প্রথম আলোকে জড়িয়ে সেঁজুতি সাহার নামে চোখের ওষুধের ভুয়া প্রচারণা

ওয়েবসাইটটি দেখতে পুরোপুরি জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটের মতো। তবে সাইটের ইউআরএল বা ঠিকানা ভিন্ন। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটের ঠিকানা https://www.prothomalo.com। কিন্তু আলোচিত ওয়েবসাইটের ঠিকানা https://vision-bd.tantanika.com। “চোখের রোগে ভুগছেন? অন্ধত্বের ভয় করছেন? এই বিপ্লবী নতুন চিকিৎসা আপনার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনবে – বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর অসাধারণ আবিষ্কার” শীর্ষক দীর্ঘ এক শিরোনামের একটি সাক্ষাৎকার দেখা যাচ্ছে সাইটটিতে। দাবি করা হচ্ছে, সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিউজ ওটিটি প্লাটফর্ম এক টাকার খবর এর প্রধান সম্পাদক মুন্নী সাহা এবং সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দেশের অণুজীব বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা৷ 

Screenshot: vision-bd tantanika website 

আমরা সাক্ষাৎকারটির বিস্তারিত অংশ পড়ে দেখেছি। এখানে দাবি করা হচ্ছে, সেঁজুতি সাহা অপ্টিম্যাক্স আই কেয়ার (Optimax Eye Care) নামে একটি ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট উদ্ভাবন করেছেন। এমন দাবিও করা হচ্ছে, এই বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান সম্মেলনে’ সেঁজুতি সাহার একটি অভিনব দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধার পদ্ধতি উদ্ভাবনের বিষয়ে জানা যায়। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট পুরো বিষয়টি বিস্তারিত অনুসন্ধান করে দেখেছে৷ 

ফেসবুকে গত ২৮ জুন একাধিক ব্যক্তি একই অর্থাৎ টানটানিকা নামের ওয়েবসাইটটির একটি লিংক শেয়ার করেন৷ 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

লিংকটিতে সেঁজুতি সাহার ছবি রয়েছে। শিরোনামটি এমন, “অপারেশন ছাড়াই ২ সপ্তাহে দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধার করুন!” লিংকটি https://vision-bd.tantanika.com এর বলে উল্লেখ থাকলেও রিউমর স্ক্যানার লিংকে প্রবেশ করে দেখেছে, এটি মূলত প্রথম আলোর ২০১৪ সালের একটি সংবাদের লিংক। “কন্টাক্ট লেন্স: ঝুঁকি ও সাবধানতা” শীর্ষক শিরোনামের এই সংবাদে সেঁজুতি সাহার বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ফেসবুকে এই লিংকটি অন্তত ২৮ জুন থেকে বিভিন্ন ব্যক্তিকে শেয়ার করতে দেখা যায়। এদের মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধাও রয়েছেন, যিনি তার ফেসবুক প্রোফাইলে একই লিংক শেয়ার করেছেন। তবে একই লিংক সমেত পোস্টটি তারও একদিন আগে অর্থাৎ ২৭ জুন থেকেই ফেসবুকে রয়েছে। ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার এড লাইব্রেরি অন্তত সেই তথ্যই দিচ্ছে৷ সেদিন México Salud নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে বিজ্ঞাপন আকারে ফেসবুকে এই পোস্টটি করা হয়৷ 

Screenshot: Meta Ad Library 

এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আরো আট বার একই বিজ্ঞাপন চালানো হয়েছে। সর্বশেষ ৩০ জুন বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর পরবর্তীতে এ সংক্রান্ত কোনো বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি এই পেজ থেকে। এই পেজটি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২০২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি পেজটি Pristimantis Revista Literaria নামে চালুর পর সর্বশেষ গত ২৩ জুন বর্তমান নামে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে৷ পেজে একটি কলাম্বিয়া ভিত্তিক সিমের নাম্বার (+57 321 4554985) দেওয়া রয়েছে। ট্রু কলারের মাধ্যমে যাচাই করে দেখা যাচ্ছে, এই নাম্বারের মালিক লুইস ফেলিপ ভেলেজ ঝাপাতা (Luis Felipe Vélez Zapata) নামে এক ব্যক্তি। একই ব্যক্তির একটি লিংকডইন অ্যাকাউন্টের খোঁজ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার৷ তবে সেটি এই মুহূর্তে সচল নেই। একই সিমের নাম্বার রয়েছে Declive নামে এমন আরেকটি ফেসবুক পেজের সন্ধান মিলেছে। রিউমর স্ক্যানার লুইস ফেলিপ ভেলেজ ঝাপাতা নামের এই ব্যক্তির সাথে কথা বলেছে। তার দাবি, তার পেজটি গত ৩০ জুনের আশেপাশে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে। তিনি বলছেন, তার পেজটি ব্যবহার করে এখন পণ্যের প্রচারণা চালানো হচ্ছে। তবে পেজটিতে ৩০ জুনের পূর্ব থেকেই আলোচিত বিজ্ঞাপনটি প্রচার করা হচ্ছে, এমন তথ্য তাকে জানানোর পর তিনি কোনো প্রতিত্তোর দেননি। 

সেঁজুতি সাহা এবং মুন্নী সাহাকে জড়িয়ে প্রথম আলোর ইন্টারফেস ব্যবহার করে যে নিউজটির বিষয়ে আপনাদের শুরুতে জানিয়েছিলাম তা মেটার এড লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়নি৷ এ সংক্রান্ত পোস্টগুলো অন্তত গত ০২ জুলাই থেকে ফেসবুকে পাওয়া যাচ্ছে। https://vision-bd.tantanika.com নামের যে ওয়েবসাইটে আলোচিত সাক্ষাৎকারটি রয়েছে সেটির ডোমেইন রেজিস্ট্রার করা হয়েছে চলতি বছরের এপ্রিলে। এরপর গত ২১ জুন সর্বশেষ আপডেট করা হয়েছে। লোকেশন দেওয়া হয়েছে আইসল্যান্ডের, একটি ফোন নাম্বার (+354 421 2434) রয়েছে, সেটিও সে দেশেরই। 

কথিত সাক্ষাৎকারটিতে মুন্নী সাহা এবং সেঁজুতি সাহার যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন সময়ের৷ মুন্নী সাহা ২০২২ সালে এটিএন নিউজে থাকাকালীন সংগীত শিল্পী অনিমেষ রায়ের সাক্ষাৎকার নেন। তার ছবিটি নেওয়া হয়েছে সেখান থেকেই। অন্যদিকে সেঁজুতি সাহা একই বছর মাছরাঙা টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দেন। তার ছবিটি নেওয়া হয়েছে এই অনুষ্ঠানের ভিডিও থেকে৷ টানটানিকা নামের ওয়েবসাইটে কথিত সাক্ষাৎকারটির শুরুতে এই বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান সম্মেলনে’ নামে একটি আয়োজনের তথ্য দেওয়া হয়েছে যাতে সেঁজুতি সাহার একটি অভিনব দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধার পদ্ধতি উদ্ভাবনের বিষয়ে জানা যায় বলে দাবি করা হচ্ছে। ফেসবুকেও বিষয়টি ইতোমধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, এই বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান সম্মেলনে পুরো দর্শক দশ মিনিট ধরে একজন তরুণ গবেষককে দাঁড়িয়ে করতালি দেয়। এই গবেষক হলেন ডঃ সেঁজুতি সাহা, যিনি একটি অভিনব দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। বহু দৃষ্টিহীন মানুষ দৃষ্টি ফিরে পাবে সেঁজুতি সাহার এই উদ্ভাবনের কারণে।

Screenshot: Facebook 

তবে ঢাকায় চলতি বছর এমন কোনো সম্মেলন আয়োজনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতির একটি বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। তবে সেখানে সেঁজুতির উপস্থিতির তথ্য মেলেনি। আমরা এ বিষয়ে সেঁজুতি সাহা এবং মুন্নী সাহা উভয়ের সাথেই কথা বলেছি। 

মুন্নী সাহা রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন, সেঁজুতির সাথে তার পরিচয় থাকলেও, তিনি কখনো তার সাক্ষাৎকার নেননি। তিনি বলছেন, “আমার ছবির সাথে কাট পেস্ট করে সেঁজুতিকে বসিয়ে অভিনব কায়দায় ভুয়া ওষুধ বিক্রি করছে।” 

সেঁজুতি সাহা এ বিষয়ে ইতোমধ্যে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। জিডির একটি কপি তিনি রিউমর স্ক্যানারকেও দিয়েছেন৷ তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন, তিনি এমন কোনো সাক্ষাৎকার কাউকে দেননি। সাক্ষাৎকারে যে সম্মেলনের কথা বলা হচ্ছে, এমন কোনো সম্মেলনেও তিনি অংশগ্রহণ করেননি। এমন কোনো সম্মেলনের বিষয়ে তিনি জানেনও না। 

অপ্টিম্যাক্স আই কেয়ার (Optimax Eye Care) নামে যে কথিত ডায়েটারি সাপ্লিমেন্টের বিষয়ে সাক্ষাৎকারে বলা হয়েছে তার বিষয়ে খোঁজ খবর নিয়েছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। এই সাপ্লিমেটের বিষয়ে বিভিন্ন কিওয়ার্ড সার্চ করে বিস্তারিত কোনো তথ্য মেলেনি। এমনকি বাংলাদেশে এই নামে কোনো ওষুধের অনুমোদন নেই। দেশের একাধিক চক্ষু বিশেষজ্ঞের সাথেও কথা বলেছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। তারা এক বাক্যে এটিকে ভুয়া ওষুধ বলে অভিহিত করেছেন। এই পণ্যটির প্রচারণা চালানো হয় এমন অন্তত দুইটি ফেসবুক পেজের সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘Optimax – বাংলাদেশে অফিসিয়াল ডিস্ট্রিবিউটর’ এবং ‘Optimax – বাংলাদেশে সেরা পরিবেশক’ নামের এই দুই পেজ গত বছরের জুলাই ও আগস্টে চালু হয়। চলতি বছরের মার্চে সর্বশেষ এসব পেজে পোস্ট করা হয়। 

Screenshot collage: Rumor Scanner

সেঁজুতির কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম তিনি এমন কোনো ওষুধের বিষয়ে জানেন কিনা এবং চোখ নিয়ে তার কোনো গবেষণা রয়েছে কিনা। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন, তিনি চোখ নিয়ে কোনো গবেষণা করেননি। 

এ বিষয়ে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ তাদের বক্তব্যে জানিয়েছে, সেঁজুতি সাহার নামে প্রচারিত এই ভুয়া বিজ্ঞাপনে প্রথম আলোকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, তার সঙ্গে এ প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্কই নেই। এখানে একটি ভুয়া লিংক ব্যবহার করা হয়েছে। সেই লিংকে অসৎভাবে প্রথম আলোর লোগোও ব্যবহার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

spot_img