‘বাংলা ভাষাকে লন্ডনের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, শীর্ষক একটি দাবি গণমাধ্যমকে সূত্র উল্লেখ করে দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে।
২০১৯ সালে দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন প্রতিবেদন দেখুন; ডিবিসি নিউজ, ডেইলি বাংলাদেশ, ডেইলি বাংলাদেশ(ইংরেজি)।
একই বিষয়ে অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন
২০২৩- এখানে, এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে।
২০২২- এখানে, এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে।
২০২১- এখানে, এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে।
২০২০- এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে।
২০১৯- এখানে, এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে।
একই দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
এছাড়া একই বিষয়কে কেন্দ্র করে ‘লন্ডনে বাংলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষা’ দাবিতেও বেশ কিছু গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখুন; প্রতিদিনের সংবাদ
২০১৯ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন; ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা, ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা(রেডিও), যায়যায়দিন, সময় টিভি, আরটিভি, ইত্তেফাক, যুগান্তর, সময়ের আলো, একুশে টিভি, রাইজিং বিডি, বাংলা টিভি, ঢাকা টাইমস, জাগোনিউজ২৪, আমাদের সময়, পূর্ব-পশ্চিম বিডি, কালের কণ্ঠ, বাংলাদেশ জার্নাল, বাংলা ইনসাইডার, ইনকিলাব, দৈনিক আমাদের সময়, বাংলা২৪ লাইভ নিউজ, বিডি মর্নিং, জুম বাংলা, আমার সংবাদ এবং দৈনিক অধিকার।
একই বিষয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন এই সময়, জি নিউজ, ডেইলি হান্ট।
একই দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাকে লন্ডনের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি বরং একটি বেসরকারি দাতব্য সংস্থার ত্রুটিপূর্ণ ও প্রশ্নবিদ্ধ গবেষণার ফলাফলকে উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমের বরাতে দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে।
দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোতে দাবিটির পক্ষে ‘সিটি লিট’ নামক একটি সংস্থার সমীক্ষা ও এশিয়ান ভয়েস নামে একটি অনলাইন পোর্টালকে উদ্ধৃত করে দুইটি সূত্র খুঁজে পায় এবং দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে সূত্রগুলো যাচাই করে।
এর মধ্যে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে এশিয়ান ভয়েস নামের অনলাইন পোর্টালটিতে ২০১৯ সালের ২ ডিভেম্বর ‘Bengali announced as the second most spoken language in London‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটির শিরোনামে বলা হয়েছে, বাংলাকে লন্ডনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কথ্যভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে প্রতিবেদনটির বিস্তারিত অংশের শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘Bengali has been officially named as the second most-spoken language in London, followed by Polish and Turkish – with around 165,311 London residents speaking one of the three as their first language.’বাংলাকে লন্ডনের দ্বিতীয় ‘অফিসিয়াল ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় আছে পোলিশ ও তার্কিস ভাষাও৷ লন্ডনের ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩১১ জন বাসিন্দার প্রতি একজন এই তিন ভাষার কোনো একটিতে কথা বলেন।
তবে বাংলাকে কে ‘অফিসিয়াল ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে প্রতিবেদনটির এই অংশ থেকে উক্ত দাবির স্বপক্ষে কোনো প্রকার গ্রহণযোগ্য তথ্যসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়না।
এছাড়া প্রতিবেদনটির একটি অংশ থেকে জানা যায়, লন্ডনের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরতে এবং শহরটির বাসিন্দাদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াতে প্রাপ্তবয়স্ক লোকদেরকে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষাদানকারী দাতব্য সংস্থা সিটি লিট লন্ডনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বিদেশি ভাষা খুঁজে বের করতে গবেষণা চালায়।
এতে দেখা যায়, শহরটির বাসিন্দাদের মধ্যে ৭১ হাজার ৬০৯ জন বাসিন্দা বাংলাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। প্রতিবেদনটির এই অংশেও বাংলাকে ‘officially the second language’ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও ‘Official’ শব্দটির কোনো ব্যাখ্যা ও তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে আরও অনুসন্ধানে দাতব্য সংস্থা সিটি লিটের উক্ত গবেষণাটি খুঁজে বের করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
অনুসন্ধানে ওয়েবসাইটটিতে ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ‘QUIZ: HOW MANY OF THESE LANGUAGES DO YOU KNOW?‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তাদের গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী বাংলা ইংরেজি ভাষার পর লন্ডনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত দ্বিতীয় ভাষা। শহরটির ক্যামডেন, নিউহ্যাম ও টাওয়ার হ্যামলেটের ৭১ হাজার ৬০৯ জন বাসিন্দা বাংলায় কথা বলেন।
পাশাপাশি এই প্রতিবেদনটির কোথাও বাংলা ভাষাকে ‘অফিসিয়াল’ ভাষা হিসেবে উল্লেখ করেছে এমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ সিটি লিট তাদের প্রতিবেদনে বাংলা ভাষাকে ‘অফিসিয়াল’ ভাষা হিসেবে উল্লেখ না করলেও এশিয়ান ভয়েস তাদের সূত্রে বাংলাকে ‘অফিসিয়াল’ ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশি গণমাধ্যম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও সেই সময় নিজের ফেসবুক একাউন্টে পোস্ট করেন।
বিষয়টি নিয়ে সেই সময় কি বলেছিল লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন?
লন্ডনের হাই কমিশনের বক্তব্য খুঁজতে গিয়ে জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলে বাংলায় ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ‘ভুল খবর ছড়ালেন মোস্তাফা জব্বার‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৩ ডিসেম্বর মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। সেখানে লন্ডনে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলাকে সরকারিভাবে মর্যাদা পাওয়ার কথাও বলা হয়েছে৷
তবে খবরটির সত্যতা যাচাইয়ে ডয়চে ভেলে সেই সময় লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার আশিকুন্নবী চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি গণমাধ্যমটিকে জানান, ‘‘ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে হাইকমিশনকে এমন কিছু জানানো হয়নি৷’’
এছাড়া সিটি লিট নামের প্রতিষ্ঠানটির কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ‘‘সিটি লিট মূলত শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান৷ তাদের রিপোর্টটির অনেক তথ্যই সঠিক নয়৷ সরকারি হিসেবে লন্ডনে সাড়ে ৫ লাখের মতো সিলেটের মানুষ বসবাস করেন৷ তারা কোন ভাষায় কথা বলেন? এটা কয়েকবছর আগের হিসাব৷ নতুন হিসেবে সেখানে ‘বাংলাদেশি’ অনেক বেশি৷ এর বাইরে ভারতেরও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ সেখানে আছেন৷ ফলে যে প্রায় ৭২ হাজার মানুষের কথা বলা হচ্ছে, সেটা কিভাবে ঠিক হয়? আর স্বীকৃতি তো কাউকে না কাউকে দিতে হবে৷ লন্ডনের সরকারের তরফ থেকে এমন কোনো স্বীকৃতির খবর আমাদের হাইকমিশনে কেউ জানাননি৷’’
‘লন্ডনে বাংলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষা’ দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে যা জানা গেল
দাবিটির সত্যতা অনুসন্ধানে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ৬ ডিসেম্বর ‘‘বাংলা’ লন্ডনের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষা নয়‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, লন্ডনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে বাংলার অবস্থান দ্বিতীয় দাবিতে সিটি লিট যে গবেষণাটি করেছে তাতে অসঙ্গতি রয়েছে এবং সিটি লিট যে জরিপের ভিত্তিতে গবেষণাটি করেছে তা ৮ বছরের পুরানো।
প্রতিবেদনটিতে সিটি লিটের গবেষণার অসংগতি তুলে ধরে বলা হয়, সংস্থাটি শুধুমাত্র তিনটি স্থানে বাংলা ব্যবহারকারীদের সংখ্যা হিসেব করেছে৷
এই অঞ্চলগুলোতে ‘বাংলা’ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষা হলেও পুরো লন্ডনে বাংলা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষা নয়। লন্ডনের বিভিন্ন স্থানে বাংলা থেকে পোলিশ ভাষার ব্যবহার বেশি। এছাড়া সিটি লিট তালিকায় থাকা তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম অবস্থানে থাকা ভাষাগুলোর ব্যবহারকারীর সংখ্যা একত্রে যোগ করা হয়নি।
এছাড়া প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সিটি লিট ২০১৯ সালে যে সংস্থা অর্থাৎ অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকসের যে সরকারি জরিপের ভিত্তিতে এই গবেষণাটি করা করেছে, সেই জরিপটি আট বছরের পুরনো। এর মধ্যে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচ লাখের মতো। তাই ওই পুরনো জরিপের ভিত্তিতে বর্তমানে বাংলার অবস্থা কোথায় তা হয়তো সঠিক ধারণা নাও দিতে পারে।
মূলত, ২০১৯ সালে প্রাপ্তবয়স্ক লোকদেরকে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষাদানকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিটি লিট লন্ডনের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বিদেশি ভাষা খুঁজে বের করতে গবেষণা চালায়। এতে দেখা যায়, শহরটির বাসিন্দাদের মধ্যে ৭১ হাজার ৬০৯ জন বাসিন্দা বাংলাকে তাদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। এছাড়া সিটি লিট তাদের প্রতিবেদনে বাংলাকে ‘the second most common language spoken in London’ হিসেবে উল্লেখ করে। কিন্তু পরবর্তীতে এই তথ্যটিকেই ‘Bengali announced as the second most spoken language in London’ শীর্ষক শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে এশিয়ান ভয়েস নামের একটি অনলাইন পোর্টাল এবং তাদের সূত্রে বাংলাদেশি গণমাধ্যম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যে, বাংলা ভাষাকে লন্ডনের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্রিটিশ সরকার থেকে বাংলকে লন্ডনের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এছাড়া সিটি লিট ২০১৯ সালে যে জরিপের ভিত্তিতে তাদের গবেষণাটি করে সেটিও ৮ বছরের পুরানো জরিপের ভিত্তিতে করা হয়েছিল এবং উক্ত জরীপে লন্ডনের শুধুমাত্র তিনটি স্থানের বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের সংখ্যা হিসেব করা হয়েছে। অর্থাৎ সিটি লিটের উক্ত গবেষণাটি ছিল অগ্রহণযোগ্য এবং ত্রুটিপূর্ণ।
সুতরাং, বাংলা ভাষাকে লন্ডনের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।