জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৬ সেপ্টেম্বর ভাষণ দেন। ভাষণের এক পর্যায়ে তিনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকদের পক্ষ থেকে আমি আবারও জোরালো দাবি জানাচ্ছি যে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে এই সমস্যার দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান এখনই বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধুমাত্র ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমারেখার ভিত্তিতে, যেখানে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকবে, তখনই ন্যায়বিচার সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হবে।’ এরই প্রেক্ষিতে গত ২৬ সেপ্টেম্বর মূলধারার গণমাধ্যম যমুনা টিভির ফেসবুক পেজে একটি ফটোকার্ডও প্রচার করা হয়।
সম্প্রতি উক্ত ফটোকার্ডটি সংযুক্ত করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা হয়েছে, ‘ইহুদিবন্ধু ইউনুস আজ জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে এক ভয়ঙ্কর প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাংলাদেশের অন্য কোনো সরকার প্রধান কোনোদিন কল্পনাও করে নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসরায়েলের স্বীকৃতি ও বন্ধুত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে ফিলিস্তিনের পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নেন ও ইসরায়েলকে দখলদার রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেন। যা দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের শতভাগ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায় এবং এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ এই নীতিতেই চলছে। অর্থাৎ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ইসরায়েলকে স্বীকারই করে না। কিন্তু ইউনুস আজ জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমারেখার ভিত্তিতে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রস্তাব দিয়েছে। ইসরায়েল রাষ্ট্র পুরোটাই গড়ে উঠেছে ফিলিস্তিনের দখলকৃত ভূমির ওপরে, অথচ ইউনুস ১৯৬৭ সালের পূর্বের দখলকৃত অংশকে বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে বৈধতা দিয়ে আসলো। জেরুজালেমের পূর্বাংশ ফিলিস্তিনকে ও পশ্চিমাংশ ইসরায়েলকে দেওয়ার প্রস্তাব দিলো, যে জেরুজালেমকে রক্ষার জন্য লক্ষ-লক্ষ ফিলিস্তিনি জীবন দিলো। যদিও এটা অসম্ভব, তারপরও যদি ইউনুসের কথামতো দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান হয় তাহলে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি ও বন্ধুত্ব স্থাপন না করে বাংলাদেশের উপায় থাকবে? ইসরায়েলের সাথে বন্ধুত্বের জন্য ইউনুসের এতো আগ্রহ কেনো? ইউনুস আজ বাংলাদেশের ৫৪ বছরের পররাষ্ট্রনীতি লঙ্ঘন করে ১৯৬৭ সালের পূর্বের দখলকৃত ভূমির স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের মানুষ দখলদার ইসরায়েলকে দেশ হিসেবে স্বীকার করে না, কিন্তু ইউনুস আজ মাতবরি করে ইসরায়েলকে শর্তসাপেক্ষে দেশ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে। ইউনুসের এই বক্তব্য বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থী। যেহেতু ইউনুস ইসরায়েলের অনেক বন্ধুরাষ্ট্রের নাগরিক, সেহেতু সে এ ধরণের বক্তব্য দিতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে সে এ ধরণের বক্তৃব্য দিতে পারে না। এই অধিকার তার নেই, ম্যান্ডেটও নেই।’
অর্থাৎ, দাবি করা হয়েছে, ড. ইউনূসের আগে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক প্রস্তাব বা প্রস্তাবে সমর্থন কোনো বাংলাদেশি রাষ্ট্রপ্রধান দেয়নি।

এই দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ড. ইউনূসের আগে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ইস্যুতে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক প্রস্তাব বা প্রস্তাবে কোনো বাংলাদেশি রাষ্ট্রপ্রধান সমর্থন দেয়নি শীর্ষক দাবি সঠিক নয়৷ প্রকৃতপক্ষে ড. ইউনূসের আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমারেখার ভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে একাধিকবার বক্তব্য দিয়েছেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার যে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ, তার প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ (২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি) বৃহস্পতিবার তেজগাঁওয়ে তাঁর কার্যালয়ে সফররত ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ কথা বলেন।’
এছাড়া, মূলধারার গণমাধ্যম ‘বিবিসি বাংলা’র ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘(২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর) ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সংহতি বিষয়ক জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক দিবসে এ সংক্রান্ত একটি বার্তা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। বার্তাটি (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত।… (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী তাতে বলেছেন, “পূর্ব জেরুজালেম-আল কুদস আল শারিফকে রাজধানী রেখে দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের আঙ্গিকে ১৯৬৭ সালের সীমানাভিত্তিক একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে আমরা আমাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করছি।”’
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ২০২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে মূলধারার গণমাধ্যম এখন টিভি’র ইউটিউব চ্যানেলে জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের ২৭ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটির ১৮ মিনিট ৩৩ সেকেন্ড পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ‘অধিকৃত ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি আমাদের সমর্থন সবসময় অব্যাহত থাকবে। ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমান্তের ভিত্তিতে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান ও রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে নির্ধারণ করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি বাংলাদেশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছি।’
উল্লেখ্য, বক্তব্যের ভিডিওতে শেখ হাসিনা ‘জেরুজালেম’কে ফিলিস্তিনের রাজধানী করার দাবি জানালেও সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’ ও মূলধারার সংবাদমাধ্যম ‘ইত্তেফাক’ এর ওয়েবসাইটে সেসময় শেখ হাসিনার পূর্ণাঙ্গ ভাষণের টেক্সটে রাজধানী হিসেবে ‘পূর্ব জেরুজালেম’ উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও, ‘বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা’র ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ১২ নভেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘(সাবেক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের বর্বর আগ্রাসন বন্ধে পাঁচটি সুপারিশ পেশ করেছেন।… পূর্বে রেকর্ডকৃত এবং ৮ম বিশেষ ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে সম্প্রচারিত ভাষণে তিনি এ পরামর্শ দেন।.. (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, ‘বাংলাদেশ ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ভিত্তিতে এবং আল-কুদস আল-শরীফকে রাজধানী করে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে আমাদের ফিলিস্তিনি ভাই ও বোনদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতার অধিকারকে সমর্থন করে এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে।’’
অর্থাৎ, ড. ইউনূসের আলোচিত বক্তব্যের আগে নানাসময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমারেখার ভিত্তিতে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন।
সুতরাং, ড. ইউনূসের আগে দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক প্রস্তাব কোনো বাংলাদেশি রাষ্ট্রপ্রধান দেয়নি শীর্ষক দাবি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Prothom Alo – ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দুই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে ঢাকার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত
- BBC News Bangla – ইসরায়েল-ফিলিস্তিন: দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্বের পক্ষেই বাংলাদেশ
- Ekhon TV – জাতিসংঘের ৭৭ তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ
- Bangladesh Sangbad Sangstha – Full text of PM Sheikh Hasina’s speech at UNGA
- Ittefaq – জাতিসংঘের ৭৭তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া পূর্ণাঙ্গ ভাষণ
- Bangladesh Sangbad Sangstha – ফিলিস্তিন যুদ্ধ বন্ধে ৫টি সুপারিশ পেশ প্রধানমন্ত্রীর
- Rumor Scanner’s analysis