গত ২১ সেপ্টেম্বর তারিখে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে প্রকাশ্যে আসেন ঢাবি ছাত্রশিবির শাখার সভাপতি সাদিক কায়েম। এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় আলোচনার ঝড়। তার দুদিন পেরোতে না পেরোতেই গত রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার হয় ঢাবি শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল এস এম ফরহাদের নাম। এস এম ফরহাদকে ঢাবি শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে পরবর্তীতে নিশ্চিত করে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো। এরই মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্রলীগের পদ ঘোষণার একটি বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে পড়েছে যেখানে এস এম ফরহাদকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে দেখা যাচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে মূলত গতকাল থেকে এস এম ফরহাদকে উদ্ধৃত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে, “সংগঠনের ১১ লক্ষ টাকা দিয়ে ছাত্রলীগের পদ কিনেছি নিজের ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের ভিত্তি মজবুত করার জন্য।” আজ এরই সাথে (উক্ত দাবিকে মূলত ক্যাপশনে উল্লেখ করে) এস এম ফরহাদকে উদ্ধৃত করে মূলধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির লোগো সম্বলিত একটি ফটোকার্ড প্রচার করা হচ্ছে। প্রচারিত ফটোকার্ডটিতে দাবি করা হচ্ছে, ঢাবি শিবির সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ জানিয়েছেন, “ফ্যাসিস্ট সরকারের কারণে আমরা ১৭ বছর প্রকাশ্য রাজনীতি করতে পারিনি। একারণে আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স বেছে নিতে হয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের দলে আমরা মিশে গিয়েছিলাম, এটি আমাদের দলীয় নির্দেশনা ছিলো। নিজেদের গোপন রাখতেই আমরা ছাত্রলীগের মিছিলে হেলমেট ব্যবহার করতাম। আমাদের কৌশল ওরা ধরতে পারেনি, যার কারণে আমরা বিজয় সুনিশ্চিত করতে পেরেছি।”
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
উক্ত একই প্রসঙ্গের দাবিতে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর লোগো সম্বলিত ফটোকার্ডও প্রচার করা হচ্ছে। উক্ত দাবিতে প্রথম আলোর লোগো সম্বলিত ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের কমিটিতে ঢাবি শিবির সেক্রেটারি জেনারেল এস এম ফরহাদের নাম থাকলেও ১১ লক্ষ টাকা দিয়ে ছাত্রলীগের পদ কেনার প্রসঙ্গে কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য এস এম ফরহাদ করেননি এবং পরিচয় গোপন রাখতে ছাত্রলীগের মিছিলে শিবির হেলমেট ব্যবহার করতো শীর্ষক মন্তব্যও ফরহাদ করেননি, বরং কোনোরকম নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই যমুনা টিভির ভিন্ন একটি ফটোকার্ড ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। তাছাড়া, উক্ত প্রসঙ্গের দাবিতে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর লোগো সম্বলিত প্রচারিত ফটোকার্ডটিও ভুয়া যা ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথম আলোর ফটোকার্ডের আদলে তৈরি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, রিউমর স্ক্যানার টিম ইতোমধ্যে যাচাই করে দেখেছে যে, “সংগঠনের ১১ লক্ষ টাকা দিয়ে ছাত্রলীগের পদ কিনেছি নিজের ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের ভিত্তি মজবুত করার জন্য।” শীর্ষক মন্তব্য ঢাবি শিবির সেক্রেটারি জেনারেল করেছেন মর্মে প্রচারিত দাবিটি মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। উক্ত দাবির বিষয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম ইতোমধ্যে একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
শিবির আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স বেছে নিয়ে নিজেদের গোপন রাখতে ছাত্রলীগের মিছিলে শিবির হেলমেট ব্যবহার করতো শীর্ষক মন্তব্য এস এম ফরহাদ করেছেন দাবিতে যে ফটোকার্ডটি প্রচার করা হচ্ছে, সেটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। প্রচারিত ফটোকার্ডটিতে মূলধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির লোগো এবং প্রকাশের তারিখ হিসেবে ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ লেখা উল্লেখ থাকতে দেখা যায়। এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে যমুনা টিভির ফেসবুক পেজ এবং ওয়েবসাইটে প্রচারিত দাবির সপক্ষে কোনো সংবাদ বা ফটোকার্ড প্রচারের প্রমাণ মেলেনি। তবে, উক্ত একইদিনে একই ডিজাইনের আদলে যমুনা টিভিকে এস এম ফরহাদকে উদ্ধৃত করে ভিন্ন একটি ফটোকার্ড প্রচার করতে দেখা যায়। যমুনা টিভির প্রচারিত ফটোকার্ডটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ফটোকার্ডটির তুলনা করলে দেখা যায়, ডিজাইন, এস এম ফরহাদের ব্যবহৃত ছবি, পদ এবং তারিখ হুবহু একই, কিন্তু এস এম ফরহাদকে উদ্ধৃত করে প্রচার করা উক্তিটি ভিন্ন।
আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ফটোকার্ডটিতে এস এম ফরহাদকে উদ্ধৃত করে লেখা উক্তিটি “ফ্যাসিস্ট সরকারের কারণে আমরা ১৭ বছর প্রকাশ্য রাজনীতি করতে পারিনি। একারণে আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স বেছে নিতে হয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের দলে আমরা মিশে গিয়েছিলাম, এটি আমাদের দলীয় নির্দেশনা ছিলো। নিজেদের গোপন রাখতেই আমরা ছাত্রলীগের মিছিলে হেলমেট ব্যবহার করতাম। আমাদের কৌশল ওরা ধরতে পারেনি, যার কারণে আমরা বিজয় সুনিশ্চিত করতে পেরেছি।” হলেও যমুনা টিভি কর্তৃক প্রচারিত আসল ফটোকার্ডটিতে এস এম ফরহাদকে উদ্ধৃত করে প্রচারিত উক্তিটি হলো “কবি জসীম উদ্দীন হল ও সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউট ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচি ও কার্যক্রমের সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ছাত্রলীগের কোনো পদ-পদবীর জন্য কখনো কাউকে সিভি দিইনি। কখনো ছাত্রলীগ হিসেবে কোনো মাধ্যমে পরিচয়ও দেইনি। হল বা ডিপার্টমেন্টের কমিটিতে কাকে রাখা হবে সেটা সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত।”
যমুনা টিভি কর্তৃক প্রকাশিত উক্ত ফটোকার্ডটির মন্তব্য সেকশনে দেওয়া লিঙ্ক থেকে এ বিষয়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত সংবাদ পড়লে জানা যায়, “ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদ দাবি করেছেন, কবি জসীমউদ্দীন হল ও সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউট ছাত্রলীগের কোনো কর্মসূচি ও কার্যক্রমের সাথে তার সম্পৃক্ততা নেই। ছাত্রলীগের কোনো পদ-পদবীর জন্য কখনও কাউকে সিভি দেননি। আর ছাত্রলীগ হিসেবে নিজেকে কোনো মাধ্যমে পরিচয়ও দেননি। হল বা ডিপার্টমেন্টের কমিটিতে কাকে রাখা হবে সেটা সংশ্লিষ্ট ছাত্রলীগের সিদ্ধান্ত।
সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিকেল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি (ফরহাদ) এই দাবি করেন। […] ঢাবির সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট ছাত্রলীগের কমিটিতে এস এম ফরহাদের নাম তার নতুন রাজনৈতিক পরিচয় সামনে আসার পর নানা আলোচনা তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে তার আরও একটি পরিচয় সামনে এসেছে। এস এম ফরহাদ ছাত্রলীগেরও পদধারী ছিলেন।”
অর্থাৎ, সম্প্রতি এস এম ফরহাদের নাম ঢাবি শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে প্রচারের পর ২০২২ সালের নভেম্বরে ঘোষিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদেও তার নাম সম্বলিত ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পুরনো একটি বিজ্ঞপ্তির ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সামনে আসলে তুমুল আলোচনা হচ্ছে৷ এরই প্রেক্ষিতে ফরহাদের দেওয়া বিবৃতিটি প্রতিবেদন এবং ফটোকার্ড আকারে প্রচার করেছে যমুনা টিভি। আর, যমুনা টিভির প্রচারিত উক্ত ফটোকার্ডটিকেই ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে এস এম ফরহাদ বলেছেন “ফ্যাসিস্ট সরকারের কারণে আমরা ১৭ বছর প্রকাশ্য রাজনীতি করতে পারিনি। একারণে আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স বেছে নিতে হয়েছিল। স্বৈরাচারী সরকারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের দলে আমরা মিশে গিয়েছিলাম, এটি আমাদের দলীয় নির্দেশনা ছিলো। নিজেদের গোপন রাখতেই আমরা ছাত্রলীগের মিছিলে হেলমেট ব্যবহার করতাম। আমাদের কৌশল ওরা ধরতে পারেনি, যার কারণে আমরা বিজয় সুনিশ্চিত করতে পেরেছি” শীর্ষক দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।
তাছাড়া, অধিকতর অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলেও শিবির আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স বেছে নিয়ে নিজেদের গোপন রেখে ছাত্রলীগের মিছিলে শিবির হেলমেট ব্যবহার করেছে শীর্ষক কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য এস এম ফরহাদ করেছেন মর্মে নির্ভরযোগ্য বা গণমাধ্যম সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
উক্ত প্রসঙ্গের দাবিতে প্রথম আলোর লোগো সম্বলিত ফটোকার্ডটিও পর্যবেক্ষণ করে দেখে রিউমর স্ক্যানার টিম। উক্ত ফটোকার্ডে প্রকাশের তারিখ হিসেবে আজকের তারিখ বা ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখ উল্লেখ করা হয়। অতঃপর প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ ও ওয়েবসাইট অনুসন্ধান করলে উক্ত দাবিতে কোনো প্রতিবেদন বা ফটোকার্ড খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং দেখা যায়, প্রথম আলোর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে আলোচিত ফটোকার্ডটি সম্পর্কে একটি পোস্ট করে জানানো হয়, প্রথম আলোর নামে প্রকাশিত উক্ত ফটোকার্ডটির তথ্য ও কার্ডটি ভুয়া। প্রথম আলো উক্ত ফটোকার্ডটি প্রকাশ করেনি। অর্থাৎ, প্রথম আলোর ডিজাইনের আদলে ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় উক্ত ফটোকার্ডটি তৈরি করে প্রচার করা হচ্ছে।
সুতরাং, শিবির আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্স বেছে নিয়ে নিজেদের গোপন রাখতে ছাত্রলীগের মিছিলে শিবির হেলমেট ব্যবহার করেছে শীর্ষক কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য এস এম ফরহাদ করেননি এবং উক্ত দাবিতে যমুনা টিভির লোগো সম্বলিত প্রচারিত ফটোকার্ডটি এডিটেড। এবং উক্ত প্রসঙ্গের দাবিতে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোর লোগো সম্বলিত প্রচারিত ফটোকার্ডটিও ভুয়া যা ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথম আলোর ফটোকার্ডের আদলে তৈরি করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
- Prothom Alo – এবার শিবিরের ঢাবি শাখার সেক্রেটারির পরিচয় জানা গেল, পদ ছিল ছাত্রলীগেও
- Jamuna Television – Facebook Post
- Jamuna TV – কোথাও ছাত্রলীগ পরিচয় দিইনি, পদ-পদবীর জন্য সিভি দিইনি: ঢাবি শিবির সেক্রেটারি
- Prothom Alo –Facebook Post
- Rumor Scanner’s own analysis