (চন্দন কুমার ধর) চট্টগ্রাম নগরীর নিউমার্কেট মোড়ের স্বাধীনতা স্তম্ভে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে করা মামলায় গত ২৫ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গতকাল চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হলে জামিন নামঞ্জুর করেন আদালত। এর প্রেক্ষিতে আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে চিন্ময়কে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে তার অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান আটকে দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিক্ষোভকারীদের হটাতে পুলিশের সাথে যোগ দেন একদল আইনজীবীও। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম নামের এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এই ঘটনায় প্রকাশিত সংবাদে আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর বরাত দিয়ে দাবি করেছে, “আদালতের বাইরে (চট্টগ্রামে) বিক্ষোভের মধ্যে (চিন্ময়) দাসের পক্ষের একজন মুসলিম আইনজীবী নিহত হয়েছেন।”

ভারতসহ আন্তর্জাতিক একাধিক গণমাধ্যম রয়টার্সের বরাত দিয়ে একই দাবি প্রচার করেছে। দেখুন ভয়েস অফ আমেরিকা, আরব নিউজ, দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমস, ট্রিবিউন ইন্ডিয়া, লাইভ মিন্ট, দ্য ওয়্যার

রয়টার্সের বরাত ছাড়া একই দাবি করেছে ইন্ডিয়া টুডে (ইউটিউব), রিপাবলিক (এক্স), অপি ইন্ডিয়া (এক্স)। 

একই দাবিতে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনকে কেন্দ্র করে হামলায় নিহত সাইফুল ইসলাম চিন্ময়ের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন না বরং চিন্ময়ের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে লড়েছেন শুভাশীষ শর্মা। নিহত সাইফুল চট্টগ্রাম জেলা আদালতের একজন আইনজীবী ছিলেন। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, তিনি ইসকন বিরোধী একাধিক পোস্ট (, ) বিভিন্ন সময়ে শেয়ার করেছেন, যা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে তিনি ইসকনের অনুসারী কারো বিরুদ্ধে হওয়া মামলার আইনজীবী হবেন না। যদিও চিন্ময় বর্তমানে ইসকনের অফিশিয়াল কোনো দায়িত্বে নেই। বাংলাদেশে ইসকনের শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তিনিসহ আরও কয়েকজনকে গত জুলাই মাসে ইসকন থেকে বহিষ্কার করা হয়। 

আইনজীবী সাইফুলের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে আসে গতকাল (২৬ নভেম্বর) বিকেলে। এর আগে দুপুরে চিন্ময়ের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাটির শুনানি হয়। দুপুর দেড়টার কিছু আগে মূল ধারার অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক সংবাদ থেকে জানা যায়, চিন্ময় দাসের পক্ষে আইনজীবী শুভাশীষ শর্মা জামিন শুনানি করেন। চিন্ময়ের পক্ষের আরেকজন আইনজীবীর বিষয়েও উল্লেখ করেছে গণমাধ্যমটি। স্বরূপ কান্তি নাথ নামে এই ব্যক্তি বিডিনিউজকে বলেন, “এই মামলা ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূক। আমরা আজ জামিন আবেদন করেছি। শুনানি শেষে জামিন আবেদন নামঞ্জুর করা হয়।” 

মূল ধারার দুই গণমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোও চিন্ময়ের আইনজীবী হিসেবে স্বরূপ কান্তি নাথের বক্তব্য উল্লেখ করেছে। এসব এবং অন্য কোনো গণমাধ্যমে চিন্ময়ের পক্ষের আইনজীবী হিসেবে সাইফুল ইসলামের নাম উল্লেখ পাওয়া যায়নি। 

এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে এই মামলার ওকালত নামা সংগ্রহ করে রিউমর স্ক্যানার৷ এতে আসামীর পক্ষে আইনজীবী হিসেবে শুভাশীষ শর্মার নামই উল্লেখ পাওয়া যায়। 

Collage: Rumor Scanner 

অর্থাৎ, এটা নিশ্চিত যে, চিন্ময় দাসের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন না সাইফুল ইসলাম। 

চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এনামুল বলেন, সাইফুল ইসলাম আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালে জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য হন। পরে তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবেও নিবন্ধন পান। চট্টগ্রাম জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজিম উদ্দিন চৌধুরি জানান যে সাইফুল ইসলাম আলিফ এপিপি ছিলেন না। তিনি সাধারণভাবেই চট্টগ্রাম জেলা আদালতে আইন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। সাইফুল ইসলাম আলিফের বন্ধু উম্মুল হায়াত অপিও একই তথ্য দিয়েছেন।

এদিকে এই দাবি সংক্রান্ত রয়টার্সের প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর নেটিজেনদের সমালোচনার মুখে পড়ে সংস্থাটি। পরে প্রতিবেদন থেকে দাবির অংশটি সরিয়ে নেয় রয়টার্স। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ একটি বিবৃতি দিয়েছে। তারা বলছে, “রয়টার্স বা কোনো সাংবাদিক এই বিষয়ে উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) লিয়াকত আলী খানের সাথে কথা বলেননি। ঘটনার সময়ে তিনি আদালত প্রাঙ্গণসহ আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার কাজে দায়িত্বরত ছিলেন। লিয়াকত নামে চট্টগ্রামে চার জন কন্সটবল আছে। তারাও কাউকে কোনো বক্তব্য দেননি।” 

সুতরাং, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনকে কেন্দ্র করে হামলায় চট্টগ্রামে নিহত সাইফুল ইসলাম তার পক্ষের আইনজীবী ছিলেন শীর্ষক একটি দাবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র 

সংশোধন / Correction

২৮ নভেম্বর ২০২৪ : চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নন। তবে আমাদের প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট একজন আইনজীবীর বরাতে তাকে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর উল্লেখ করা হয়েছিল। নিহত সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম আদালতের একজন সাধারণ আইনজীবী। চট্টগ্রাম আদালতে সাইফুল ইসলাম চৌধুরি নামের আরেক ব্যক্তি সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত আছেন। প্রায় একই নামের আরেক ব্যক্তি এই পদে কর্মরত থাকায় বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্লাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের এক প্রতিবেদনের বদৌলতে বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় প্রতিবেদনটি সংশোধন করা হয়।

আরও পড়ুন

spot_img