সম্প্রতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেসবুকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে জিয়াউর রহমানের করমর্দন করার একটি ভিডিও প্রচার করা হয়েছে। প্রচারিত পোস্টগুলোতে দাবি করা হয়, এটি ব্রিগেডিয়ার জিয়াউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল ও উপ-সেনাপ্রধান পদে নিযুক্তির জন্যে সাবেক সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ সুপারিশ করায় বঙ্গবন্ধুর তা সানন্দে গ্রহণ করার দুর্লভ মুহুর্তের ভিডিও। ভিডিওটিতে সাবেক সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহর হাত থেকে বঙ্গবন্ধুকে একটি কাগজ গ্রহণ করতে দেখা যায়। এরপরই জিয়াউর রহমানের সাথে বঙ্গবন্ধুকে করমর্দন করতে দেখা যায়।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে জিয়াউর রহমানের করমর্দন করার ভিডিওটি আসল নয়। এছাড়াও সাবেক সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ জিয়াউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল ও উপ-সেনাপ্রধান পদে নিযুক্তির জন্যে সুপারিশ করেছিলেন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটিও সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, ইন্টারনেটে বিদ্যমান অনুরূপ একটি ছবিকে এআই প্রযুক্তির সহায়তায় ভিডিওতে রূপান্তরিত করে আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যালোচনা করে রিউমর স্ক্যানার ভিডিওটিতে Vidnoz Gen লেখা একটি জলছাপ দেখতে পায়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, Vidnoz একটি এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। যার সহায়তায় ছবি থেকে ভিডিও তৈরি করা যায়। ভিডিওগুলো ৫ সেকেন্ড থেকে ৮ সেকেন্ডের হয়ে থাকে। যার নিচের দিকে Vidnoz Gen শীর্ষক জলছাপ থাকে। আলোচিত ভিডিওটির দৈর্ঘ্যও ৫ সেকেন্ড।

পরবর্তীতে ভিডিওটিতে ব্যবহৃত ছবির বিষয়ে অনুসন্ধানে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে দৈনিক প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আলোচিত ভিডিওর অনুরূপ ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। যেখানে বঙ্গবন্ধুকে সাবেক সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহর হাত থেকে একটি কাগজ নিতে দেখা যাচ্ছে। ছবিতে দেখতে পাওয়া তাদের তিনজনের পোশাক ও পারিপার্শ্বিক অন্যান্য জিনিসের সাথে আলোচিত ভিডিওতে দেখতে পাওয়া সকল উপাদানের হুবহু মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ, এ থেকে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে যে, উক্ত ছবিটি ব্যবহার করেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। তবে ছবিটিতে সাবেক সেনাপ্রধান বঙ্গবন্ধুকে কিসের কাগজ দিচ্ছে তা উল্লেখ না থাকায় সেসময় তিনি জিয়াউর রহমানকে পদোন্নতির জন্যে সুপারিশপত্র দিচ্ছিলেন কিনা তা জানা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও অনুসন্ধানে ছবিটির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য খুঁজে না পাওয়ায় দাবিটির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
জিয়াউর রহমানকে পদোন্নতির সুপারিশের তথ্যটির বিষয়ে অনুসন্ধানে পরবর্তীতে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ‘আমাকে সেনাপ্রধান ও জিয়াকে উপপ্রধান করে বঙ্গবন্ধু ভুল করেছিলেন’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ১৫ আগস্ট শোক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সাবেক সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ বলেন, ‘সেনাবাহিনীর মধ্য থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। আর আমি তখন ছিলাম সেনাপ্রধান। বঙ্গবন্ধু একটা মস্ত বড় ভুল করেছিলেন, সেটা হচ্ছে আমাকে সেনাপ্রধান করে আর জিয়াউর রহমানকে উপপ্রধান করে।’ উক্ত সভায় জিয়াউর রহমানকে উপপ্রধান করাটা ঠিক হয়নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি সেনাপ্রধান হতে চাননি জানিয়ে বলেন, জেনারেল ওসমানী ৫ এপ্রিল ডেকে বললেন, “তুমি আর্মি টেক ওভার করো।” আমি বললাম, আমার সিনিয়র আছে। আমার তিনজন সিনিয়রের নাম বললাম। কর্নেল রব, দত্ত ও জিয়াউর রহমান। আমরা একই ব্যাচের হলেও জিয়াউর রহমান আমার চেয়ে ১ নম্বরের সিনিয়র ছিলেন। তখন আমি বললাম, এটা ঠিক হবে না।
এছাড়াও কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে আরেক মূলধারার গণমাধ্যম দ্য ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসূলের আদালতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ বলেন, ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল যখন আমাকে সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, আমি প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে।’’ কারন হিসেবে তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান তার চেয়ে সেনা একাডেমিতে সিনিয়র ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, “দুই ঘণ্টার আলোচনা শেষে, বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করেন, ‘আমি তোমার কথা শুনেছি। এখানে একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার আছে।’” উত্তরে কে এম শফিউল্লাহ বলেন, “স্যার, আজ থেকে আমি এখন এবং ভবিষ্যতে পরিস্থিতির শিকার হব।” কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন, “তুমি বড় বড় কথা বলছো। এখন যাও এবং আগামীকাল জেনারেল ওসমানী (তৎকালীন সেনাপ্রধান) থেকে তোমার দায়িত্ব নিয়ে নাও।”
সাবেক সেনাপ্রধান বলেন, ”তিনি তখন বঙ্গবন্ধুর অফিস থেকে সরাসরি ৪৬ ব্রিগেডে চলে গিয়েছিলেন এবং কুমিল্লায় জিয়াউর রহমানকে ফোন করে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। তিনি বলেন, “জিয়া আমার কথা শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে শফিউল্লাহ, এখন বিদায়।’” এক সপ্তাহ পর, সেনাবাহিনীর উপপ্রধান পদের একটি নতুন পদ তৈরি করা হয় এবং জিয়াউর রহমানকে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়। জিয়াউর রহমান কুমিল্লা থেকে এসে সেই পদে যোগ দেন, তবে তিনি কিছুটা ক্ষুব্ধ ছিলেন, যা তিনি অন্যদের কাছে প্রকাশ করেছিলেন।”
অর্থাৎ, প্রাপ্ত তথ্য থেকে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ জিয়াউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে উপ-সেনাপ্রধান পদে নিযুক্তির জন্যে বঙ্গবন্ধুর কাছে সুপারিশ করেননি।
সুতরাং, এআই দিয়ে তৈরি ভিডিওকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে জিয়াউর রহমানের করমর্দন করার দুর্লভ মুহুর্তের ভিডিও দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পাদিত।
তথ্যসূত্র
- Prothom Alo Website: ‘আমাকে সেনাপ্রধান ও জিয়াকে উপপ্রধান করে বঙ্গবন্ধু ভুল করেছিলেন’
- Daily Star Website: Zia seemed aggrieved when I was made Chief of Staff: Shafiullah
- Rumor Scanner’s Analysis