খুলনার ধর্ষণ-ডাকাতির ঘটনাকে নিয়ে ভারতে সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার 

গত ১২ ডিসেম্বর, ২০২৩ হরিণটানা থানাধীন ঘোলা গ্রামস্থ এক হিন্দু বাড়িতে লুট ও ধর্ষণের ঘটনার খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এই ঘটনার পরে, কিছু ভারতীয় টুইটার (বর্তামানে এক্স) অ্যাকাউন্ট থেকে একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে খুলনার ওই হিন্দু নারীকে মুসলিমরা ধর্ষণ করেছে বলে দাবি করে বলা হয়, ‘খুলনার বটিয়াঘাটায় নববিবাহিত হিন্দু মহিলাকে ধর্ষণ এবং তার বাড়ি লুট করেছে ইসলামপন্থীরা।’

খুলনার ধর্ষণ

উক্ত দাবিতে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

তবে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, খুলনার হিন্দু নারী ধর্ষণ ও তার বাড়িতে লুটের ঐ ঘটনায় সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত করে সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ওই ঘটনায় কোনো মুসলিম ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা নেই বরং ওই ঘটনায় জড়িত তিনজনই হিন্দু ধর্মের।

দাবির পোস্টগুলোতে যমুনা টেলিভিশনকে সূত্র দেখানো হয় এবং যমুনা টেলিভিশনের একটি ভিডিও যুক্ত করতে দেখা যায়। তবে ওই ভিডিও প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ওই প্রতিবেদনে খুলনার হিন্দু নারী ধর্ষণের ঘটনায় মুসলিমরা জড়িত এমন কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই, বরং ওই প্রতিবেদনেই ধর্ষণের অভিযোগে গোবিন্দ নামের একজনকে আটক করা হয়েছে এমন তথ্য রয়েছে। এছাড়াও,  যমুনা টিভির অন্য কোনো প্রতিবেদনেও ওই ঘটনায় মুসলিমদের জড়িত থাকার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। খুলনার ওই ঘটনার ওপর যমুনা টিভির আরেক প্রতিবেদনে গোবিন্দ ফৌজদার, মিঠুন বিশ্বাস ও ধীমান ফৌজদার নামের তিন ব্যক্তির আটক হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। 

অর্থাৎ মিথ্যাভাবে যমুনা টিভিকে সূত্র দেখিয়ে যমুনা টিভির ওই ভিডিও প্রতিবেদন ব্যবহার করে খুলনায় হিন্দু নারী ধর্ষণ-ডাকাতির ঘটনায় মুসলিমদের দায়ী করে প্রচার করা হয়েছে।

ওই ঘটনার ওপর গত ১৩ ডিসেম্বর “প্রেমিকার বিয়ে ঠিক হওয়ায় ধর্ষণ করে বাড়িতে ডাকাতি” শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, 

“খুলনা শহরের কৈয়া বাজার এলাকার একটি বাড়িতে মা–বাবাকে অচেতন করে মেয়েকে (২৯) ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপর ওই বাড়ি থেকে প্রায় ৩ লাখ টাকা ও ১০ ভরি স্বর্ণালংকার ডাকাতি করেছেন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা। গত সোমবার রাত দুইটা থেকে চারটার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। ধর্ষণের শিকার তরুণীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়েছে। তিনি ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চিনতে পেরেছেন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। তাঁর তথ্যানুযায়ী পুলিশ অভিযান চালিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে একজন ধর্ষণ ও ডাকাতিতে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আজ বুধবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন গোবিন্দ ফৌজদার (৩০) ও ধীমান ফৌজদার (৩৫)। তাঁরা ডুমুরিয়া উপজেলার বাসিন্দা। ধীমান সোনার ব্যবসায়ী। গোবিন্দর স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ধীমানের কাছ থেকে লুট করা স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়। সকালে জ্ঞান ফিরলে মেয়ের বাবা নিজেদের তালাবদ্ধ অবস্থায় দেখে আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করে ব্যাপারটি জানান। গোবিন্দর সঙ্গে মেয়েটির প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তবে মেয়েটির অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় গোবিন্দ কৌশলে এ কাজ করেছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ।”

পুলিশ জানায়, “গত মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) ভোরে ডুমুরিয়া উপজেলার কৈয়া বাজার সংলগ্ন বাঁশগোলার পাশে অবসরপ্রাপ্ত উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তারা স্প্রে করে সবাইকে অজ্ঞান করে তার বাগদত্তা মেয়েকে ধর্ষণ করে। দুর্বৃত্তরা বাড়ি থেকে নগদ টাকা ও ১১ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে যায়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে গোবিন্দ নামে একজন যুবক বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। ওই প্রস্তাবে মেয়ের পরিববার রাজি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনজন মিলে তাকে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের শিকার মেয়েটি গোবিন্দকে শনাক্ত করেছে। এ ঘটনায় গোবিন্দসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। একইসঙ্গে লুণ্ঠিত স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়েছে। মামলার বাদী উদ্ধার করা মালামাল শনাক্ত করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার হওয়া আসামি গোবিন্দ ফৌজদার, মিঠুন বিশ্বাস ও ধীমান ফৌজদার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।”

ওই ঘটনার বিবরণী এবং আটককৃতদের বিস্তারিত তথ্য নিজেদের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেছে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ। ‘খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের হরিণটানা থানার দস্যুতা ও গণধর্ষণে সরাসরি জড়িত ০৩ জন আসামীকে লুণ্ঠিত স্বর্ণালংকারসহ গ্রেফতার’ শিরোনামের ওই বিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, 

“গত ১২ ডিসেম্বর ২০২৩ খ্রিঃ রাত অনুমান ০২.০০ ঘটিকা হতে ০৪.০০ ঘটিকার মধ্যে যে কোন সময় হরিণটানা থানাধীন ঘোলা গ্রামস্থ প্রনব কুমার মল্লিকের একতলা বিশিষ্ট বাড়িতে ০৩ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি দস্যুতা ও গণধর্ষণসহ স্বর্ণালংকার লুন্ঠন করে। তৎপ্রেক্ষিতে কেএমপির পুলিশ কমিশনার জনাব মোঃ মোজাম্মেল হক, বিপিএম (বার), পিপিএম-সেবা মহোদয়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও নির্দেশনায় হরিণটানা থানা পুলিশ দস্যুতা ও গণধর্ষণে সরাসরি জড়িত ১) গোবিন্দ ফৌজদার(৩০), পিতা-সুনিতী ফৌজদার, সাং-কুলটি, থানা-ডুমুরিয়া, জেলা-খুলনা; ২) মিঠুন বিশ্বাস(৩৫), পিতা-চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস, সাং-গঙ্গারামপুর, থানা-বটিয়াঘাটা, জেলা-খুলনা, এ/পি সাং-বানরগাতি সিটি গর্লস কলেজের পাশে, থানা-সোনাডাঙ্গা মডেল, জেলা-খুলনা এবং ৩) ধীমান ফৌজদার(৩৫), পিতা-প্রশান্ত ফৌজদার, সাং-কুলটি ফৌজদার পাড়া, থানা-ডুমুরিয়া, জেলা-খুলনাদের’কে লুণ্ঠিত স্বর্ণালংকারসহ গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। অত:পর মামলার বাদী উদ্ধারকৃত মালামাল শনাক্ত করেছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামী গোবিন্দ ফৌজদার, মিঠুন বিশ্বাস ও ধীমান ফৌজদার ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। অত্র মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।”

অর্থাৎ, ওই ঘটনায় জড়িত তিন জন ব্যক্তি হচ্ছেন গোবিন্দ ফৌজদার, মিঠুন বিশ্বাস ও ধীমান ফৌজদার, যারা তিনজনই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। 

সুতরাং, খুলনায় হিন্দু নারী ধর্ষণ ও তার বাসায় ডাকাতির ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে মুসলিমদের মিথ্যাভাবে সম্পৃক্ত করে সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img