২৫ নভেম্বর বিকেলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র এবং পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। ২৬ নভেম্বর তাকে চট্টগ্রাম ষষ্ঠ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কাজী শরীফুল ইসলামের আদালতে হাজির করা হলে জামিন নামঞ্জুর করেন আদালত। এর প্রেক্ষিতে আদালত প্রাঙ্গণে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরে চিন্ময়কে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হলে তার অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান আটকে দিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। একপর্যায়ে পুলিশ, বিজিবি লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বিক্ষোভকারীদের হটাতে পুলিশের সাথে যোগ দেন একদল আইনজীবীও। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। সংঘর্ষে সাইফুল ইসলাম নামের এক আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার এবং এর পরবর্তী সংঘর্ষ ও আইনজীবী নিহতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্যের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। রিউমর স্ক্যানার-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ইস্যুতে গণমাধ্যমের লোগো ব্যবহার করে অন্তত আটটি ভুয়া ফটোকার্ড ছড়ানো হয়েছে। এসব ফটোকার্ডে প্রচারিত গুজবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো—চিন্ময় স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছেন, শিশু বলাৎকারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ডিবি পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। এছাড়া সংঘর্ষে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী হিসেবে দাবি করেও গুজব ছড়ানো হয়েছে। এই গুজবের প্রবাহ কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ভারতীয় কিছু গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্স, ভয়েস অফ আমেরিকা এবং আরব নিউজের মতো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমেও এই বিষয়ে ভুয়া তথ্য প্রচারিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই, এর প্রতিক্রিয়ায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরটিভি এবং যমুনা টিভির লোগোযুক্ত দুইটি ফটোকার্ড ভাইরাল হয়। এতে দাবি করা হয়, তিনি স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেছেন। তবে, গণমাধ্যম দুটির কোনো প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। ফটোকার্ডগুলোও ভুয়া বলে অনুসন্ধানে জানা যায়।
পরদিন ২৬ নভেম্বর সকালে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চ্যানেল ২৪-এর লোগোযুক্ত আরেকটি ভুয়া ফটোকার্ড ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দাবি করা হয়, শিশু বলাৎকার এবং উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু চ্যানেল ২৪ এই ধরনের কোনো সংবাদ বা ফটোকার্ড প্রকাশ করেনি।
এসময় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে একটি নারী নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হয়। তবে, রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া যায়, ভিডিওটি ভারতের ‘বাবা বালকনাথ’ নামের এক ধর্মগুরুর এবং ভিডিওটি চিন্ময় কৃষ্ণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
চিন্ময় কৃষ্ণকে নিয়ে আদালতে শুনানি চলাকালে সামাজিক মাধ্যমে একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে বলা হয়, ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে তিনি স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, “শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারলে চট্টগ্রাম আমাদের দেওয়া হবে” এবং “আমার কোনো দোষ নেই, আমাকে যা বলতে বলা হয়েছিল, বাধ্য হয়ে তাই বলেছি।” এই দাবির সঙ্গে ডিবিসি এবং চ্যানেল ২৪-এর লোগোযুক্ত পৃথক ফটোকার্ডও ছড়ানো হয়। তবে অনুসন্ধানে এই ফটোকার্ডগুলোও ভুয়া প্রমাণিত হয়।
আদালত শুনানি শেষে জামিন আবেদন নামঞ্জুর হলে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে কারাগারে পাঠানোর জন্য প্রিজন ভ্যানে তোলা হয়। এ সময় তার অনুসারীরা প্রিজন ভ্যান আটকে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জ করে। সংঘর্ষ চলাকালে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম ওরফে আলিফ (৩৫) নিহত হন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, বিক্ষোভকারীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনা দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং এর প্রেক্ষিতে সামাজিক মাধ্যমে নানা গুজব ছড়াতে শুরু করে।
এ ঘটনায় সামাজিক মাধ্যমে সংঘর্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও প্রাণহানির দাবি ওঠে। বিভিন্ন পোস্টে নিহতদের নিয়ে বিভিন্ন সংখ্যা উল্লেখ (১,২) করে দাবি করা হয়। তবে, নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, আইনজীবী সাইফুল ইসলাম ছাড়া এ সংঘর্ষে আর কোনো মৃত্যুর প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এর মধ্যেই, নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে পরিকল্পিত হত্যার শিকার দাবি করে প্রোবীর চন্দ্র পাল নামের এক ব্যক্তির ফেসবুক পোস্টের দুটি স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে। একটি পোস্টে প্রোবীর লিখেছিলেন, “সমস্ত সনাতনী এডভোকেটরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আজকেই শুনানি দিতে হবে! নাহলে দায়রা জজ মো: সাইফুল ইসলামকে কোর্ট থেকে বের হতে দেবে না।” তবে, এখানে উল্লিখিত সাইফুল ইসলাম এবং নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম ভিন্ন ব্যক্তি। পোস্টে উল্লিখিত সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ, আর নিহত সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম আদালতের একজন সাধারণ আইনজীবী।

এর পাশাপাশি, ভারতের অসংখ্য এক্স ব্যবহারকারী এবং কিছু গণমাধ্যমে গুজব ছড়ায় যে, নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ ছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী, এবং সেই দায়িত্ব পালনের কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা রয়টার্সও চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা লিয়াকত আলীর বরাত দিয়ে এই দাবি উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের আইনজীবী হলেন সুভাশিস শর্মা। এ তথ্য চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া ওকালতনামা এবং আইনজীবী আলিফ নিহত হওয়ার আগে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।
এদিকে, আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজের ভিত্তিতে পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে বলে সামাজিক মাধ্যমে একটি দাবি (১,২) ছড়িয়ে পড়ে। দাবি করা হয়, আটক ব্যক্তিদের মধ্যে চারজন শিবিরের সদস্য এবং একজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। তবে, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র উপ-কমিশনার মো. রইস উদ্দিন এ বিষয়ে রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “এ ধরনের কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।” রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানেও দেখা গেছে, এই ভুয়া তথ্যটি ‘SadhinBangladeshNews’ নামের একটি ভুয়া পোর্টালের প্রতিবেদনের বরাতে ছড়ানো হয়েছে। অতীতেও এই পোর্টাল থেকে গুজব ছড়ানোর নজির পাওয়া গেছে।
অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হয়, আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন অন্তত ছয়জনকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। এছাড়া, সংঘর্ষ চলাকালে ভাঙচুর এবং পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে ২১ জনকে আটক করেছে সিএমপি। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র উপ-কমিশনার মো. রইছ উদ্দিন রিউমর স্ক্যানারকে জানান, আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে এখন পর্যন্ত সাতজনকে আটক করা হয়েছে। এদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য জানা যায়নি, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
এছাড়া, ইসকন সদস্য প্রবীর চন্দ্র পালকে কেন্দ্র করে দুটি ফটোকার্ড (১,২) ভাইরাল হয়, যেখানে সময় টিভি এবং চ্যানেল ২৪-এর লোগো ব্যবহার করে দাবি করা হয় যে তিনি ফেসবুকে লিখেছেন: “প্রভুকে মুক্তি না দিলে আরও লাশ পড়বে, ৩ কোটি সনাতনী মাঠে থাকবে” এবং “ইসকন নিষিদ্ধ করতে চাইলে পুরো বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ করে দেবে ভারত”। তবে, এই দাবিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা। প্রবীর চন্দ্র পাল এমন কোনো স্ট্যাটাস দেননি এবং সময় টিভি ও চ্যানেল ২৪-এর পক্ষ থেকেও এ ধরনের কোনো ফটোকার্ড প্রকাশ করা হয়নি। গণমাধ্যমের লোগো ব্যবহার করে ভুয়া ফটোকার্ড তৈরি করে এই মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে।
চিন্ময়ের জামিন ইস্যুতে সৃষ্ট অপ্রীতিকর পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারী এক্সে একটি ভিডিও শেয়ার করে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ তোলেন। তবে, ভিডিওটি ঢাকার তিনটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের দৃশ্য। এটি হিন্দু নির্যাতনের কোনো ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
চিন্ময় কৃষ্ণ সমকামী কমিউনিটি এলজিবিটিভি-এর স্বনামধন্য সদস্য দাবিতে ভারতীয় গণমাধ্যম রিপাবলিক বাংলার বরাতে সময় টিভির লোগো সম্বলিত একটি ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তবে যাচাইয়ে দেখা গেছে, রিপাবলিক বাংলা এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি এবং সময় টিভিও এ ধরনের কোনো ফটোকার্ড প্রচার করেনি।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s Investigation.
- Dhaka Post: চট্টগ্রামের আদালতে নেওয়া হলো চিন্ময় কৃষ্ণকে
- Prothom Alo: চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে চিন্ময় অনুসারীদের সংঘর্ষ, আইনজীবীকে হত্যা
- Dainik Azadi: চট্টগ্রাম মহানগরে নতুন দায়রা জজ সাইফুল ইসলাম
- Najam Uddin: Facebook Post
- Ajker Patrika: চট্টগ্রামে আইনজীবীকে হত্যা: রাতভর যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক ৩০
- Chief Adviser GOB: Facebook Post
- Bdnews24: Facebook Post
- Statement from CMP’s Deputy Commissioner Rais Uddin.
সংশোধন/ Correction
২৮ নভেম্বর ২০২৪ : চট্টগ্রামে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ চট্টগ্রাম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর নন। তবে আমাদের প্রতিবেদনে দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর বরাতে তাকে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর উল্লেখ করা হয়েছিল। নিহত সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম আদালতের একজন সাধারণ আইনজীবী। চট্টগ্রাম আদালতে সাইফুল ইসলাম চৌধুরি নামের আরেক ব্যক্তি সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে কর্মরত আছেন। প্রায় একই নামের আরেক ব্যক্তি এই পদে কর্মরত থাকায় বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্লাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের এক প্রতিবেদনের বদৌলতে বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় প্রতিবেদনটি সংশোধন করা হয়।