জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের বিপক্ষে ভোট দেওয়া চেকিয়াকে চেচনিয়া বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ 

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গতকাল ১০ মে শুক্রবার ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্য পদের প্রস্তাব ব্যাপক সমর্থন নিয়ে পাস হয়েছে। এ নিয়ে ভোটাভুটিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৯৩টি সদস্যদেশের মধ্যে ১৪৩টি দেশ প্রস্তাবটির পক্ষে এবং ৯টি দেশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। বাকি ২৫টি দেশ কোনো পক্ষে ভোট না দিয়ে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।

ভোট
UN Photo : Results of the General Assembly’s vote on the resolution on the status of the Observer State of Palestine 

বিপক্ষে ভোট দেওয়া ৯টি দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল ছাড়াও আছে আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরি, মাইক্রোনেশিয়া,পালাউ, পাপুয়া নিউগিনি, নাউরু এবং চেকিয়া (চেক প্রজাতন্ত্র)।

বিপুল সমর্থন অর্জিত হওয়ায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হওয়ার যোগ্য বলে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে বিষয়টি ইতিবাচকভাবে পুনর্বিবেচনা করার সুপারিশ করেছে। এ নিয়ে জাতিসংঘের অফিশিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টের একটি পোস্টে লেখা হয়– “UN General Assembly determines that the State of Palestine is qualified and should be admitted as a member to the United Nations. UNGA further recommends that the Security Council reconsider the matter.”

বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ প্রাপ্তি বিপক্ষে ভোট দেওয়া ৯টি দেশের কথা উল্লেখ করার সময় দেশের কতিপয় গণমাধ্যম চেচনিয়া’র নাম উল্লেখ করেছে। 

চেক প্রজাতন্ত্রের পরিবর্তে চেচনিয়া উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করা গণমাধ্যমগুলোর মধ্যে রয়েছে যুগান্তর, আজকের পত্রিকা, ইনকিলাব, প্রতিদিনের সংবাদ, নিউজজি২৪, বাংলাদেশ জার্নাল, বাংলা নিউজ২৪, বিডি২৪লাইভ, অর্থসূচক, ফেস দ্যা পিপল, স্বদেশ প্রতিদিন এবং আপন দেশ

গণমাধ্যমের সংবাদ প্রকাশের পর ফেসবুকের বিভিন্ন পোস্টে ফিলিস্তিনের বিপক্ষে ভোট দেওয়া রাষ্ট্রগুলোর নামের তালিকায় চেচনিয়ার উল্লেখ দেখা গেছে। এসব পোস্টের কমেন্টে সূত্র হিসেবে উল্লেখিত গণমাধ্যমের লিংক দেওয়া হয়েছে। কিছু কমেন্টে চেচনিয়াকে সমালোচনাও করতে দেখা গেছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ফিলিস্তিনের বিপক্ষে ভোট দেওয়া ৯টি দেশের মধ্যে চেকিয়া (চেক প্রজাতন্ত্র) একটি। তবে চেচনিয়া এবং চেক প্রজাতন্ত্র এক নয় বরং সম্পূর্ণ দুটি ভিন্ন সত্তা(এনটিটি)। কতিপয় গণমাধ্যমে চেক প্রজাতন্ত্রকে ভুলভাবে চেচনিয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

চেক প্রজাতন্ত্র জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য এবং একটি সার্বভৌম দেশ; অপরদিকে চেচনিয়া সার্বভৌম নয় এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্যও নয়। তাই তাদের সাধারণ পরিষদে ভোট দেওয়ারও সুযোগ নেই। 

চেচনিয়া, যা আনুষ্ঠানিকভাবে চেচেন প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত হলো রাশিয়ার একটি প্রজাতন্ত্র। এটি উত্তর ককেশাসে পূর্ব ইউরোপের সর্বদক্ষিণ অংশে অবস্থিত। চেক প্রজাতন্ত্র থেকে এটি প্রায় ২ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত। 

Czechia and Checnya on Google map

অপরদিকে চেক প্রজাতন্ত্র মধ্য ইউরোপের একটি সার্বভৌম দেশ, যা চেকিয়া নামেও পরিচিত। ২০১৬ সালে চেক সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে চেক রিপাবলিক নামটি সংক্ষিপ্ত করে চেকিয়া ব্যবহার শুরু করে এবং এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটিকে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে প্রচার করার সুপারিশ করে। ফলে পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠান এটিকে চেকিয়া বলে উল্লেখ করা শুরু করে। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ‘জাতিসংঘে চেক প্রজাতন্ত্রের স্থায়ী মিশন ২০১৬ সালের ১৭ মে জাতিসংঘকে তাদের দেশের সংক্ষিপ্ত নাম ‘চেকিয়া’ ব্যবহারের জন্য জানায়।’ এরপর থেকে চেক রিপাবলিক এর পরিবর্তে জাতিসংঘে তাদের চেকিয়া নামটি ব্যবহার হয়।

Read More: ভিডিওটিতে দেখানো আগুন ও ধোঁয়া কবরের আযাবের দৃশ্যের নয়

আনুষ্ঠানিকভাবে সংক্ষিপ্ত নাম চেকিয়া ব্যবহার করা হলেও আন্তর্জাতিকভাবে এই নামটি এখনও পুরোপুরি সেভাবে পরিচিত লাভ করেনি। এর সম্ভাব্য একটি কারণ হতে পারে চেকিয়া খুব সহজেই ককেশাসের রাশিয়ান প্রজাতন্ত্র চেচনিয়ার নামের সাথে মিলে বিভ্রান্তি তৈরি করে। যেমনটা বাংলাদেশের উল্লেখিত সংবাদমাধ্যমেও দেখা গেছে। যদিও এক্ষেত্রে হয়তো একটি গণমাধ্যম তালিকায় Czechia বানান দেখে চেচনিয়া ধরে সংবাদ প্রকাশ করার পর অন্যরা তা কপি/অনুসরণ করে ভুল করে থাকতে পারে।

তবে চেকিয়া নাম প্রচলনের পূর্বেও চেক রিপাবলিক ও চেচনিয়া’র (চেচেন রিপাবলিক) নাম গুলিয়ে ফেলার উদাহরণ পাওয়া যায়। ২০১৩ সালে বোস্টন ম্যারাথনে বোমা হামলরা ঘটনায় সন্দেহভাজন(পরে অভিযুক্ত) সারনায়েভ ভাইরা ছিলেন জাতিগতভাবে চেচেন৷ চেচেন রিপাবলিক ও চেক রিপাবলিকের নামের কিছুটা মিলের কারণে অনলাইনে এ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় চেক রিপাবলিকের নামও বিভ্রান্তিকরভাবে জড়িয়ে যায়। বিষয়টা এমন অবস্থায় পৌছেছিল যে বিভ্রান্তি দূর করতে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চেক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূতকে ‘চেক প্রজাতন্ত্র ও চেচনিয়া দুটি একেবারে ভিন্ন সত্তা(entity)’ বলে সেসময় একটি অফিশিয়াল বিবৃতি প্রকাশ করতে হয়েছিল।  

অর্থাৎ, চেকিয়া এবং চেচনিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সত্তা/এনটিটি।

সুতরাং, চেক প্রজাতন্ত্র তথা চেকিয়া এবং চেচনিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি সত্তা। কতিপয় গণমাধ্যমে চেকিয়া কে চেচনিয়া হিসেবে উল্লেখ করায় সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে৷ তাই রিউমর স্ক্যানার উল্লেখিত গণমাধ্যমের এ ভুলটিকে বিভ্রান্তিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

তথ্যসূত্র

  1. UN NEWS & United Nations website 
  2. News of international media outlets
  3. 2013 statement of Czech Republic ambassador on name confusion  

হালনাগাদ/ Update

১২ মে, ২০২৪ : এই প্রতিবেদন প্রকাশ পরবর্তী সময়ে কতিপয় গণমাধ্যমের একই দাবি সম্বলিত সংবাদ আমাদের নজরে আসার প্রেক্ষিতে সেসব গণমাধ্যমকেও দাবি হিসেবে প্রতিবেদনে যুক্ত করা হলো।

আরও পড়ুন

spot_img