করোনাভাইরাস সংক্রমণের পাঁচ বছর পর চীনের উত্তরাঞ্চলে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। প্রতিবেশী ভারতসহ আশপাশের দেশগুলোতে ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশেও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে “বাংলাদেশে প্রথম এইচএমপিভি রোগী শনাক্ত” শীর্ষক দাবিতে একটি খবর গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, বাংলা ভিশন (ফেসবুক), সারাবাংলা এবং একাত্তর টিভি (ইউটিউব)।
এছাড়া, শিরোনামে প্রথম উল্লেখ করে বিস্তারিত অংশে নতুন নয় জানিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এবং কালবেলা।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)৷
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে এইচএমপিভি ভাইরাস ২০২৫ সালে প্রথমবার শনাক্ত হয়নি। গবেষণা ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী, অন্তত ২০০১ সাল থেকে এ ভাইরাস দেশে বিদ্যমান এবং সময় সময় এর সংক্রমণ শনাক্ত হয়ে আসছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে গত ০৮ জানুয়ারি প্রকাশিত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার অনলাইন পোর্টালের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন জানান, ২০১৭ সালে এইচএমপিভি প্রথম শনাক্ত হয় বাংলাদেশে। এরপর কমবেশি প্রতিবছরই শনাক্ত হয়ে আসছে। এ পর্যন্ত অনেকের শরীরে ভাইরাসটি শনাক্ত হলেও জটিলতার ইতিহাস নেই।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্টের মাধ্যমে জানান, বাংলাদেশে এক গবেষণায় আগস্ট ২০১৪ হতে জুলাই ২০১৫ পর্যন্ত সময়কালে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২০০ জন নিউমোনিয়ার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর নাসোফ্যারিনজিয়াল সোয়াব (নাক ও গলার সংযোগস্থল থেকে সংগৃহীত নমুনা) পরীক্ষা করে ২৬ জনের শরীরে হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) পাওয়া গিয়েছিল। ডা. নুসরাত গবেষণাটির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন এবং এটি আন্তর্জাতিক জার্নাল Plos one-এ প্রকাশিত হয়েছিল৷ তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে এইচএমপিভি একটি মৌসুমী ভাইরাস, তাই তিনি আতঙ্কিত না হয়ে সাবধান হতে আহ্বান জানান৷

ডা. নুসরাত সুলতানার পোস্টের তথ্যসূত্র অনুযায়ী, Plos One ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘Bacterial and viral pathogen spectra of acute respiratory infections in under-5 children in hospital settings in Dhaka city’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত প্রবন্ধে পাঁচ বছরের কম বয়সী নিউমোনিয়ার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি ২০০ জন রোগীর নাসোফ্যারিনজিয়াল সোয়াব পরীক্ষা করে ২৬ জনের (১৩%) শরীরে হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) শনাক্ত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গবেষণা প্রবন্ধটি ২০১৭ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশিত হয়।

এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ওয়েবসাইট, ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত ‘Human Metapneumovirus Infection among Children, Bangladesh’ শিরোনামের একটি গবেষণা প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, ২০০০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকার কামালাপুরে ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে সিরোলজিক্যাল বিশ্লেষণ চালিয়ে হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) শনাক্ত করা হয়। গবেষণায় ২০ জন শিশুর এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছিল।

বাংলানিউজ২৪-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, এইচএমপিভি ভাইরাস প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কের কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশে ২০০০-২০০১ সালে প্রথম এইচএমপিভি ভাইরাস শনাক্ত হয়। আমেরিকার জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ডব্লিউ এ ব্রুক্সের নেতৃত্বে ইউএসএর ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের অর্থায়নে আইসিডিডিআরবির সহযোগিতায় ঢাকার কমলাপুরে একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। সেখানে ১৩ বছরের কম শ্বাসতন্ত্রীয় রোগীর দেহে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ এইচএমপিভি ভাইরাস পাওয়া যায়। ২০১৪-২০১৬ সালে আরেকটি গবেষণায় ঢাকায় এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। আমাদের ধারণা প্রতি বছরই শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাসটির ভূমিকা রয়েছে। এই দেশে এইচএমপিভি ভাইরাস একটি সাধারণ নৈমিত্তিক রোগ। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর ন্যূনতম কোনো কারণ নেই।
উপরিউক্ত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট যে, সাম্প্রতিক সময়ে নয় বরং অন্তত ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়ে আসছে।
সুতরাং, চলতি বছরে শনাক্ত এইচএমপিভি ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী বাংলাদেশে প্রথম আক্রান্ত ও শনাক্ত হওয়ার দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা – এইচএমপিভি ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই: আইইডিসিআর
- Nusrat Sultana Leema – Facebook Post
- Plos One – Bacterial and viral pathogen spectra of acute respiratory infections in under-5 children in hospital settings in Dhaka city
- National Library of Medicine – Human Metapneumovirus Infection among Children, Bangladesh
- Banglanews24 – এইচএমপিভি ভাইরাস: দেশে দুই যুগ ধরে আছে, আতঙ্ক নেই