বিগত গত ৬ বছর ধরে প্রতি বছরেই “ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম একাই পাচার করেছেন ২ হাজার কোটি টাকা” শীর্ষক দাবি ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বা ২০২৫ সালে এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
২০২৪ সালে এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
২০২৩ সালে এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এছাড়া, ২০২৩ সালে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক দোয়া মাহফিলে এরূপ দাবি করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
২০২২ সালে এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
২০২১ সালে এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
২০২০ সালে এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের ঘটনায় ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম এককভাবে দায়ী ছিলেন শীর্ষক দাবিতে প্রচারিত তথ্য সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছাড়াও উক্ত মামলায় আরো ৪৬ জন আসামী বা অভিযুক্ত রয়েছেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে জানা যায়, প্রচারিত পোস্টগুলোতে মূলত ২০২০ সালে আলোচনায় আসা ফরিদপুরের আলোচিত বরকত-রুবেলের ২ হাজার কোটি টাকা অর্থপাচারের মামলার ঘটনাটি বুঝানো হয়েছে।
২০২০ সালের জুনে সিআইডির পরিদর্শক এস এম মিরাজ আল মাহমুদ বাদী হয়ে ঢাকার কাফরুল থানায় ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের বিরুদ্ধে, দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে উক্ত মামলাটি করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ফরিদপুরের এলজিইডি, বিআরটিএ, সড়ক বিভাগসহ বিভিন্ন সরকারি বিভাগের ঠিকাদারী নিয়ন্ত্রণ করে বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদদের মালিক হয়েছেন বরকত ও রুবেল। এছাড়া মাদক ব্যবসা ও ভূমি দখল করে অবৈধ সম্পদ করেছেন। ২৩টি বাস, ট্রাকসহ বিলাসবহুল গাড়ির মালিক হয়েছেন। এ টাকার উল্লেখযোগ্য অংশ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেছেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, রাজবাড়ীতে ১৯৯৪ সালের ২০ নভেম্বর এক আইনজীবী খুন হন। সে হত্যা মামলার আসামি ছিলেন এই দুই ভাই। এজাহারে আরও বলা হয়, ২০২০ সালের ১৮ জুন মিরাজ আল মাহমুদ এ বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়ে তদন্ত শুরু করেন। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে এই দুই ভাই অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। সেসময় ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, এই মামলাটি দায়ের করেছে সিআইডি, মামলাটির তদন্ত কাজ সিআইডিই করবে।
উল্লেখ্য যে, কিছু পোস্টে দাবি করা হয়েছে, কেবলমাত্র ২০২০ সালে উল্লিখিত পরিমাণ টাকা পাচার করা হয়েছে। তবে, মামলার এজাহার সংশ্লিষ্ট সংবাদে উল্লিখিত পরিমাণ অর্থপাচার কেবলমাত্র ২০২০ সালে করা হয়েছে শীর্ষক কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
মামলায় আদালতের মাধ্যমে রুবেল ও বরকতকে ২০২০ সালে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি। সেসময় এর সঙ্গে জড়িত অনেকের নাম প্রকাশ করেন তারা। রুবেল-বরকতের স্বীকারোক্তি ও তথ্যানুযায়ী আলোচিত ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নিশান মাহামুদ শামীমকে ২০২০ সালের ২১ আগস্ট বিকালে ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে সিআইডির একটি দল গ্রেফতার করে। শামীমের আগে এই মামলায় আরও গ্রেফতার হয়েছিলেন নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী ও বেল্লাল হোসেন। তিন দিনের রিমান্ড শেষে ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট শামীমকে আদালতে হাজির করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এসময় আসামি স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মতি জানান। পরে তা রেকর্ডের আবেদন করলে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবদাস চন্দ্র অধিকারী তার জবানবন্দি নেন।
পরবর্তীতে ২০২১ সালের ৩ মার্চ বরকত ও রুবেলসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার উত্তম কুমার বিশ্বাস আদালতে অভিযোগ পত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে বরকত ও রুবেল ছাড়া অভিযুক্ত অন্য আসামিরা হলেন- নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেভী, আসিকুর রহমান ফারহান, খন্দোকার মোহতেসাম হোসেন বাবর, এএইচএম ফুয়াদ, ফাহাদ বিন ওয়াজেদ ওরফে ফাহিম, কামরুল হাসান ডেভিড, মুহাম্মদ আলি মিনার ও তারিকুল ইসলাম ওরফে নাসিম। ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ কে এম ইমরুল কায়েশের আদালত এ অভিযোগপত্র আমলে গ্রহণ করেন। তবে, অর্থপাচারের মামলায় সাবেক ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পরও তার নামসহ আরো কয়েকজনের নাম চার্জশিটে বাদ যাওয়ায় এটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর পুরো আইন মেনে অধিকতর তদন্তসাপেক্ষে মামলার অভিযোগপত্র পুনরায় জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।
তার কয়েক মাস আগে ২০২২ সালের ১৪ জুনে উক্ত দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের জামিন প্রশ্নে রুল শুনানিতে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বলেছিলেন, এ মামলায় সংঘটিত অপরাধের মাস্টারমাইন্ড খন্দকার মোহতেশাম। খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরের জামিন প্রশ্নে আদালত বলেছিলেন, ‘তিনি (মোহতেশাম) একটি সিন্ডেকেট চালাতেন বলে আসামিদের জবানবন্দিতে এসেছে। তাঁর এসব কর্মকাণ্ডের জন্য সরকার ও দেশের মানুষের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। তিনি অন্য আসামিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, পরামর্শদাতাও ছিলেন। তিনি রিং লিডার। এ ধরনের আসামিদের কেন জামিন দেব?’
এদিকে নতুন করে তদন্তের পর আগের চার্জশিট বা অভিযোগপত্রে থাকা ১০ জনের সাথে আরও ৩৭টি নাম যুক্ত হয়। ২০২৩ সালের ২২ জুনে মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার রায়হান উদ্দিন খান আগের ১০ জনসহ মোট ৪৭ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন। নতুন আসামিদের মধ্যে ছিলেন আলোচিত ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম, ফরিদপুর পৌরসভার সাবেক শ্রম বিষয়ক সম্পাদক আ.লীগ বিল্লাল হোসেন, শীর্ষস্থানীয় ঠিকাদার ও ফরিদপুর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, ফরিদপুর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম জীবন, ফরিদপুর জেলা আ.লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ও সাবেক ফরিদপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল আলম চৌধুরীসহ প্রমুখ। অর্থাৎ, নতুন সম্পূরক চার্জশিটে আলোচিত ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীমের নাম আরো অনেকের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়।
পরবর্তীতে ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই বরকত-রুবেল ও আলোচিত ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীমসহ ৪৭ জনের বিরুদ্ধে দেওয়া উক্ত সম্পূরক অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করেছিলেন আদালত। একই সঙ্গে ২০২৪ সালের ২২ এপ্রিলে মামলার পলাতক ৩৭ জন আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। অর্থাৎ, মামলাটির প্রথম থেকেই কখনো ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম একা অভিযুক্ত ছিলেন না। তিনি মামলাটির অন্যতম আসামী এবং এরই প্রেক্ষিতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন। তবে দুই হাজার কোটি টাকা পাচার মামলায় তিনি এককভাবে আসামী বা দায়ী নন। তাছাড়া, তার অ্যাকাউন্টে উল্লিখিত ২,০০০ কোটি টাকা ছিল শীর্ষক দাবিটির সপক্ষেও নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম যোগাযোগ করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি (পাবলিক প্রসিকিউটর বা পিপি) তাপস কুমার পালের সাথে। তিনি জানান, দুই হাজার কোটি টাকা অর্থপাচার মামলায় ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীম এককভাবে দায়ী বা আসামী শীর্ষক দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা। নিশান মাহমুদ শামীম অভিযুক্তদের একজন হলেও তিনি কখনোই এককভাবে অভিযুক্ত ছিলেন না। মামলার মূল আসামী ফরিদপুরের আলোচিত দুই ভাই বরকত ও রুবেল।
সুতরাং, আলোচিত দুই হাজার কোটি টাকা অর্থপাচার মামলায় ৪৭ অভিযুক্তদের বদলে ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নিশান মাহমুদ শামীমকে এককভাবে উক্ত মামলায় অভিযুক্ত বা দায়ী মর্মে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- The Daily Star – বরকত-রুবেলের বিরুদ্ধে ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা
- Bangla Tribune – দুই হাজার কোটি টাকা পাচার: জেলা ছাত্রলীগ সভাপতির স্বীকারোক্তি
- Prothom Alo – অর্থ পাচারের মাস্টারমাইন্ড খন্দকার মোহতেশাম: হাইকোর্ট
- Channel I – দুই হাজার কোটি টাকা পাচারে অভিযুক্ত ১০ জনের শুনানি ১৯ মে
- The Daily Star – মূল সন্দেহভাজনদের বাদ দিয়ে ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগপত্র
- The Daily Star – সাবেক মন্ত্রীর ভাইসহ ৪৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ নিয়ে সিদ্ধান্ত ২০ সেপ্টেম্বর
- Dhaka Post – ২ হাজার কোটি টাকা পাচার : ৪৭ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট
- Jugantor – ‘২ হাজার কোটি টাকা পাচার’ মামলায় মোশাররফের ভাইসহ ৩৭ নতুন আসামি
- Prothom Alo – সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের পিএসসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
- Statement of Tapos Kumar Pal, Additional Public Prosecutor, Dhaka Metropolitan Sessions Judge Court
- Rumor Scanner’s analysis