বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর স্ত্রী মিলিকে উদ্দেশ্য করে এই চিঠি লিখেননি

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি পেয়েছেন তাদের একজন তৎকালীন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট যুদ্ধ চলাকালেই পাকিস্তান বিমানবাহিনীর এই বাঙালি অফিসার একটি যুদ্ধবিমান নিয়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা করার সময় ওই বিমানে থাকা রশিদ মিনহাজ নামে পাকিস্তানী শিক্ষানবীশ পাইলটের সাথে ধস্তাধস্তির সময় বিমানটি বিধ্বস্ত হয় এবং দুজনই নিহত হন। মতিউর যেদিন নিহত হন সেই ২০ আগস্টই তিনি তাঁর স্ত্রী মিলি রহমানের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি লিখেছিলেন শীর্ষক একটি দাবি গেল কয়েক বছর ধরেই ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে৷ 

প্রিয়তমা মিলি সম্বোধনে শুরু করা দীর্ঘ চিঠিটির শুরুর অংশটি এমন, “একটা চুম্বন তোমার পাওনা রয়ে গেলো…সকালে প্যারেডে যাবার আগে তোমাকে চুমু খেয়ে বের না হলে আমার দিন ভালো যায় না। আজ তোমাকে চুমু খাওয়া হয় নি। আজকের দিনটা কেমন যাবে জানি না… এই চিঠি যখন তুমি পড়ছো, আমি তখন

তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে। ঠিক কতোটা দূরে আমি জানি না। মিলি, তোমার কি আমাদের বাসর রাতের কথা মনে আছে? কিছুই বুঝে উঠার আগে বিয়েটা হয়ে গেলো।…..”

মতিউর

চলতি বছর (২০২৪ সালে) উক্ত চিঠি মতিউর রহমানের লেখা দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

শুধু চলতি বছরই নয়, একই চিঠি গেল ১১ বছর ধরেই ফেসবুকে নিয়মিত প্রচার হয়ে আসছে। দেখুন ২০২৩, ২০২২, ২০২১, ২০২০, ২০১৯, ২০১৮, ২০১৭, ২০১৬, ২০১৫, ২০১৪, ২০১৩। 

একই চিঠি মতিউর রহমানের লেখা দাবিতে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত ইউটিউবের ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট স্ত্রী মিলি রহমানের উদ্দেশ্যে আলোচিত চিঠিটি লিখেননি বরং আরিফ মঈনুদ্দীন নামে এক ব্যক্তি ২০১৩ সালে কাল্পনিক এই চিঠিটি লিখেছিলেন যা পরবর্তীতে মতিউরের লেখা বাস্তব চিঠি হিসেবে প্রচার পেয়েছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে মূল ধারার অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ২৪ এর ওয়েবসাইটে ২০১৪ সালের ১৩ জুন ‘বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের নামে ভুয়া চিঠি ফেইসবুকে’ শীর্ষক শিরোনামের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম৷ এই প্রতিবেদনে সাংবাদিক মানস ঘোষের একটি ফেসবুক পোস্ট এবং রুদ্র সাইফুল নামে এক ব্যক্তির নেওয়া মিলি রহমানের সাক্ষাৎকারের বরাতে বলা হয়, আলোচিত চিঠিটি মতিউর রহমান লিখেননি৷ 

আমরা মানস ঘোষের করা ২০১৪ সালের ১১ জুন প্রকাশিত এ সংক্রান্ত ফেসবুক  পোস্টটি (আর্কাইভ) খুঁজে বের করেছি। জনাব ঘোষ জানাচ্ছেন, “মিলি রহমান জানালেন চিঠিটি মতিউর এর না। এটা একটা ভুয়া চিঠি। গত ২-৩ বছর ধরে তিনি এটা ফেইসবুকে দেখছেন, কিন্তু থামাতে পারছেন। মিলি রহমান চান এই মিথ্যে চিঠিটা ফেইসবুক থেকে মুছে যাক।”

Screenshot: Facebook 

এছাড়া, মুক্তিযু্দ্ধ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অনলাইন সংগ্রহশালা একাত্তরের প্রতিষ্ঠাতা জনাব রুদ্র সাইফুলের নেওয়া মিলি রহমানের সাক্ষাৎকারের ভিডিওটিও আমরা খুঁজে পেয়েছি একাত্তরের ফেসবুক পেজে (ekattor.org)। ২০১৪ সালের ১৩ জুন প্রকাশিত দুই মিনিটের কিছু বেশি সময় দৈর্ঘ্যের এই ভিডিওতে মিলি রহমানকে বলতে শোনা যায়, “চিঠিটা সম্পূর্ণ ভুয়া। আমি তার স্ত্রী মিলি রহমান। আমি জানি চিঠিটা কতখানি অসত্য।” 

মিলি জানান, “কিছু চিঠি যেটা আমাকে লেখা ছিল, সেটা যখন ঘটনা ঘটে। সেদিন ব্যক্তিগত সেই ফাইলটি সিল করে নিয়ে যায়। কাজেই সেই চিঠিগুলোর সবগুলোই পাকিস্তানে আটকা। আমার কাছে কিছুই নেই।”

চিঠিতে যে সময়ের (২০ আগস্ট, ১৯৭১) কথা বলা হয়েছে, তখন স্বামীর সঙ্গেই ছিলেন জানিয়ে মিলি রহমান বলেছেন, “একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে (ছিলাম)। চিঠি লেখার প্রশ্নই আসে না।”

চিঠিটি যে ভুয়া তা নিশ্চিত হওয়ার পর রিউমর স্ক্যানার টিম কথিত এই চিঠির সূত্রপাত খোঁজার সিদ্ধান্ত নেয়৷ এর প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর তৎকালীন চালু থাকা অনলাইন সংবাদমাধ্যম এটিএন টাইমস- এ একই চিঠি খুঁজে পাওয়া যায়৷ গণমাধ্যমটির এই সংবাদকেই চিঠিটির মূল সূত্রপাত দাবি করে পরের বছর (২০১৪) অন্তত দুইটি ফেসবুক পোস্ট (, ) নজরে এসেছে আমাদের। কিন্তু এটিএন টাইমস বা উক্ত সংবাদদাতা ওয়ালিউর রশিদ তমাল এই চিঠি বানাননি। 

আমাদের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই চিঠিটি ফেসবুকে প্রথম পোস্ট করা হয় এই সংবাদ প্রকাশের আরও প্রায় মাস দেড়েক আগে৷ সে বছরের (২০১৩) ০৯ নভেম্বর আরিফ মঈনুদ্দীন নামে এক ব্যক্তি এই চিঠিটি পোস্ট করেছিলেন। চিঠিটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট তিনি তার পোস্ট এডিট করে জানান, “চিঠিটি রূপক। কাল্পনিক অর্থে লেখা। কেউ বিভ্রান্ত না হবার অনুরোধ রইলো।” সে সময় তিনি কমেন্ট সেকশনেও একই তথ্য দেন। 

Screenshot collage: Rumor Scanner

আমরা এই বিষয়ে জনাব আরিফ মঈনুদ্দীনের সাথে কথা বলেছি। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলছিলেন, “(এটি) আমার লেখা। ২০১৩ সালে। যেহেতু প্রচন্ড প্রতিকূলতার মধ্যেও মতিউর দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন এবং সেটা নিজের স্ত্রীকেও জানতে দেন নি… সেক্ষেত্রে আমি এটা ভেবে দেখার চেষ্টা করেছিলাম, যদি সুযোগ হতো তাহলে প্রিয় স্ত্রী’কে মতিউর শেষ চিঠিতে কি লিখতেন। এটা একটা কাল্পনিক এবং রূপক চিঠি।” 

মূলত, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট স্ত্রী মিলি রহমানের উদ্দেশ্য করে দীর্ঘ একটি চিঠি লিখেছিলেন শীর্ষক একটি দাবি দীর্ঘদিন ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত চিঠিটি মতিউর রহমানের লেখা নয়৷ আরিফ মইনুদ্দীন নামে এক ব্যক্তি ২০১৩ সালে কাল্পনিক এই চিঠিটি লিখেছিলেন। পরবর্তীতে এটি মতিউর রহমানের বাস্তব চিঠি হিসেবে প্রচার পেয়েছে।

সুতরাং, ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট স্ত্রী মিলিকে উদ্দেশ্য করে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের লেখা চিঠি দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত চিঠিটি সম্পূর্ণ ভুয়া ও বানোয়াট।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img