ভাইরাল ভিডিওটির ঘটনায় হিন্দু হওয়ায় কিংবা হিজাব না পরার অভিযোগে তাড়া করা বা মারা হয়নি

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটা ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, “ভয়াবহ!!! হিজাব না পরার জন্য ইসলামিক র‍্যাডিক্যাল বাংলাদেশের রাস্তায় হিন্দু মেয়েদের তাড়া করে ও হয়রানি করছে। এই ভাইরাল ভিডিওটি বিশ্বজুড়ে ইসলামপন্থীদের প্রশংসা পাচ্ছে। এই রোগ থেকে আপনার দেশকে বাঁচান!!!”

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

উক্ত দাবিটি Sheikh Haisna নামে ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহৃত ভেরিফাইড বা টিক চিহ্ন সম্বলিত একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকেও প্রচার করা হয়। এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। উল্লেখ্য যে, শেখ হাসিনার ছবি ব্যবহৃত হলেও অ্যাকাউন্টটির নাম শেখ হাসিনা নয় বরং শেখ হাইসনা এবং অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করলে বুঝা যায়, অ্যাকাউন্টটি একটি ফেক অ্যাকাউন্ট।

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি উক্ত এক্স অ্যাকাউন্টটিতে প্রচার করা দাবিটি ৬ হাজারেরও অধিক বার দেখা হয়েছে এবং শতাধিক বার রিটুইট বা কোট করা হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত ভিডিওটিতে প্রদর্শিত নারীদের হিন্দু হওয়া কিংবা হিজাব না পরার জন্য তাড়া করা হয়নি বরং, যৌনকর্মী অভিযোগে তাদের তাড়া করে মারধর করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রচারিত দাবিগুলোতে সংযুক্ত ভিডিওগুলোতে “Islamic Media TV” নামটি উল্লেখ পাওয়া যায়। অতঃপর, এরই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করলে গত ৩০ আগস্ট তারিখে “Islamic Media TV” নামের একটি ফেসবুক পেজে প্রচারিত পোস্টগুলোতে সংযুক্ত ভিডিওটির মূল ভিডিওটি পাওয়া যায়।

Comparison : Rumor Scanner

উক্ত ভিডিওটিতে এক পর্যায়ে লক্ষ্য করা যায়, উক্ত আক্রমণকারী ব্যক্তি একজন নারীকে বলে সে (ঐ নারী) চাকরি করে রোজগার করবে এমন প্রতিশ্রুতি জানাতে। এমনকি এক পর্যায়ে উক্ত আক্রমণকারীকে কোথাও আসার কথা বলে বলতে শোনা যায়, “তোদের মতো ৫০০ পোলাপানকে চাকরি দিমু/দিবো”। যা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করে উক্ত নারীদেরকে মূলত তাদের পেশাগত কারণসংক্রান্ত বিষয় নিয়েই আক্রমণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্টচেক এডিটর কদরউদ্দিন শিশিরের ০২ সেপ্টেম্বর তারিখের একটি ফেসবুক পোস্ট পাওয়া যায়। উক্ত ফেসবুক পোস্টে আলোচিত ভিডিওটির একাধিক স্ক্রিনশটের কোলাজ সংযুক্ত করে ক্যাপশনে লেখা হয়, “”যৌনকর্মী, শিশু পাচারকারী” অভিযোগ দিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা নারীদেরকে লাঠি দিয়ে (সম্ভবত স্টিলের পাইপ) সাপের মতো পেটাচ্ছে। ওইসব নারীরা দৌড়ে জান বাঁচাতে পারছেন না। রাস্তায় পড়ে গেছেন এক নারী। এরপরও পেটাচ্ছে তাকে। তিনি পায়ে ধরে মাফ চাচ্ছেন।

ঢাকার শ্যামলীতে এমন ঘটনা অন্তত দুইদিন (তার ফেসবুকে অন্তত দুইটি ভিডিও পোস্ট করেছে) ঘটিয়েছে এবং সেসবের ভিডিও রেকর্ড করে ফেসবুকে পোস্ট করেছে। এই ব্যক্তির নাম HM Rasel Sultan […] হামলার বিষয়ে সে ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছে, তার এই অভিযান ‘পতিতাদের উচ্ছেদের’ জন্য। অন্যদেরকেও এমনভাবে উচ্ছেদের নেমে পড়ার আহ্বান জানাচ্ছে।…”

এ থেকে জানা যায়, উক্ত আক্রমণকারী মূলত যৌনকর্মী অভিযোগে আক্রমণ করেছিল এবং সে উক্ত পেশার পরিবর্তে কোনো চাকরি করার নির্দেশ দেয়। 

এরই সূত্র ধরে অধিকতর অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, আলোচিত এইচএম সুলতান তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ৫ সেপ্টেম্বর তারিখে কদরউদ্দিন শিশিরের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একাধিক স্ক্রিনশট নিয়ে পোস্ট করে এবং মন্তব্য সেকশনে শিশিরকে “দেহ ব্যবসায়ীদের দালাল” আখ্যা দেয়৷ 

Screenshot : Facebook

তার (আক্রমণকারী রাসেল সুলতান) ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তার আরো দুইটি লাইভ বা সরাসরি প্রচারিত ভিডিও পাওয়া যায় যেখানে সে জানায় “প্রকাশ্যে দেহব্যবসা চলবে না” এবং “আজকে আমি পতিতাকে পিটাইছি”। যা অধিকতর নিশ্চিত করে উক্ত আক্রমণকারী রাসেল সুলতান হিন্দু বা হিজাব না পরার কারণে আক্রমণ করেনি বরং মূলত যৌনকর্মী হওয়ার অভিযোগে আক্রমণ করেছিল।

তাছাড়া, উক্ত মারধরের স্ক্রিনশটসহ মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলোতে গত ১ সেপ্টেম্বর তারিখে “রাজধানীতে ভাসমান যৌনকর্মীদের মারধর” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়, “ঢাকার ভাসমান যৌনকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় তাঁদের মারপিট করছেন কিছু যুবক। এমন মারপিটের কিছু ভিডিও ফেসবুকে শেয়ার করা হচ্ছে। তিনটি ভিডিওতে দেখা যায়, রাস্তায় যৌনকর্মীদের পেটাচ্ছেন যুবকেরা। ‘এইভাবে উচ্ছেদ করতে হবে পতিতাদের। এক গ্রুপকে মারছি, আরেক গ্রুপ আসছে।’ নিজের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক যুবকের এমন একটি ভিডিও শুরু হয় এই কথাগুলো বলে। যুবকের মুখে মাস্ক পরা ছিল। এবার মাস্ক খুলে নিয়ে কথাগুলো  বলেন ‘এইচ এম রাসেল সুলতান (এটুকু ইংরেজিতে লেখা) (দোকানি রাসেল)’ নামের যুবকটি।” উল্লেখ্য, প্রথম আলোতে সংযুক্ত স্ক্রিনশটটিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির ফেসবুক অ্যাকাউন্টের নাম “HM Rasel Sultan” এর নাম উল্লেখ থাকতে দেখা যায়।

এছাড়া, উক্ত ঘটনার বিষয়ে বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যম যায় যায় দিন এবং আজকের পত্রিকাতেও সংবাদ প্রচার করা হয়। উক্ত প্রতিবেদনগুলোতেও যৌনকর্মীদের মারধর করা হচ্ছিল মর্মে সংবাদ প্রচার করা হয়।

সুতরাং, আলোচিত ভিডিওটিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা হিজাব না পরার কারণে নারীদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে শীর্ষক দাবিটি বিভ্রান্তিকর। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img