হান্নান মাসউদের বাসা থেকে ৪ বস্তা ও সিন্দুক ভর্তি টাকা উদ্ধারের দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি অনলাইনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য-সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদকে জড়িয়ে কথিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, ‘এনসিপি নেতা হান্নান মাসুদের বাসায় মিললো ৪ বস্তা ও সিন্দুক ভর্তি টাকা’। ভিডিওটিতে টাকা উদ্ধারের নানা ফুটেজ ও কথিত হান্নান মাসউদের আটক হওয়ার একটি ছবিও প্রচার করা হয়।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ হওয়া অবধি আলোচিত দাবিতে প্রচারিত উপরোল্লিখিত পোস্টটি ৮ লক্ষ ৭০ হাজারেরও অধিক বার দেখা হয়েছে এবং ২৫ হাজারেরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্টটিতে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

এরূপ দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদের বাসা থেকে ৪ বস্তা ও সিন্দুক ভর্তি টাকা উদ্ধারের দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার পুরোনো নানা ভিডিও ও সম্পাদিত ছবি প্রচার করে আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত প্রতিবেদনের শুরুর দিকে হান্নান মাসউদের বাসা থেকে টাকা উদ্ধারের ফুটেজ দাবিতে একটি ফুটেজের সংযুক্তি পাওয়া যায়। উক্ত ফুটেজটির বিষয়ে অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম ‘বাংলাভিশন’ এর ইউটিউব চ্যানেলে ‘আওয়ামী লীগ নেতা এনু-রুপনের বাসায় টাকার পাহাড়’ শিরোনামে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে প্রদর্শিত দৃশ্যের সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত প্রতিবেদনে প্রচারিত দৃশ্যের মিল পাওয়া যায়।

Comparison : Rumor Scanner

পরবর্তীতে এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে মূলধারার গণমাধ্যম ‘আরটিভি’ ও ‘দ্যা ডেইলি স্টার’ এর ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, ‘ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা এনামুল হক এনু ও তার ভাই রুপন ভূঁইয়ার পুরান ঢাকার বাসা থেকে নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা, ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআর, প্রায় এক কেজি ওজনের স্বর্ণালঙ্কারসহ বিপুল পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা জব্দ করেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। রাজধানীর পুরান ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে র‌্যাব-৩-এর একটি দল সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২০) রাত সাড়ে ১২টায় পুরান ঢাকার ১১৯ লালমোহন সাহা স্ট্রিটে অভিযান শুরু করে। ছয়তলা বাড়ির নিচতলায় র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে এ অভিযান শুরু হয়।’

এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত প্রতিবেদনে টাকা উদ্ধারের আরেকটি ফুটেজেরও সংযুক্তি পাওয়া যায়৷ উক্ত ফুটেজটির বিষয়ে অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম ‘যমুনা টিভি’র ইউটিউব চ্যানেলে ‘আর্মির অভিযানে সাবেক অতিরিক্ত সচিবের বাসায় মিললো টাকার খনি’ শিরোনামে ২০২৪ সালের ৪ নভেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে প্রদর্শিত দৃশ্যের সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত প্রতিবেদনে প্রচারিত দৃশ্যের মিল পাওয়া যায়।

Comparison : Rumor Scanner

যমুনা টিভির ইউটিউব ভিডিওটির বর্ণনা অংশে ফুটেজটি সম্পর্কে বলা হয়, ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আমজাদ হোসেনের বাসায় অভিযান চালানো হয়। রোববার (৩ নভেম্বর, ২০২৪) রাতে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ৩৩ নম্বর বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। জানা যায়, আমজাদ হোসেনের বাড়িতে রোববার রাত ১০টার দিকে অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। প্রায় চার ঘণ্টার অভিযান শেষে আমজাদ ও তার ছেলে আটক করা হয়। অভিযানে তাদের বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি নগদ অর্থ এবং মূল্যবান সামগ্রী জব্দ করা হয়। এরমধ্যে নগদ ১ কোটি সাড়ে ৯ লাখ টাকা, বেশ কিছু বৈদেশিক মুদ্রা, ১১টি আইফোন এবং ব্র্যান্ডের মূল্যবান ঘড়ি রয়েছে। আটকদের বিরুদ্ধে মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।’

এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত প্রতিবেদন ভিডিওটির থাম্বনেইলে টাকা উদ্ধারের আরেকটি ছবির সংযুক্তি পাওয়া যায়। ছবিটি নিয়ে রিভার্স সার্চে মূলধারার গণমাধ্যম ‘দ্যা ডেইলি স্টার’ এর ওয়েবসাইটে ‘সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব শাহ কামালের বাসায় অভিযান, ৩ কোটি টাকা জব্দ’ শিরোনামে ২০২৪ সালের ১৬ আগস্টে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে একটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায় যার সাথে আলোচিত দাবিটি প্রচারিত উপরোল্লিখিত ছবির মিল পাওয়া যায়।

Comparison : Rumor Scanner 

ছবিটির বর্ণনায় বলা হয়, ‘শাহ কামালের মোহাম্মদপুরের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা দেশি-বিদেশি মুদ্রা।’। এছাড়াও, প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোড এলাকায় এক সচিবের বাসায় অভিযান চালিযে বিদেশি মুদ্রাসহ তিন কোটি টাকার বেশি অর্থ উদ্ধার করেছে পুলিশ। আজ শুক্রবার (১৬ আগস্ট ২০২৪) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এক হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় এই তথ্য নিশ্চিত করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।’

হান্নান মাসউদের আটককৃত অবস্থার ছবি যাচাই

আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত প্রতিবেদনে হান্নান মাসউদের আটককৃত অবস্থার ছবি দাবিতে একটি ছবিও প্রচার করা হয়েছে। উক্ত ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে দৈনিক সংবাদপত্র ‘জনকণ্ঠ’ এর ওয়েবসাইটে ‘কেশবপুরের ত্রাস টিটো যৌথ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার’ শিরোনামে ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে একটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায় যার সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত প্রতিবেদনে সংযুক্ত উল্লিখিত ছবিটির তুলনা করলে মুখমণ্ডল ব্যতীত বাকী সবকিছুর মিল পাওয়া যায়। হান্নান মাসউদের মুখের বদলে ছবিতে ভিন্ন এক ব্যক্তির মুখমণ্ডল দেখা যায়।

Comparison : Rumor Scanner

ছবিটির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘কেশবপুরের ত্রাস মেয়র বাহিনীর প্রধান আলমগীর সিদ্দিক ওরফে টিটোকে যৌথবাহিনী আটক করেছে। বুধবার (৬ নভেম্বর ২০২৪) সন্ধ্যায় কেশবপুর শহরের হাসপাতাল পাড়াস্থ নিজ বাসভবন থেকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করে। গোপন সংবাদের ভিত্ততে দীর্ঘদিন পালিয়ে থাকা এই আলোচিত সন্ত্রাসীকে যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে আটক করতে সক্ষম হয়েছে। আটক টিটো একজন সন্ত্রাসী এবং কেশবপুরের ত্রাস হিসাবে চিহ্নত । তার বিরুদ্ধে কেশবপুরের মানুষকে জিম্মি করে শত কোটি টাকা চাঁদাবাজি এবং নিয়োগ বাণিজ্যের অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।’ এছাড়াও, ‘সকালের সময়’ নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও টিটোর আটক হওয়ার উক্ত ছবিটি পাওয়া যায়। তাছাড়া, হান্নান মাসউদের আটক হওয়ার ছবিটি আসল হওয়ার সপক্ষে মূলধারার গণমাধ্যম বা কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মূলত টিটোর আটক হওয়ার ছবিটি ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে তাতে হান্নান মাসউদের মুখমণ্ডল বসানো হয়েছে।

পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলেও এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদের বাসা থেকে ৪ বস্তা ও সিন্দুক ভর্তি টাকা উদ্ধারের দাবির সপক্ষে মূলধারার গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

সুতরাং, ভিন্ন ভিন্ন পুরোনো নানা ঘটনার ভিডিও ও সম্পাদিত ছবি প্রচার করে দাবি করা হয়েছে এনসিপি নেতা হান্নান মাসউদের বাসা থেকে ৪ বস্তা ও সিন্দুক ভর্তি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img