চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গৃহবন্দীর দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি “গৃহবন্দি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং” এমন একটি দাবি সম্বলিত অসংখ্য পোস্ট ভারতীয় গণমাধ্যমের বরাতে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

কী দাবি করা হচ্ছে?  

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ABP LIVE এর ওয়েবসাইটে গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত Xi Jinping: গণহারে উড়ান বাতিল চিনে, গৃহবন্দি চিনপিং! সেনা-অভ্যুত্থান জল্পনা  শিরোনামের (আর্কাইভ) একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, “শোনা যাচ্ছে, দেশের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংকে (Xi Jinping) গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। চিনের সেনাবাহিনী, পিপলস লিবারেশন আর্মি (People’s Liberation Army) তাঁকে গৃহবন্দি করে রেখে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র।”

একই দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন – এই সময় (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে বাংলাদেশী গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রতিবেদন দেখুন – ভোরের কাগজ (আর্কাইভ), যায়যায়দিন (আর্কাইভ), দৈনিক বাংলা (আর্কাইভ), মাইটিভি (আর্কাইভ)।

একই দাবিতে ছড়িয়ে পড়া ফেসবুক পোস্ট দেখুন – এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন – এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গৃহবন্দী থাকার দাবিটি সঠিক নয় বরং গত ২৭ সেপ্টেম্বর তাকে জনসম্মুখে দেখা গেছে। 

কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম Al Jazeera এর ওয়েবসাইটে গত ২৭ সেপ্টেম্বর China’s Xi makes first public appearance after ‘coup’ rumours  শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের বরাতে বলা হয়, “চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বেইজিংয়ে একটি প্রদর্শনী পরিদর্শন করেছেন। চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এ কথা জানিয়েছে। সেপ্টেম্বরে মাঝামাঝি মধ্য এশিয়া সফর শেষে চীনে ফেরার পর এই প্রথম জনসমক্ষে এলেন তিনি। গৃহবন্দী হয়েছেন বলে ছড়িয়ে পড়া অসমর্থিত গুজবের মধ্যেই সি প্রকাশ্যে এলেন।”

Screenshot source : Al Jazeera

আল জাজিরার প্রতিবেদনে উল্লিখিত সূত্র ধরে চীনের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন CCTV এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত মূল প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে সংযুক্ত একটি ছবিতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট শি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে প্রদর্শনীটি ঘুরে দেখছেন।

Screenshot source : CCTV

একইদিন (২৭ সেপ্টেম্বর) চীনের আরেক রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা Xinhua এর ওয়েবসাইটেও একই প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদনে একই প্রদর্শনীতে প্রেসিডেন্ট শি’য়ের আরেকটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রদর্শনীতে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সাথে কিছুটা দূরত্বে অবস্থান করে কথা বলতে দেখা যায় মুখে মাস্ক পরিহিত থাকা শি’কে।

Screenshot source : Xinhua

সর্বশেষ কবে দেখা গিয়েছিল শি জিনপিং’কে?

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের শীর্ষনেতাদের বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে গত ১৪ সেপ্টেম্বর উজবেকিস্তানের সমরকন্দে যান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। বিগত প্রায় এক হাজার দিনের মধ্যে এটাই ছিল শি জিনপিং এর প্রথম বিদেশ সফর।

Screenshot source : Ministry of Foreign Affairs, the People’s Republic of China

সম্মেলন শেষে ১৬ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে চীনে ফিরে আসেন শি। এরপর আর জনসম্মুখে দেখা যায় নি ৬৯ বছর বয়সী শি’কে।

টুইটার থেকে ছড়িয়েছে গুজব? 

ভারতীয় একাধিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, New Highland Vision নামে একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি টুইট বার্তায় (আর্কাইভ) দাবি করা হয়, ১৬ সেপ্টেম্বর সমরকন্দ থেকে বেইজিং ফেরার পর বিমানবন্দরে গ্রেফতার করা হয় প্রেসিডেন্ট শি’কে। তবে সিনহুয়া প্রেসিডেন্ট শি বেইজিং ফেরার যে তথ্য দিয়েছে তাদের প্রতিবেদনে, সেখানে শি গ্রেফতার হওয়া বিষয়ক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

Screenshot source : news18

চীনা বংশোদ্ভূত মানবাধিকার কর্মী জেনিফার জেং টুইটারে গত ২৩ সেপ্টেম্বর একটি ভিডিও (আর্কাইভ) প্রকাশ করেন। ৫৫ সেকেন্ডের ভিডিওতে গাড়ি থেকে ধারণ করা রাস্তার দৃশ্য দেখানো হয়। ভিডিওতে পাশের রাস্তায় সেনাবাহিনীর বেশ কিছু গাড়িকে চলতে দেখা যায়। ভিডিওর ক্যাপশনে জেনিফার দাবি করেন, “পিএলএ সামরিক যানবাহন ২২ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ের দিকে। পুরো শোভাযাত্রা ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ এ সারি বেইজিংয়ের কাছে হুয়ানলাই কাউন্টি থেকে শুরু করে হেবেই প্রদেশের ঝাংজিয়াকু শহরে শেষ হয়েছে। এদিকে, গুজব রয়েছে যে সিসিপি (চীনা কমিউনিস্ট পার্টি) সিনিয়ররা শি জিনপিংকে পিএলএ-র প্রধান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।” এই ভিডিওর স্থান এবং তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য মেলেনি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। তবে ভারতীয় গণমাধ্যমে বলা হয়েছে, চীন ১ অক্টোবর তাদের জাতীয় দিবস পালন করে। সেই কারণেও সামরিক কুচরাওয়াজের জন্য সামরিক বাহনগুলোকে বেজিং-এর দিকে যেতে দেখা যেতে পারে।

উক্ত দুই টুইটের পরই ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে শি জিনপিংয়ের আটক হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়।

গণহারে বিমান বাতিল করেছে চীন?

বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেসবুক পোস্টগুলোর তথ্যমতে, সম্প্রতি চীনে অসংখ্য ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম tv9 bangla জানিয়েছে, পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২১ সেপ্টেম্বর প্রায় ৯ হাজার ৫৮৩টি বিমান বাতিল করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংখ্যাটিকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে গণমাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। মূলত, flightradar24 নামক একটি ওয়েবসাইট থেকে সংখ্যা বিষয়ক ঐ তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, “যদি কোনও ব্যবহারকারী তাদের সাইটে ফ্লাইট এরিয়া যথেষ্ট পরিমাণে জুম আউট করে, তবে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফোকাস না করা পর্যন্ত একটি এলাকায় ফ্লাইটের সংখ্যা আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্য দেখায়।” এটি না করায় বিভ্রান্তিকর তথ্য পেয়েছে মানুষ।

চীনের গেল কয়েক বছরের ফ্লাইটের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এটিকে অস্বাভাবিক মনে হবে না বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এপি (AP)। এক প্রতিবেদনে এপি বলেছে, ” কোভিড মহামারীর মধ্যে দেশটি যে উচ্চ বাতিলকরণের হার অনুভব করেছে তার সাথে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। হাজার হাজার ফ্লাইট এখনও নির্ধারিত হিসাবে চালু রয়েছে, এবং একাধিক বিশেষজ্ঞ এপি’কে বলেছেন যে চীনে গত সপ্তাহের ফ্লাইট বাতিলের ধরণ অস্বাভাবিক ছিল না।

মূলত, গত ১৬ সেপ্টেম্বর উজবেকিস্তান থেকে বেইজিং ফেরার পর আর জনসম্মুখে দেখা যায়নি চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে। এর সুযোগে টুইটারে ছড়িয়ে পড়ে, শি’কে বিমানবন্দরেই আটকের পর গৃহবন্দী করা হয়েছে। কোভিডের কারণে চীনে অসংখ্য ফ্লাইট বাতিল হওয়া এবং টুইটারে চীনা আর্মির গাড়ির বহরের ভিডিওয়ের তথ্য চীনে গণ-অভ্যুত্থানের দাবিকে জোরালো করে তোলে৷ কিন্তু গত ২৭ সেপ্টেম্বর বেইজিংয়ের এক প্রদর্শনীতে শি জিনপিং উপস্থিত হন। 

উল্লেখ্য, গত ২৫ সেপ্টেম্বর চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে দুই হাজার ৩০০ জনের নাম ছাপা হয়েছে, তাতে শিও আছেন। যা নিশ্চিত করছে, ৬৯ বছর বয়সী চীনের প্রেসিডেন্ট এখনও ক্ষমতায়, আছেন বহাল তবিয়তেই।

প্রসঙ্গত,  আগামী ১৬ অক্টোবর চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে। কংগ্রেসের মাধ্যমে শি জিনপিং তৃতীয় মেয়াদে আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশটির ক্ষমতায় আসতে যাচ্ছেন বলে আশা করা হচ্ছে।

সুতরাং, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গৃহবন্দী থাকার দাবিটি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img