ভ্রমণ করতে কে না পছন্দ করে! কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই এমন আছেন যাদের কাছে ভ্রমণ একটি আতঙ্কের নাম। এর কারণ হলো যাত্রাপথের অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা। অনেকেই বাস, ট্রেন, লঞ্চ বা বিমানে যাত্রার সময় গা গুলিয়ে ওঠা, মাথা ঘোরা, বমিসহ আরও কিছু শারীরিক জটিলতায় ভোগেন। এই অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় মোশন সিকনেস।
মোশন সিকনেস আসলে কী?
কোনো ব্যক্তির গতিশীল অবস্থার কারণে দেহের অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য রক্ষিত না হলে অনেকেই বমি বমি ভাব, মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, গা গুলিয়ে ওঠাসহ একাধিক শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। এটিই মোশন সিকনেস নামে পরিচিত। বাস-ট্রেন, জাহাজ-নৌকা কিংবা উড়োজাহাজ, যেকোনো পথে ভ্রমণের ক্ষেত্রেই মোশন সিকনেস দেখা দিতে পারে। এমনকি সুউচ্চ ভবনের লিফটেও হতে পারে মোশন সিকনেস। সমুদ্র পথে যাত্রাকালে সৃষ্ট মোশন সিকনেসকে ‘সি সিকনেস’ও বলা হয়। অর্থাৎ, মোশন বা গতির কারণে যাত্রাপথে অনেকেই যে বমিসহ অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতায় ভোগেন সেটিই হলো মোশন সিকনেস।
মোশন সিকনেস কেন হয়?
যখন আমাদের দেহের দুটি সেন্সরি স্নায়ু (দর্শন এবং ভারসাম্য রক্ষা) দেহের গতীয় অবস্থা সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী সংকেত মস্তিষ্কে প্রেরণ করে, তখন আমাদের মস্তিষ্ক দেহের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের এই বিভ্রান্তিকর অবস্থার ফলেই মাথা ঘোরা, বমি-বমিভাব সহ একাধিক শারীরিক জটিলতার উদ্ভব হয়।
মোশন সিকনেসের পুরো প্রক্রিয়াটি বুঝতে হলে দেহের ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
আমাদের দেহের ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া
আমরা জানি কান আমাদের শ্রবণ অঙ্গ। তবে আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জানেন না, শ্রবণের পাশাপাশি কানের একটি অংশ দেহের ভারসাম্য রক্ষাতেও অদ্বিতীয় ভূমিকা পালন করে। আমাদের কান মূলত তিনটি প্রধান অংশে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো- বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ, অন্তকর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্যমতে, আমাদের অন্তকর্ণে কিছু অর্ধ-বৃত্তাকার নালিকা ও দুটি অটোলিথ অর্গান রয়েছে যেগুলো একধরনের তরল পদার্থ দ্বারা পূর্ণ থাকে। যখন আমরা আমাদের মাথা দোলাই তখন অন্তকর্ণের ভেতরে থাকা তরলও দুলতে থাকে। অন্তকর্ণের তরলের এই স্থানচ্যুতির ফলে মস্তিষ্কে সংকেত প্রেরিত হয়। এই সংকেতের ফলে মস্তিষ্ক আমাদের দৈহিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে। এরপর মস্তিষ্ক সেই সংকেত অনুযায়ী দেহের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংকেত প্রেরণ করে। এভাবেই অন্তকর্ণের মাধ্যমে মানবদেহের ভারসাম্য রক্ষিত হয়।
এবার মোশন সিকনেসের যেভাবে সংঘটিত হয় সে প্রক্রিয়ায় আসা যাক। যখন আমরা বাস, জাহাজ কিংবা উড়োজাহাজে ভ্রমণ করি তখন আমরা আমাদের চারপাশের প্রকৃতি গতিশীল দেখি। ফলে, আমাদের চোখ মস্তিষ্কে যে দর্শন অনুভূতি প্রেরণ করে সে অনুসারে মস্তিষ্ক ভাবে যে আমাদের দেহ গতিশীল আছে। আবার একই সাথে আমাদের দেহ স্থির থাকার কারণে অন্তকর্ণ মস্তিষ্কে স্থির অবস্থায় থাকার সংকেত প্রেরণ করে। একই দেহের দুটি ভিন্ন সেন্সরি স্নায়ু (দর্শন ও ভারসাম্য রক্ষা) দুইটি ভিন্ন অবস্থার অনুভূতি মস্তিষ্কে প্রেরণ করায় মস্তিষ্ক বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং দেহের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ করতে জটিলতার সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কের এই বিভ্রান্তিকর অবস্থার ফলেই আমাদের মাথা ঘোরা, গা গুলানো কিংবা বমির মত সমস্যার উদ্রেক হয়।
মোশন সিকনেস কতক্ষণ থাকে
যাত্রা বা ভ্রমণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মোশন সিকনেস ঠিক হয়ে যায়। তবে কারো কারো চার ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত এর প্রভাব থাকতে পারে। যদি ঘনঘন বমি হয় তবে মোশন সিকনেসের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে ও পানিশূন্যতা রোধে ওরস্যালাইন পান করা যেতে পারে।
মোশন সিকনেস কাদের বেশি হয়?
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্য অনুসারে যেসকল ফ্যাক্টর মোশন সিকনেসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় সেগুলো হলো:
- জেন্ডার: মেয়েদের মোশন সিকনেস ছেলেদের তুলনায় বেশি।
- বয়স: ৬ বছর বয়স থেকে মোশন সিকনেস দেখা দেয় এবং ৯ বছর বয়সে এ সংক্রান্ত জটিলতা চরমে পৌঁছায়। তবে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে অভিযোজনের মাধ্যমে এ সমস্যা কমতে থাকে। কিন্তু, বৃদ্ধদের মোশন সিকনেসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বেশি।
- হরমোন: গর্ভধারণ কিংবা ঋতুচক্রের সময় হরমোনাল ইমব্যালেন্স তৈরি হলে মোশন সিকনেসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- প্রসূতিরোগ ও মাইগ্রেনের সমস্যা থাকলে মোশন সিকনেস হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
মোশন সিকনেস থেকে বাঁচতে হলে
মোশন সিকনেস থেকে নিজেকে দূরে রাখতে বেশকিছু বিষয় খেয়াল রাখা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্যমতে মোশন সিকনেস প্রশমিত করতে নিম্নোক্ত উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে-
- ভ্রমণকালে মাথা, কাঁধ, নিতম্ব ও হাঁটুর নড়াচড়া কমিয়ে দেওয়া।
- চলন্ত গাড়িতে বইপত্র কিংবা ম্যাগাজিন পড়া থেকে বিরত থাকা।
- গাড়ির সামনের দিকে বসা; যাতে সামনের দৃষ্টি প্রসারিত থাকে।
- দ্রুত চলমান কিছুর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া; এক্ষেত্রে স্থির দিগন্তে দৃষ্টি আবদ্ধ রাখা যেতে পারে।
- চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে শ্বাসগ্রহণ করা।
- নিকোটিন ও অ্যালকোহল সেবন থেকে বিরত থাকা।
- দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ভ্রমণ থেকে বিরত থাকা।
- ভ্রমণের ক্ষেত্রে শীতল ও সুখকর গান শোনার পরামর্শও দেওয়া হয়।
মূলত, চলন্ত গাড়িতে দেহের সেন্সরি স্নায়ু মস্তিষ্কে পরস্পরবিরোধী সঙ্কেত পাঠানোর প্রেক্ষিতে আমাদের মোশন সিকনেস হতে পারে। মোশন সিকনেসের শিকার হওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ সমস্যা অনেকটাই কেটে যায়। তবে বয়স বাড়ার পরও যারা এ সমস্যায় ভোগেন যাত্রাকালে তারা কিছু ছোট বিষয় মাথায় রাখলেই এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
তথ্যসূত্র
- National Library of Medicine: “How does our sense of balance work?”
- National Library of Medicine: “Motion Sickness”
- Mount Sinai Hospital: “Motion Sickness”
- BBC Bangla: “মোশন সিকনেস: কী, কেন হয়, কিভাবে সুস্থ থাকবেন”
- The Daily Star: “ভ্রমণে বমি-মাথা ঘোরানোর সমস্যা কাটিয়ে উঠবেন যেভাবে”