“মিষ্টি”-বাঙালীর আবেগের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই ছোট্ট শব্দটি। দৈনন্দিন আহারে শেষ পাতে একটু মিষ্টি না হলে যেমন বাঙালীর মন ভরে না, তেমনই কোনো সুখবর দিতে বা শুভ কাজ শুরু করতে মিষ্টিমুখ করা যেন অত্যাবশ্যকীয়। তবে মিষ্টিকে মিষ্টি করে তোলে যে “চিনি”, সে-ই নাকি মানব স্বাস্থ্যের আসল ভিলেন। আসলেই কি তাই? এদিকে চিনি যেহেতু আখ থেকে উৎপাদিত হয় তাই কেউ কেউ আখ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হলে চিনি কেন ক্ষতিকর এমন প্রশ্নও করছেন। তাই চিনিকে ঘিরে শুনতে পাওয়া নানা গুঞ্জনের অবসান ঘটাতেই রিউমর স্ক্যানারের এই প্রতিবেদন।
চিনি নিয়ে যে তথ্য বেশ প্রচলিত
২১ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে জাতীয় দৈনিক ‘কালের কন্ঠ’-এ “চিনির ৮ টি মারাত্মক ক্ষতিকর দিকদিনে কতটুকু চিনি খাব? চিনির যত ক্ষতিকর দিক” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
এই প্রতিবেদনটিতে চিনি খাওয়ার ফলে লিভারের ক্ষতি হওয়া, ডায়বেটিস হওয়া, রক্ত চলাচলে বাঁধা, মুটিয়ে যাওয়া, বুড়িয়ে যাওয়ার মতো শারীরিক সমস্যাগুলোর জন্য চিনিকে দায়ী করা হচ্ছে।
১৩ নভেম্বর ২০২২ তারিখে ‘science bee-বিজ্ঞান গ্রুপ’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে “চিনি সাধারনত আখ থেকে তৈরি। কিন্তু আখ মানুষের জন্য খুবই উপকারী হলেও চিনি প্রচন্ড রকম ক্ষতিকর কেনো? আমরা যত খুশি আখ খেতে পারলেও চিনি খেতে পারিনা কেনো?” শীর্ষ শিরোনামে একটি Mamun Miah BD নামে একটি আইডি থেকে পোস্ট করা হয়।
২ এপ্রিল ২০২১ তারিখে Diet Falsafa: The Natural Health Club নামে ফেসবুক গ্রুপ এ “চিনি এত দোষ করলো কিসে তা জানার আগ্রহ আমার বহু দিনের। ইক্ষু এত অচ্ছুৎ হয়ে গেলো কবে থেকে জানতে মন চায়” শীর্ষক শিরোনামে একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়।
চিনি কী?
চিনি হচ্ছে দ্রবণীয় কার্বোহাইড্রেটের জেনেরিক নাম।
এটি দুই ধরণের হতে পারে- সাধারণ শর্করা ও জটিল শর্করা। সাধারণ শর্করাকে মনোস্যাকারাইডও বলা হয়, এর মধ্যে রয়েছে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ এবং গ্যালাকটোজ। অন্যদিকে যৌগিক শর্করাকে বলা হয় ডাইস্যাকারাইড বা ডাবল শর্করাও, দুটি বন্ধনযুক্ত মনোস্যাকারাইড দিয়ে তৈরি অণু; সাধারণ উদাহরণ হল সুক্রোজ (গ্লুকোজ + ফ্রুক্টোজ), ল্যাকটোজ (গ্লুকোজ + গ্যালাকটোজ), এবং মল্টোজ (গ্লুকোজের দুটি অণু)। সাদা চিনি সুক্রোজের একটি পরিশোধিত রূপ।
চিনি কীভাবে উৎপাদিত হয়?
চিনি উৎপাদিত হয় আখ ও সুগার বিট থেকে। সুগার বিট হচ্ছে একধরণের ফল যা মাটির নীচে হয়। দেখতে অনেকটা মূলার মতো। উৎপাদিত মোট চিনির ৫৫% আসে সুগার বিট থেকে। বাকি ৪৫% উৎপাদিত হয় আখ থেকে।
মূলত আখ থেকে রস বের করে তা পরিশোধন ও ফিল্টার করে একে এক ধরণের সোনালী ক্রিস্টালে রূপান্তরিত করা হয়, এই সোনালী ক্রিস্টালই হচ্ছে লাল চিনি। পরবর্তীতে একে শোধনাগারে পাঠিয়ে সাদা করা হয়। আর চিনি যদি সুগার বিট থেকে উৎপাদন করা হয়। সেক্ষেত্রে বিটগুলোকে কেটে পানিতে সেদ্ধ করে রস করে নেওয়া হয়। এবং পরবর্তীতে একই পদ্ধতিতে ক্রিস্টালে পরিণত করা হয় সেই চিনিকে।
আখ ও চিনির পার্থক্য
আখ প্রকৃতপক্ষে একধরনের ঘাস। এটি অ্যান্ড্রোপ্রোগোনাই গোত্রের স্যাক্রাম প্রজাতির ঘাস। এটি সুক্রোজ সমৃদ্ধ লম্বা প্রকৃতির উদ্ভিদ। চিনি আখের রস থেকে উৎপাদিত হয়। আখ আর চিনির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে এই দুইয়ের মধ্যে উপস্থিত পানির পরিমাণ। আখের রসে প্রায় ৭০-৭৫% পানি, ১০-১৫% ফাইবার এবং সুক্রোজ আকারে ১৩-১৫% চিনি থাকে। ঐ ১৩-১৫% সুক্রোজকে ফ্যাক্টরিতে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বের করে এনে চিনি উৎপাদন করা হয়।
আখে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর এক অপরিহার্য উপাদান। আখের রয়েছে আরও কিছু গুণ।
ভারতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা সংস্থা ‘Healthifyme.com’ এর মতে আখ যকৃতের কার্যকারিতা বাড়ায়, ক্যানাসের ঝুঁকি কমায়, হজম শক্তি বৃদ্ধি করে, কিডনির স্বাস্থ্য ভালো রাখে, ডায়বেটিসের জন্য উপকারী, STD (Sexually Transmitted Disease) ও UTI (ব্যাক্টেরিয়াজনিত এক ধরণের ইনফেকশোন) এর ব্যাথা উপশমে উপকারী, হাড় ও দাঁতের বৃদ্ধির জন্য উপকারী ও মুখে ব্রণের সমস্যা দূর করে।
খাবারে চিনির ব্যবহার
কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবারে প্রাকৃতিকভাবেই চিনি থাকে। অর্থাৎ যেকোনো ফল, সবজি, শস্য দুগ্ধজাতীয় খাবারে প্রাকৃতিকভাবেই চিনি পাওয়া যায়। এছাড়া, খাবারকে আরও সুস্বাদু করতে সকল সভ্যতায়ই মিষ্টির আবেদন অনস্বীকার্য। মিষ্টিজাতীয় খাবার, কেক, পাই, জুস ইত্যাদি তৈরীতে চিনির চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বিশ্বজুড়েই শীর্ষে। আধুনিক সমাজের জনপ্রিয় সব খাবার যেমন বার্গার, পিৎজা, সফট ড্রিংকস, চা-কফি এবং অন্যান্য প্রসেসড ফুডেও থাকে চিনি।
এছাড়া, বাঙালীর রন্ধনশিল্পে চিনির মর্যাদা আলাদা করে উল্লেখ করবার মতোই। জন্মদিনের পায়েস থেকে ঈদের সেমাই, প্রতিদিনের চা, দাওয়াতের দই-মিষ্টি, মিষ্টি পানসহ কতরকমের মিষ্টি যে বাঙালীর ঝোলায় রয়েছে তা হিসেব করা মুশকিল হয়ে যাবে। আর এর সব কিছুতেই দরকার চিনি।
চিনির বিকল্প হিসেবে মধু, গুড় ও নানা ধরণের সুগার ট্যাবলেট বাজারে থাকলেও চিনির জায়গা কেউ নিতে পারেনি এখনো।
চিনি ভিলেন কবে থেকে?
চিনি উদ্ভাবনের পর থেকে রাজ করছিলো বিশ্বজুড়ে। তবে জন ইউডকিন নামে একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানি “Pure, White, and Deadly” নামে তার লেখা বইতে ১৯৭২ সালে প্রথম চিনির ক্ষতিকর দিক নিয়ে কথা বলেন।
কিন্তু বইটি প্রকাশের পর কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখেনি, বরং এই বইটি লেখার ফলে তার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। তৎকালীন পুষ্টিবিদ ও খাদ্য শিল্পের সাথে জড়িতরা তাঁর চিনি সম্পর্কে এই অনুসন্ধান মেনে নিতে পারেনি এবং তারা একজোট হয়ে তার বিরোধিতা করে। কারণ তারা মনে করতেন স্থুলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস এর মতো রোগগুলো চর্বি গ্রহণের ফলে হয়ে থাকে। এই ধারণা ভেঙে তারা চিনিকে এসব রোগের কারণ হিসেবে মেনে নিতে চাননি।
পরবর্তীতে, ২০০৯ সালে রবার্ট লাস্টিগ নামে একজন পেডিয়াট্রিক এন্ডোক্রিনোলোজিস্ট ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে “Sugar: The bitter truth” শিরোনামে একটি বক্তব্য দেন।
ঐ বক্তব্যে তিনি আমেরিকার স্থুলতা মহামারীর জন্য চিনিকে “বিষ” হিসেবে উল্লেখ করেন।
ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘The guardian’ এ প্রকাশিত “The Sugar Conspiracy” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “আমরা গত ৪০ বছর ধরে যে পুষ্টিগত পরামর্শের উপর নির্ভর করছি, তা ত্রুটিপূর্ণ ছিলো। এই ত্রুটির দ্বায় কোনো করপোরেট কর্তৃপক্ষের উপর চাপানো যায় না বা কোনো বৈজ্ঞানিক ভুলের উপরও চাপানো যায় না। জন ইউডকিনের সাথে যা হয়েছে তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই ভুল বিজ্ঞানীরা নিজেরা নিজেদের সাথে করেছে, যার ফল ভোগ করেছি আমরা”
চিনি কি সত্যিই ক্ষতিকর?
১৯৮০ সালে আমেরিকার বিখ্যাত সব পুষ্টিবিদদের সাথে দীর্ঘ পরামর্শের পর আমেরিকান সরকার কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার খাওয়ার গাইডলাইন দেয় জনগণকে। খাদ্য উৎপাদন কোম্পানিগুলোও এই গাইডলাইনের উপর ভিত্তি করে খাবার বাজারজারত করতে শুরু করে। কিন্তু এই গাইডলাইন অনুযায়ী খাদ্য গ্রহণ করার পরও আমেরিকার জনগণেরা সুস্থ সবল না হয়ে বরং আরও স্থুল ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। দেখা যায় আমেরিকার জনগণের খাদ্যতালিকায় ফ্যাট বা চর্বির পরিমাণ খুবই কম তবে চিনি বা কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ খুবই বেশী। ফলস্বরূপ তারা মোটা হয়ে যাচ্ছে।
৬ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে আমেরিকার হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের (HMS) ভোক্তা স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ এর ওয়েবসাইট ‘Harvard Health Publishing’ এ “The sweet danger of sugar” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়।
হার্ভাড টি. এইচ. চ্যান স্কুল অব পাবলিক হেলথ এর পুষ্টিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্ক হু বলেন, “স্থুলতা ও ডায়েবেটিসের উপর অতিরিক্ত চিনির প্রভাব সম্পর্কে সবাই জানলেও হৃদয়ের উপরও যে চিনির মারাত্মক প্রভাব আছে তা জানলে মানুষ অবাক হয়ে যাবে।”
হার্ভার্ডের ঐ প্রতিবেদনটিতে ২০১৪ সালে JAMA International Medicine প্রকাশিত একটি গবেষণার কথা উল্লেখ আছে। ড. ফ্র্যাঙ্ক হু এবং তাঁর কয়েকজন কলিগ মিলে এই গবেষণাটি করেছিলেন। ১৫ বছর ধরে যারা গ্রহণকৃত মোট ক্যালরির ১৭%-২১% নিয়েছেন চিনি থেকে এবং যারা গ্রহণকৃত মোট ক্যালরির ৮% চিনি থেকে নিয়েছেন তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকির অনুপাত নিয়ে করা হয় এই গবেষণা। ফলাফলে দেখা যায় মোট গ্রহণকৃত ক্যালরির ৮% যারা চিনি থেকে নিয়েছেন তাদের তুলনায় যারা ১৭%-২১% নিয়েছেন চিনি থেকে তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি ৩৮% বেশি ছিলো।
চিনি উচ্চরক্তচাপ, ক্ষুধা মন্দা, ক্রোনিক ইনফ্ল্যামেশন বাড়িয়ে দেয়।
৩ আগস্ট, ২০২২ তারিখে Times of India তে প্রকাশিত “How sugar manipulates you to overeat” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, আমাদের ব্রেইন এ দুই ধরণের হরমোন এর পারস্পরিক যোগাযোগের ফলে আমরা ক্ষুধার্ত অনুভব করি এবং পেট ভরে গেলে বুঝতে পারি। চিনি এই দুই হরমোনের যোগাযোগকে ব্যাহত করে। ফলে মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না পেট ভরে গেছে কিনা। অন্যদিকে চিনি পেট ভরে যাওয়ার অনুভূতি দেয় যে হরমোন তাকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, এবং অন্ত্রের হরমোনগুলোকে ট্রিগার করে খাওয়া চালিয়ে যেতে প্ররোচিত করে। ফলে শরীরে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
গ্রেস ডেরোচা নামে একজন নিবন্ধিত ডায়েটিশিয়ান, সার্টিফাইড ডায়াবেটিস শিক্ষাবিদ এবং মিশিগানের ব্লু ক্রস ব্লু শিল্ডের সার্টিফাইড স্বাস্থ্য প্রশিক্ষক জানান, আমাদের শরীর চিনিকে ভেঙে গ্লুকোজে পঅরিণত করে। গ্লুকোজ শরীরে শক্তি দেয়। তবে প্রয়োজনের চেয়ে বেশী গ্লুকোজ যখন শরীরে থেকে যায় তখন তা চর্বিতে রূপান্তরিত হয়, যা শরীরের জন্য খুব একটা ভালো নয়। এই চর্বির কারণেই স্থুলতাসহ অন্যান্য রোগ তৈরী হতে পারে।
এছাড়া অতিরিক্ত চিনি খেলে দাঁতের ক্ষয়, যকৃতের মেদসহ টাইপ টু ডায়েবেটিস, ক্যান্সার ও স্ট্রোক হওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা থেকে যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী দিনে ৬ চা চামচ এবং একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ দিনে ৯ চা চামচ চিনি খেতে পারেন। এর বেশী চিনি খেলে শরীরে বাসা বাধতে পারে স্থূলতা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগের মতো অসংক্রামক রোগব্যাধি।
অর্থাৎ, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবে, মানব শরীরে চিনির যে একেবারেই প্রয়োজনীয়তা নেই তা নয়। নির্দিষ্ট মাত্রার চিনি যদি শরীরে না পৌঁছায় সেক্ষেত্রেও নানা ধরণের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
লাল চিনি কি সাদা চিনির চেয়ে স্বাস্থ্যকর?
লাল চিনি ও সাদা চিনি উভয়ই উৎপাদিত হয় আখ ও সুগার বিট থেকে। দুই চিনির গুণ ও স্বাদে খুবই সামান্য পার্থক্য আছে।
লাল চিনিতে খণিজ ও ভিটামিনের পরিমাণ সাদা চিনির থেকে সামান্য পরিমাণে বেশী বিদ্যমান। অন্যদিকে ক্যালরির পরিমাণ সাদা চিনির থেকে সামাণ্য পরিমাণে কম বিদ্যমান। ১ চা চামচ সাদা চিনিতে ক্যালরির পরিমাণ ১৬.৩। অন্যদিকে ১ চা চামচ লাল চিনিতে ক্যালরির পরিমাণ ১৫।
এই দুই চিনির উৎপাদনে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। সাদা চিনি একটি বিশুদ্ধকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত হয়। আখ অ সুগার বিট থেকে প্রথমে “মোলাস” নামের বাদামী একটি সিরাপ তৈরী করা হয়। পরে ঐ সিরাপকে বিশুদ্ধ করে সাদা চিনি উৎপাদন করা হয়। লাল চিনিতে ঐ বাদামী রঙটা ধরে রাখার জন্য প্রক্রিয়াকরণ কম করা হয়। তবে, বর্তমানে সাদা চিনির সঙ্গে মোলাস নামের ঐ বাদামী সিরাপকে মিশিয়ে লাল চিনি উৎপাদন করা হয়।
প্রকৃতপক্ষে উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যতীত এই দুই চিনির গুণগত পার্থক্য খুব একটা নেই।
চিনি খাওয়া একেবারে বাদ দিয়ে দিলে কী হবে?
চিনির যেহেতু এতো অপকারীতা তাহলে চিনি খাওয়া কি একেবারে বন্ধ করে দেওয়াই ভালো? উত্তর হচ্ছে- “না”। চিনি আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাদ্য উপাদান। তবে প্রয়োজনের থেকে কয়েক গুণ বেশী চিনি আমরা প্রতিদিন জেনে বা না জেনে গ্রহণ করছি। তাই এটি আমাদের শরীরকে অসুস্থ করে তুলছে। শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার চিনির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
মিশিগানের ব্লু ক্রস ব্লু শিল্ডের সার্টিফাইড স্বাস্থ্য প্রশিক্ষক গ্রেস ডেরোচা বলছেন চিনি খাওয়া একেবারে বন্ধ করে দিলে ক্লান্তি, মাথাব্যথা, ব্রেইন ফগ এবং বিরক্তি, হরমোনাল ইমব্যালেন্স এমনকি গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ডিস্ট্রেস এর মতো সমস্যাও হতে পারে।
ভারতীয় সংবাদপত্র Times of India বলছে প্রয়োজনীয় চিনি না পেলে আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে।
মূলত, শর্করা জাতীয় প্রত্যেকটি খাবারে প্রাকৃতিকভাবেই চিনি থাকে। অর্থাৎ যেকোনো ফল, সবজি, শস্য দুগ্ধজাতীয় খাবারে প্রাকৃতিকভাবেই চিনি পাওয়া যায়। এর বাইরে প্রতিনিয়ত চা-কফি, প্রসেসড ফুড (বার্গার, পিৎজা ইত্যাদি) এ প্রচুর পরিমাণে চিনি থাকে। অতিরিক্ত মাত্রায় চিনি গ্রহণে স্থুলতাসহ নানা ধরণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণা থেকে পুষ্টিবিদ ও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে যারা প্রাকৃতিক চিনির বাইরে অতিরিক্ত চিনি খান না তাদের তুলনায় যারা নিয়মিত অতিরিক্ত চিনি খান তাদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ, ক্ষুধা মন্দা, ক্রোনিক ইনফ্ল্যামেশন, দাঁতের ক্ষয়, যকৃতের মেদসহ টাইপ টু ডায়েবেটিস, ক্যান্সার ও স্ট্রোকের ঝুঁকি অনেক বেশী থাকে।
তবে চিনি একাবারে বাদ দিয়ে দেওয়াও স্বাস্থ্যের পক্ষে হুমকিস্বরূপ হতে পারে। তাই শরীরের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু চিনি গ্রহণের পরামর্শই দেয় পুষ্টিবিদরা। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী দিনে ৬ চা চামচ এবং একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ দিনে ৯ চা চামচ চিনি খেতে পারেন বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
অন্যদিকে চিনি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর হলেও চিনির উৎস আখ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আখের রসে প্রায় ৭০-৭৫% পানি, ১০-১৫% ফাইবার এবং সুক্রোজ আকারে ১৩-১৫% চিনি থাকে। আখে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর এক অপরিহার্য উপাদান। আখ যকৃতের কার্যকারিতা বাড়ায়, ক্যানাসের ঝুঁকি কমায়, হজম শক্তি বৃদ্ধি করে, কিডনির স্বাস্থ্য ভালো রাখে, ডায়বেটিসের জন্য উপকারী, STD(Sexually Transmitted Disease) ও UTI(ব্যাক্টেরিয়াজনিত এক ধরণের ইনফেকশোন) এর ব্যাথা উপশমে উপকারী, হাড় ও দাঁতের বৃদ্ধির জন্য উপকারী ও মুখে ব্রণের সমস্যা দূর করে।
সুতরাং, অতিরিক্ত মাত্রায় চিনি গ্রহণ শরীরে নানা ধরণের রোগ সৃষ্টি করলেও আখ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী একটি খাবার।
তথ্যসূত্র
- Harvard Health Publishing: The sweet danger of sugar
- The Guardian: The Sugar Conspiracy
- Times of India: How sugar manipulates you to overeat
- Insider: What happens to your body and brain when you stop eating sugar
- Healthifyme: 10 Amazing Benefits Of Sugarcane Juice
- Talks at Google: Sugar: The bitter truth
- America’s Heartland: Special Episode: Sugar Beet Harvest – America’s Heartland
- America’s Heartland: Louisiana Sugarcane Farmer – America’s Heartland
- Healthdirect: Sugar
- Healthline: Brown Sugar vs. White Sugar: What’s the Difference?