সেপ্টেম্বরে ৩২৯ ভুল তথ্য শনাক্ত

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ৩২৯টি ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে বাংলাদেশের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমর স্ক্যানার। রিউমর স্ক্যানারের ওয়েবসাইটে সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেক থেকে গণনাকৃত এই সংখ্যার মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশি (২২৯) ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ মিলেছে, যা মোট ভুল তথ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ। এছাড়া জাতীয় বিষয়ে ৫৩টি, ধর্মীয় বিষয়ে ২০টি, আন্তর্জাতিক বিষয়ে ১১টি, বিনোদন ও সাহিত্য বিষয়ে পাঁচটি, শিক্ষা বিষয়ে চারটি, খেলাধুলা বিষয়ে সাতটি ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে গত মাসে। এর বাইরে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন নিয়ে দুইটি আলাদা পরিসংখ্যান এবং একজন নারী সংবাদ পাঠিকার নাম ও ছবি ব্যবহার করে ভুয়া ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অপতথ্যের প্রচারের বিষয়ে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের অধীনে বিস্তারিত অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে গত মাসে। 

এসব ঘটনায় ভিডিও কেন্দ্রিক ভুলই ছিল সবচেয়ে বেশি, ২১৫টি। এছাড়া তথ্য কেন্দ্রিক ভুল ছিল ৭৯টি এবং ছবি কেন্দ্রিক ভুল ছিল ৩৫টি। শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যগুলোর মধ্যে মিথ্যা হিসেবে ২৩৩টি, বিকৃত হিসেবে ৩৩টি এবং বিভ্রান্তিকর হিসেবে ৬৩টি ঘটনাকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। 

শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এই সময়ে পুরুষদের জড়িয়ে ভুল তথ্য প্রচার হয়েছে ২০১টি এবং নারীদের জড়িয়ে ভুল তথ্য শনাক্ত হয়েছে ৮৫টি। 

একই সময়ে বয়সের ধরণ অনুযায়ী চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে ভুল তথ্যগুলোকে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুবক বয়সীদের (যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে) নিয়ে সবচেয়ে বেশি (১১৩) ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এছাড়া, শিশুদের (যাদের বয়স ০ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে) নিয়ে ০৫টি, মধ্যবয়সীদের (যাদের বয়স ৩৬ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে) নিয়ে ৭৩টি এবং প্রবীণদের (যাদের বয়স ৬০ বছর বা তার বেশি) জড়িয়ে ৯০টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে।

প্লাটফর্ম হিসেবে গেল মাসে ফেসবু্কে সবচেয়ে বেশি ভুল তথ্য ছড়িয়েছে, সংখ্যার হিসেবে যা ২৮৯টি। এছাড়া ইনস্টাগ্রামে ১৫৬টি, ইউটিউবে ৪৬টি, এক্সে ৪০টি, টিকটকে ৮২টি, থ্রেডসে অন্তত ১৩টি ভুল তথ্য প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। ভুল তথ্য প্রচারের তালিকা থেকে বাদ যায়নি দেশের গণমাধ্যমও। ১৩টি ঘটনায় দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গণমাধ্যমে ভুল তথ্য প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। একই সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমেও বাংলাদেশকে নিয়ে দুইটি অপতথ্য শনাক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক অপতথ্য প্রচারের বিষয়টি গেল বেশ কয়েক মাস ধরে আলোচনায়। সেপ্টেম্বরে ১৫টি সাম্প্রদায়িক অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে আটটি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় পরিচয়ধারী অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে অপতথ্য প্রচারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

রিউমর স্ক্যানার টিমের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে জড়িয়ে ছয়টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। ভুলতথ্যগুলোর ধরণ বুঝতে এগুলোকে রিউমর স্ক্যানার দুইটি আলাদা ভাগে ভাগ করেছে৷ সরকারের পক্ষে যায় এমন ভুল তথ্যের প্রচারকে ইতিবাচক এবং বিপক্ষে যায় এমন ভুলতথ্যের প্রচারকে নেতিবাচক হিসেবে ধরে নিয়ে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এসব ভুলতথ্যের সবগুলোতেই সরকারকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। 

গত মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে ১৬টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার সবগুলোতেই তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া, সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে জড়িয়ে ছয়টি, ড. আসিফ নজরুল, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে জড়িয়ে দুইটি করে এবং মাহফুজ আলমকে জড়িয়ে একটি ভুল তথ্য শনাক্ত করা হয়েছে। এসব অপতথ্যের সবগুলোতই তাদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। 

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে সর্বত্র। গেল বেশ কয়েক মাসে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অপতথ্যের প্রচার বৃদ্ধি পেয়েছে। সেপ্টেম্বরে এ সংক্রান্ত ১০টি অপতথ্য শনাক্ত হয়েছে।  

রিউমর স্ক্যানার সেপ্টেম্বর মাসের ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণে দেখেছে, এই সময়ে সক্রিয় রাজনীতিতে থাকা দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, তার অঙ্গসংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি (৬৯টি) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে জামায়াতকে জড়িয়ে ১১টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় ৯১ শতাংশ ক্ষেত্রেই দলটিকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানকে জড়িয়ে দুইটি অপতথ্য (দুটোই নেতিবাচক) প্রচার করা হয়েছে। দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে সেপ্টেম্বরে ৩৬টি (প্রায় ৯২ শতাংশই নেতিবাচক) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।

জামায়াতের পর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), তার অঙ্গসংগঠন এবং নেতাকর্মীদের জড়িয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য (৬৮টি) প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে বিএনপিকে জড়িয়ে ২২টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার সবগুলোতেই দলটিকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে নিয়ে চারটি (৭৫ শতাংশই নেতিবাচক) অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে। এর বাইরে ছাত্রদলকে জড়িয়ে এই সময়ে ১৮টি (সবগুলোই নেতিবাচক) ও যুবদলকে জড়িয়ে একটি (নেতিবাচক) অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।

এছাড়া, সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও দলটির নেতাকর্মীদের জড়িয়ে ২৩টি অপতথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার। এর মধ্যে দল হিসেবে এনসিপিকে জড়িয়ে দুইটি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার সবগুলোই দলটিকে নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। এই সময়ে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে একটি অপতথ্য (নেতিবাচক) শনাক্ত হয়েছে।

কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গ-ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন এবং নেতাকর্মীদের নিয়ে সেপ্টেম্বরে ১৪৫টি অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে ৬৪টি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে যার প্রায় ৯৮ শতাংশই দলটির পক্ষে ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টির সুযোগ রেখেছে। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে এই সময়ে ২৩টি অপতথ্য (সবগুলোই ইতিবাচক) প্রচারের প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়া দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে জড়িয়ে গত মাসে ১৮টি (৯৪ শতাংশই ইতিবাচক) ও যুবলীগকে জড়িয়ে পাঁচটি অপতথ্য (সবগুলোই ইতিবাচক) শনাক্ত করা হয়েছে। 

ভুল তথ্যের রোষানল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোও। সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে জড়িয়ে ছয়টিসহ এই বাহিনীকে জড়িয়ে ২৫টি ভুল তথ্যের প্রচার দেখেছে রিউমর স্ক্যানার। এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশকে জড়িয়ে ২৩টি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) জড়িয়ে ০৬টি, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীকে জড়িয়ে দুইটি এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও র‌্যাবকে জড়িয়ে একটি করে ভুল তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার।    

সেপ্টেম্বরে শনাক্ত হওয়া ভুল তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, এই সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি ভুয়া কনটেন্ট শনাক্ত হয়েছে ১৮টি। একই সময়ে ডিপফেক কনটেন্ট শনাক্ত করা হয়েছে ১৩টি। 

সেপ্টেম্বর মাসে সাতটি ঘটনা বা ইস্যুতে ভুল তথ্যের প্রচার ছিল। গত ০৯ সেপ্টেম্বরের ডাকসু নির্বাচন, ১১ সেপ্টেম্বরের জাকসু নির্বাচন, দুর্গাপূজা, এশিয়া কাপ, জাতিসংঘ অধিবেশন, খাগড়াছড়ির সহিংসতা ও গত ২৯ আগস্টের জাপা-জিওপি সংঘর্ষের ঘটনায় ভুয়া তথ্যের প্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে। এর মধ্যে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সর্বাধিক (৪৩টি) ভুয়া তথ্যের প্রচার দেখা গেছে। এছাড়া, খাগড়াছড়ির সহিংসতা ইস্যুতে ২০টি, জাকসু নির্বাচন ইস্যুতে ১৪টি, জাতিসংঘ অধিবেশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে ১৩টি, দুর্গাপূজা ও এশিয়া কাপ ইস্যুতে পাঁচটি করে এবং জাপা-জিওপি সংঘর্ষের ইস্যুতে দুইটি ভুয়া তথ্য শনাক্ত হয়েছে। 

গণমাধ্যমের নাম, লোগো, শিরোনাম এবং নকল ও ভুয়া ফটোকার্ড ব্যবহার করে ভুল তথ্য প্রচারের পরিমাণ আবার বৃদ্ধি পেতে দেখা যাচ্ছে৷ সেপ্টেম্বর মাসে এই পদ্ধতির ব্যবহার করে ৩৩টি ঘটনায় দেশের ১৫টি সংবাদমাধ্যমকে জড়িয়ে ৩৩টি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে।   

বার্তা প্রেরক

তানভীর মাহতাব আবীর

সিনিয়র ফ্যাক্টচেকার,

রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ। 

[email protected]

আরও পড়ুন

spot_img