বজ্রপাতে নিহত হলে সেই লাশ প্রাকৃতিক চুম্বক বা মূল্যবান বস্তুতে পরিণত হয় এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম-মফস্বল অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। এছাড়া বজ্রপাত হলে লাশ চুম্বক হয়ে যায় এমন ধারণাও পোষণ করেন অনেকে। ফলে বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির লাশ চুরির প্রবণতা থাকে এমনকি কবর খুঁড়ে লাশের কঙ্কাল চুরি হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এতে করে বজ্রপাতে নিহত হলেই সংশ্লিষ্ট পরিবার এবং এলাকার মধ্যে লাশ চুরি হওয়া নিয়ে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করে।
বিভিন্ন সময়ে লাশ চুরি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নমুনা
১. ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে নাটোরের লালপুরের ওয়ালিয়া গ্রামে হাফিজুর রহমান নামে একজন ব্যক্তি বজ্রপাতে নিহত হওয়ার পর মৃতদেহ বাড়ির বাইরে দাফন করলে চুরি হয়ে যাবে বলে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আতঙ্কিত হয়ে পরিবারের লোকজন মৃতদেহটি নিজ বাড়ির একটি ঘরের মেঝেতে দাফন করে কবর পাকা করে দেন।
২. ২০১৮ সালের মে মাসে রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলায় বজ্রপাতে নিহত যুবক মতিন মণ্ডলকে কবর দেওয়ার পর লাশ চুরি হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় রাত জেগে কবর পাহারা দেয় তার পরিবারের স্বজন ও আশে-পাশের অন্যরা। তাদের মধ্যে এতটাই আতঙ্ক তৈরি হয় যে পরদিনই তারা কবরটি সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে ফেলে।
৩. ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে কলেজছাত্র আরিফুল ইসলাম বজ্রপাতে মারা যায়। আরেকটা ধারনা প্রচলিত রয়েছে যে বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির লাশের মাথা কবিরাজী শাস্ত্রে অনেক মূল্যবান তাই আরিফুলের লাশ চুরি হওয়ার আশঙ্কায় কবরের পাশে তাঁবু টাঙিয়ে রাত দিন পাহারা দেন নিহতের পরিবার। সেসময়ে লাশ চুরি ঠেকাতে এভাবে তিন মাস পাহারা দিবেন বলে জানিয়েছিলেন পরিবারটি।
৪. ২০২১ সালের ০৪ ই আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ চরপাঁকার তেলিখাড়ি ঘাটে বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। বজ্রপাতে কারও মৃত্যু হলে সেই মরদেহ মূল্যবান কোনো বস্তুতে পরিণত হয়। এমন ধারণা থেকে দেশে প্রায় সময়েই বজ্রপাতে নিহতদের লাশ চুরির ঘটনা ঘটে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে সেই আশঙ্কা থেকেই গ্রামবাসী নিহতদের লাশ চুরি ঠেকাতে দ্রুতই রড সিমেন্ট দিয়ে কবর বাঁধাই করে দেয়।
অনুসন্ধান
রিউমর স্ক্যানার টিম বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করে জানতে পারে, বজ্রপাতে নিহত লাশের প্রাকৃতিক চুম্বক বা মূল্যবান বস্তুতে পরিণত হওয়ার দাবীটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও গুজব।
বিষয়টি নিয়ে ০৯ মে ২০১৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ বিবিসি নিউজ বাংলার এক প্রতিবেদনে বলেছেনঃ
“এর পেছনে কারণ একধরনের মিথ্যা বিশ্বাস। অনেকেই মনে করেন, বজ্রপাতে নিহত মানুষের শরীরে মূল্যবান জিনিস তৈরি হয়। তারা হয়তো ধারণা করে লোহার ভেতর দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি পাস হলে (প্রবাহিত হলে) যেভাবে লোহা চুম্বক হয়ে যায়, এক্ষেত্রেও সেরকম কোনকিছু হয়। কিন্তু এটা তো পুরোটাই অন্ধবিশ্বাস। গ্রাম্য অনেক কবিরাজ বা ওঝা’র ঝাড়ফুঁক কাজের জন্য এই ধরনের মৃতদেহের হাড়-গোড় দরকার মনে করে আর সে ধরনের কুসংস্কার থেকেও এই মৃতদেহ চুরির ধারণাটি চলে আসছে বলে অনেকেই মনে করেন। আসলে ইলেকট্রিক শক খেয়ে মানুষের মৃত্যু হলে মৃতদেহ যেমন হয় বজ্রপাতে মৃত মানুষের মৃতদেহ ঠিক একইরকম হয়। কোনও পার্থক্য থাকেনা।”
এছাড়া ২০২০ সালে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে বজ্রপাতে নিহতের ঘটনায় তৎকালীন কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন:
“বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির কঙ্কালে কোনো মূল্যবান জিনিস থাকতে পারে না। এটা কুসংস্কার ও অযৌক্তিক। বজ্রপাতের সঙ্গে নিহত ব্যক্তির কঙ্কালের কোনো সম্পর্ক নেই।”
বজ্রপাত হলে শরীরে কী হয়?
এই বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. কাউছার আহম্মেদ পাটওয়ারী রিউমর স্ক্যানারকে জানিয়েছেন:
“বজ্রপাতের ফলে মানুষের শরীরে অতিমাত্রায় তড়িৎ প্রবাহ হয় বলেই মানুষ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। বজ্রপাতে মৃতদের দেহ চুম্বকত্বে আবিষ্ট (মূল্যবান ম্যাগনেটে রুপান্তরিত) হয় এটা আমাদের সমাজের প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ তড়িৎ প্রবাহের ফলে চৌম্বকে পরিণত হয় এমন কোন পদার্থ বা পদার্থের উচ্চ ঘনত্ব বিশিষ্ট কোন অঙ্গ মানুষের শরীরে/মানবদেহে নেই যার কারণে বজ্রপাতের ফলে সৃষ্ট তড়িৎ প্রবাহের দরুন মানুষের মৃত্যু হলেও মানবদেহ চুম্বকত্বে আবিষ্ট হবে বা মূল্যবান ম্যাগনেটে রুপান্তরিত হবে। বৈদ্যুতিক শকে মৃত ব্যক্তির দেহের মতই বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তির দেহের পরিবর্তনে সাদৃশ্য রয়েছে।”
তাছাড়া রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তানভীর আহমেদ ৮ জুন ২০২১ তারিখে বিবিসি নিউজ বাংলার প্রতিবেদনে বলেনঃ
“বজ্রপাত থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় সেটি আল্ট্রা হাই-ভোল্টেজ। বজ্রপাত দুই ধরণের হয়। কোন ব্যক্তির উপর সরাসরি পড়তে পারে অথবা একটি বড় এলাকা জুড়ে বজ্রপাত হতে পারে। কোন ব্যক্তির উপর সরাসরি বজ্রপাত হলে সে সাথে সাথে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। বজ্রপাতে ভোল্টেজ এতো বেশি যে সেটা ১০ হাজার থেকে মিলিয়ন পর্যন্ত চলে যায়। যদি আশপাশের কোন গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, টাওয়ার কিংবা উঁচু ভবনের উপর বজ্রপাত হয় তখন সেখান থেকে আল্ট্রা লো-ডিউরেশন বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়। আশপাশে যদি কেউ থাকে তখন তার শরীরে অতি দ্রুত বিদ্যুৎ প্রবেশ করে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায়। বজ্রপাতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই তৎক্ষণাৎ মারা যায়। আহত হয়ে অল্প কিছু মানুষ বেঁচে যায়।”
বজ্রপাত কী?
ভূ-পৃষ্ঠের পানি যখন বাষ্প হয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে তখন মেঘের নিচের দিকে ভারী অংশের সাথে জলীয়বাষ্পের সংঘর্ষ হয়। এর ফলে অনেক জলকণা ইলেকট্রন ত্যাগ কৃত হয়ে ধনাত্মক চার্জ এ পরিণত হয় এবং অনেক জলকণা সে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক চার্জে পরিণত হয়।
ডিসচার্জ প্রক্রিয়া ৩ ভাবে হয়ে থাকে। যথা –
- একই মেঘের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ এর মধ্যে।
- একটি মেঘের ধনাত্মক চার্জ এর সাথে অন্য মেঘের ঋণাত্মক, আবার অন্য মেঘের ধনাত্মক চার্জ এর সাথে ওই মেঘের ঋণাত্মক চার্জ এর মধ্যে।
- মেঘের পজেটিভ আধানের ও ভূমির মধ্যে (একে ক্লাউড টু গ্রাউন্ড ডিসচার্জিং বলে)।
এ চার্জিত জলীয় বাষ্প মেঘে পরিণত হলে মেঘে বিপুল পরিমাণ স্থির তড়িৎ উৎপন্ন হয়। এ সময় অপেক্ষাকৃত হালকা ধনাত্মক আধান মেঘের উপরে এবং অপেক্ষাকৃত ভারী ঋণাত্মক চার্জ নিচে অবস্থান করে। মেঘে এই ২ বিপরীত চার্জের পরিমাণ যথেষ্ট হলে ডিসচার্জ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ডিসচার্জিং এর ফলে বাতাসের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক স্পার্ক প্রবাহিত হয়। এ বৈদ্যুতিক স্পার্ক এর প্রবাহই ‘বজ্রপাত’। কিন্তু সব বজ্র ভূপৃষ্ঠে পড়ে না। শুধু ক্লাউড টু গ্রাউন্ড ডিসচার্জিং এর ফলে সৃষ্ট বজ্রই ভূপৃষ্ঠে পড়ে।
অর্থাৎ, বজ্রপাতে নিহত হলে নিহতের লাশ মূল্যবান বস্তু বা প্রাকৃতিক চৌম্বকে পরিণত হয় এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুয়া এবং মেডিক্যাল সাইন্সে এর কোন ভিত্তি নেই।