ইরানে হিজাবের বাধ্যবাধকতা বাতিল হয়নি 

সম্প্রতি ‘ইরান হিজাব পরার আইনি বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছে। এখন হিজাব পরবে কি পরবে না — সেটা সম্পূর্ণই নারীদের নিজের ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে, কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা আর নেই…..এ সংবাদে ইরানের স্বাধীনচেতা নারীরা রাস্তায় নেমে সম্মিলিতভাবে হিজাব পুড়িয়ে আনন্দ উদযাপন করছে।’ ক্যাপশনে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে বিভিন্ন প্লাটফর্মে প্রচার করা হয়েছে। 

প্রচারিত ভিডিওটিতে দেখা যায়, আগুনের সামনে সাদা পোশাক পরিহিত এক নারী নাচতে নাচতে একটি কাপড় আগুনে ছুঁড়ে ফেলে ভিড়ের মধ্যে মিশে যান। তার দেখাদেখি কালো পোশাক পরিহিত দুজন নারী এগিয়ে এসে আগুনে কাপড় ফেলছেন। এসময় ঘিরে থাকা জমায়েতকে হাততালি দিয়ে উদযাপন করতে দেখা যায়।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)৷

উক্ত দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি ইরানে হিজাব আইন বাতিল উদযাপনের দৃশ্য নয় এবং ইরানে বাধ্যতামূলক হিজাব সংক্রান্ত আইনগুলো তুলে নেওয়ার মতো কোনো ঘটনাও ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে, ২০২২ সালে ইরানে অনুপযুক্ত পোশাক পরার অভিযোগে গ্রেফতার মাশা আমিনির দেশটির নৈতিকতা পুলিশের হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভের ভিডিওকে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম Voice of America এর ইউটিউব চ্যানেলে ২০২২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘Woman Throws Hijab in Fire as Protests Spread in Iran’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওর সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির সাদৃশ্য রয়েছে। 

Comparison: Rumor Scanner 

উক্ত ভিডিওটির বিবরণী থেকে জানা যায়, ইরানের সারি শহরের রাস্তায় এক নারী তার হিজাব আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন। কঠোর পোশাকবিধি কার্যকর করার দায়িত্বে থাকা নৈতিকতা পুলিশ কর্তৃক এক তরুণী গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার মৃত্যুতে দেশজুড়ে প্রতিবাদ আন্দোলন জোরদার হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, ২২ বছর বয়সী মাসা আমিনি “অনুপযুক্ত পোশাক” পরার অভিযোগে তেহরানে গ্রেপ্তার হওয়ার পর হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা গেলে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।

এ বিষয়ে The New Arab এর ইউটিউব চ্যানেলে ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ‘Women in Iran lead protests after death of Mahsa Amini’ শিরোনামে প্রকাশিত ভিডিও প্রতিবেদন থেকেও একই তথ্য জানা যায়। 

অর্থাৎ, প্রচারিত ভিডিওর ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়। 

ইরানে বাধ্যতামূলক হিজাব সংক্রান্ত আইনগুলো তুলে নেওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধানে দেশটির গণমাধ্যম ইরান ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে গত ০৭ অক্টোবর ‘Conservatives clash over hijab law as Tehran streets move on’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির প্রজাতন্ত্রের স্বার্থ-নির্ধারণী পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ রেজা বাহোনার রিপোর্টারদের বলেন “সরকার ব্যবস্থার সাধারণ সিদ্ধান্ত হলো, কোনো বাধ্যতামূলক হিজাব আইন বলবৎ নেই।” এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় দেশটির রক্ষণশীলরা প্রতিবাদও জানান।

এ বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে IRIB Ofogh এর ওয়েবসাইটে মোহাম্মদ রেজা বাহোনারের আরেকটি সাক্ষাৎকার খুঁজে পাওয়া যায়। 

‘বাহনার হিজাব সম্পর্কে তার অবস্থান সংশোধন করেছেন/আমি খারাপভাবে প্রকাশ করেছি!’ শিরোনামের উক্ত সাক্ষাৎকারে রেজা বাহোনারকে বলতে শোনা যায়, “উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ বলতে চায়, আমাদের পবিত্র শরিয়ায় হিজাব একটি অপ্রয়োজনীয় বিষয় অথবা এর গুরুত্ব একটু কমানো দরকার বা অন্য কোনোভাবে পরিবর্তন আনা দরকার— না। এটি স্পষ্টতই আমার বক্তব্য নয়। আমি আমার বক্তব্যটি পুনরায় বলছি, আমি কোনো ভাবেই মূল্যবোধকে পুনর্বিবেচনার কথা বলছি না। আমি বলছি পদ্ধতির পুনর্বিবেচনা করতে। অর্থাৎ, দেশে একটি বিশাল সাংস্কৃতিক জাগরণ শুরু করা উচিত।”

রেজা বাহোনারের উক্ত বক্তব্যের বিষয়ে ইরানের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Factnameh এর গত ১৪ অক্টোবর প্রকাশিত একটি ফ্যাক্টচেকিং প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরের ২৫ মে সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে একটি প্রশ্নের জবাবে সংসদের স্পিকার মোহাম্মদ বাকের কালিবাফ “হিজাব এবং সতীত্ব আইন” এর বিজ্ঞপ্তি দেওয়া মুলতবী করা হয়েছে বলে জানান। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সংসদের প্রেসিডিয়াম সদস্য আলিরেজা সালিমিও উক্ত আইনের বিজ্ঞপ্তি ও প্রয়োগ মুলতবীর বিষয়ে একই কথা বলেন।

ফ্যাক্টনামেহ এর উক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী “হিজাব এবং সতীত্ব আইন” আপাতত মুলতবী হলেও হিজাব সংক্রান্ত অন্যান্য আইন এখনও বহাল আছে। ইরানের ইসলামিক দণ্ডবিধির ৬৩৮ ধারায় বলা হয়েছে যে, যেসব নারী ইসলামিক হিজাব ছাড়া জনসমক্ষে উপস্থিত হন তাদের কারাদণ্ড এবং জরিমানা দণ্ডিত করা হবে। এছাড়াও, ইসলামিক হিজাব বাধ্যতামূলকভাবে পালনের বিষয়ে আরও কয়েক ডজন আইন, বিধিবিধান এবং নির্দেশনা রয়েছে এবং এখন পর্যন্ত সেগুলি বাতিল বা স্থগিত করার কোনও খবর প্রকাশিত হয়নি।

অর্থাৎ, ইরানে হিজাবের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার দাবিটি সঠিক নয়। 

সুতরাং, ইরানে হিজাবের বাধ্যবাধকতার কথিত বাতিল উদযাপনের দৃশ্য দাবিতে ২০২২ সালে ইরানে পুলিশের হেফাজতে মাশা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভের ভিডিও প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img