মৌমাছি বিলুপ্ত হলে চার বছরের মধ্যে মানবসভ্যতা ধ্বংস হওয়ার দাবিটি মিথ্যা

মধু ও মৌমাছি যদি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হওয়া শুরু করে তবে ৪ বছরের মধ্যে সকল মানুষ মারা যাবে” শীর্ষক একটি তথ্য বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ‘আলবার্ট আইনস্টাইন’ এর উদ্ধৃতি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

মৌমাছি পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি পতঙ্গ। ফুলের পরাগায়নে মৌমাছির ভূমিকাও অনেক। কিন্তু মৌমাছি বিলুপ্ত হলে কি ফুলের পরাগায়নে বাধাগ্রস্ত হয়ে খাদ্য সংকটে ৪ বছরেই সকল মানুষের মৃত্যু হবে? আলবার্ট আইনস্টাইন কি সত্যিই এমনকিছু বলেছেন? চলুন জেনে আসি।

আলবার্ট আইনস্টাইন কি এমন কিছু বলেছেন?

বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বসে ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত Einstein And The Bees. Should You Worry? শীর্ষক শিরোনামের একটি সংবাদ পাওয়া যায়। উক্ত সংবাদ থেকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক Centre for Ecology & Hydrology‘র পরিবেশ বিজ্ঞানী Michel Pocoke‘র বরাতে জানা যায়, আইনস্টাইন মৌমাছির বিলুপ্তির ফলে মানুষও বিলুপ্ত হবে শীর্ষক কোনো বক্তব্য দেন নি।

Screenshot from forbes website

আন্তর্জাতিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ‘Snopes’ এর ২০০৮ সালের ২৪ জুন প্রকাশিত “Did Einstein Say Without Bees, Mankind Would Soon Perish?” শীর্ষক শিরোনামের আর্টিকেলে হতে জানা যায়, প্রথমত, আইনস্টাইনের বক্তব্য, গবেষণা পত্র, তাঁকে নিয়ে পত্রিকার সংবাদ ইত্যাদি পর্যালোচনা করে দেখা যায় উনি মৌমাছি ও মানুষের বিলুপ্ত হওয়া নিয়ে এমন কোনো বক্তব্য দেন নি।

দ্বিতীয়ত, আইনস্টাইন ১৯৫৫ সালে মৃত্যুবরন করলেও পুরোনো সংবাদের আর্কাইভ, ম্যাগাজিন, আর্টিকেলে এখন পর্যন্ত আইনস্টাইনের বক্তব্য দাবিতে প্রচারিত দাবিটির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি।

এছাড়াও আলবার্ট আইনস্টাইন ছিলেন একজন পদার্থবিদ। জীববিজ্ঞান বা উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে সাধারণত তাঁর বক্তব্য দেয়ার কথা না।

অর্থাৎ, মৌমাছি বিলুপ্তির সাথে মানুষেরও বিলুপ্ত হওয়া নিয়ে এরকম কোনো বক্তব্য আলবার্ট আইনস্টাইন দেন নি।

মৌমাছি বিলুপ্ত হলে কি আসলেই ৪ বছরের মধ্যে সকল মানুষ মারা যাবে?

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্সে ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট প্রকাশিত “Humans may face malnutrition if birds and bees disappear” শীর্ষক শিরোনামের একটি সংবাদ পাওয়া যায়। উক্ত সংবাদে বলা হয় : 

“If all the birds, bugs, bees and other creatures that pollinate our food crops were to disappear from the planet, humans could face a sharp increase in malnutrition, disease and death in many parts of the world, scientists estimate.”

অর্থাৎ, পরাগায়নের সাথে যুক্ত এরকম পাখি, পতঙ্গ এবং অন্যান্য প্রানীরা মারা গেলে পৃথিবীর মানুষ মারাত্নক অপুষ্টিতে ভুগতে পারে। এমনকি কিছু অঞ্চলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে। 

এখানে লক্ষনীয়, রয়টার্সের সংবাদে শুধুমাত্র মৌমাছি নয় বরং পরাগায়নের সাথে যুক্ত সকল পাখি, পতঙ্গ ও প্রানীর কথা বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ফোর্বসের ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত “Einstein And The Bees. Should You Worry?” শীর্ষক শিরোনামের একটি সংবাদে মৌমাছি বিশারদ Dr. Pocoke বলেন, ২৪০ এর অধিক প্রজাতির মধ্যে মৌমাছি হলো একটি প্রজাতি। এছাড়া মৌমাছি ছাড়াও আরো অনেক পাখি যেমন হামিংবার্ড, অন্যান্য পতঙ্গ যেমন প্রজাপতি এমনকি বাঁদুরও পরাগায়নকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ প্রানীজগতে মৌমাছি ছাড়াও আরো অসংখ্য প্রানী, পতঙ্গ ও পাখি আছে পরাগায়নের জন্য।

Screenshot from forbes website

সুতরাং, মৌমাছি বিলুপ্ত হলে পরাগায়নের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত সৃষ্টি হবে এবং ফল ও ফসল উৎপাদন কমে যাবে এটা সত্যি হলেও অন্যান্য নিয়ামক যেমন প্রজাপতি, ছোট পাখি, বাতাসের মাধ্যমে পরাগায়ন ইত্যাদির প্রভাবে উৎপাদন চলমান থাকবে।

মৌমাছি পরাগায়নের ক্ষেত্রে কতটুকু ভূমিকা রাখে?

American Institute of Bioscience এর ওয়েবসাইটে ২০০৬ সালের ১ এপ্রিল প্রকাশিত “The Economic Value of Ecological Services Provided by Insects” শীর্ষক শিরোনামের আর্টিকেলে Pollination by native insects নামক আনুচ্ছেদে দেখা যায়, পতঙ্গ পরাগায়নের মাধ্যমে আমেরিকার ১৫-৩০ শতাংশ শষ্যের ফলন হয়ে থাকে। টাকার অংকে যা ১.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে ৫.২ বিলিয়ন ডলার। শষ্য এবং টাকার অংকে এটি বেশ বড় একটি সংখ্যা হলেও মোট উৎপাদন ও অর্থের তুলনায় এটি তেমন কিছু নয়।

Screenshot from academic.oup website

ভারতীয় গণমাধ্যম India Today‘র ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই প্রকাশিত “Are bees capable of ending the human race?” শীর্ষক শিরোনামের একটি সংবাদ পাওয়া যায়। উক্ত সংবাদে মৌমাছি বিশ্বব্যাপী উৎপাদনের কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রাখে সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়।

উক্ত সংবাদের শেষ প্যারায় মৌমাছি বিলুপ্তির সাথে মানবসভ্যতা ধ্বংসের প্রশ্নে বিজ্ঞানীদের বরাত দিয়ে জানানো হয়, মৌমাছি বিলুপ্ত হলে পৃথিবী অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। তবে মানবসভ্যতা ধ্বংস হওয়ার দাবী করেননি বিজ্ঞানীরা।

Screenshot from indiatoday website

মূলত, পরিবেশ দূষণ, মৌচাক নষ্ট হয়ে যাওয়া, নিয়ম না মেনে মধু সংগ্রহ ইত্যাদি কারণে মৌমাছির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে থাকে। এ কারণে পরিবেশবিদরা মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে মৌমাছি বিলুপ্ত হলে মানবসভ্যতার জন্য হুমকিস্বরূপ বলে প্রচার করে। পরবর্তীতে কোনোপ্রকার তথ্যসূত্র ছাড়াই ভিত্তিহীনভাবে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের নামে মৌমাছি বিলুপ্ত হবার চার বছরের মধ্যে মানবসভ্যতা ধ্বংসের দাবিতে প্রচার হতে থাকে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

সুতরাং, মৌমাছি বিলুপ্ত হলে চার বছরের মধ্যে মানবসভ্যতা ধ্বংসের যে দাবিটি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচার করা তথ্যগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img