পৃথিবীর সবাই একসাথে লাফ দিলে কি পৃথিবীর তাপমাত্রা কমবে?

গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিঃসন্দেহে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংকটগুলোর একটি। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান এই তাপমাত্রা রোধের উপায় নিয়ে বিশ্বব্যাপী সভা-সেমিনার-আলোচনাও কম হচ্ছে না। তবে আজ জানবো ভিন্ন গল্পের কথা। কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন লাফ দিয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমানো সম্ভব। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, প্রতিবছর ২০ জুলাই পৃথিবীর তাপমাত্রা কমানোর জন্য পৃথিবীব্যাপী “বিশ্ব লাফ দিবস” পালিত হয়।

ধারণাটির প্রথম উদ্ভব ঘটে Torsten Lauschmann নামক একজন ইউরোপীয় শিল্পীর হাত ধরে। তিনি ধারণা করেছিলেন, পৃথিবীর সব মানুষ যদি একই সময়ে লাফ দেয় তবে পৃথিবীর কক্ষপথ সূর্যের থেকে দূরে সরে যাবে। আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হাত থেকে রক্ষা পাবে পৃথিবী। এ লক্ষ্যে Torsten Lauschmann প্রথমে একটি ওয়েবসাইট চালু করেন। সে ওয়েবসাইটে তিনি ৬০০ মিলিয়নেরও বেশি রেজিস্ট্রার্ড জাম্পার যুক্ত করতে সক্ষম হন। অবশেষে, ২০০৬ সালের ২০ জুলাই প্রথমবারের মত World Jump Day বা বিশ্ব লাফ দিবস উদযাপিত হয়। এরপর থেকে প্রতিবছরই ২০ জুলাই বিশ্বব্যাপী ‘জাম্প ডে’ বা লাফ দিবস উদযাপিত হয়ে আসছে।

Source: National Day Calendar

অর্থাৎ, বিশ্ব লাফ দিবসের উদ্দেশ্য হল বৈশ্বিক জলবায়ুর অসহিষ্ণু অবস্থা থেকে উত্তরণ পাওয়া। কিন্তু, কিভাবে সম্ভব হবে সেটি?

ন্যাশনাল টুডের তথ্যমতে, জাম্প ডে’র স্বপক্ষের ব্যক্তিরা বিশ্বাস করেন যে পৃথিবীর সব মানুষ যদি একত্রে লাফ দেয় তাহলে পৃথিবীর কক্ষপথ কিছুটা সরে যাবে। ফলে, সূর্যের সাথে পৃথিবীর দূরত্ব বৃদ্ধি পাবে। এই বর্ধিত দূরত্বের ফলে পৃথিবীর উপর সূর্যের তাপও কমে যাবে খানিকটা। এভাবেই, পৃথিবীর কক্ষপথ পরিবর্তনের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা থেকে মুক্তি মিলবে পৃথিবীর!

Source: National Today

লাফ দিয়ে কী পৃথিবীর কক্ষপথ বদলানো সম্ভব?

এবার আমরা বেশকিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং হিসাব নিকাশের সাহায্যে দেখার চেষ্টা করব লাফিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথ পরিবর্তন করা সম্ভব কি না।

কোনো ব্যক্তি যদি পৃথিবী থেকে লাফিয়ে উপরে ওঠে তবে তত্ত্বীয়ভাবে তিনি লাফিয়ে ওঠার পূর্বে পৃথিবীপৃষ্ঠে বল প্রয়োগ করেন। অন্যভাবে বললে, পৃথিবীকে নিজের বিপরীত দিকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন! কিন্তু, একজন মানুষের ভর পৃথিবীর তুলনায় এতটাই নগন্য যে পৃথিবীর সরণ ঘটানোর জন্য তা একেবারেই অপ্রতুল। কিন্তু, কি হবে যদি পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ একই সাথে লাফ দেন? যদি পৃথিবীর সব মানুষের গড় ভর ৫০ কেজি ধরে নেওয়া হয় তবে মোট ভরের পরিমাণ হবে ৩৫ হাজার কোটি কেজি। সংখ্যাটা নেহায়েত ছোট নয়। কিন্তু পৃথিবীর ভরের(5.9×10²⁴kg) তুলনায় সেটা অতি নগন্যই। তবে, পৃথিবীর সব মানুষ একসাথে লাফ দিলে যে বল পৃথিবীর উপর প্রযুক্ত হবে তার মান নগন্য হতে পারে তবে নিশ্চিতভাবে শুন্য নয়! এর অর্থ, পৃথিবীর সকল মানুষ একত্রে লাফ দিলে পৃথিবীর অতি নগণ্য পরিমাণ হলেও সরণ হবে!

তাহলে, তো বৈজ্ঞানিকভাবে লাফিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথ সরানো সম্ভব! কিন্তু বিষয়টি আসলে মোটেও এমন নয়। এবার সে বিষয়ে আগোনো যাক।

যেহেতু আমরা অতি নগণ্য হিসেব নিয়েই আলোচনা করছি সুতরাং মান শুন্য নয় এমন সবকিছুই আমাদের হিসেবে থাকবে। যেহেতু, ৭০০ বিলিয়ন মানুষ লাফিয়ে উঠার ফলে পৃথিবী নগন্য হলেও বল প্রাপ্ত হয় সুতরাং সে আলোচনাও আমরা করব। 

যদি পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৭০০ বিলিয়ন ব্যক্তি একত্রে লাফিয়ে ওঠে তবে পৃথিবীর কি ন্যূনতম সরণ ঘটবে? এর উত্তর হচ্ছে না। এক বিন্দুও না! এর কারণ, পৃথিবীপৃষ্ঠ ব্যাপী মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছে। যেহেতু পৃথিবী গোল এবং পৃথিবীর সব মানুষ একই সাথে লাফ দিচ্ছে সুতরাং, আপনি যে স্থানে লাফ দিচ্ছেন পৃথিবীর ব্যাস বরাবর তার বিপরীত স্থানেও কেউ না কেউ লাফ দিচ্ছে সেটা ধরে নেওয়াই যায়। আর আপনি লাফ দেওয়ার ফলে, পৃথিবীকে যেদিকে সরানোর চেষ্টা করছেন আপনার বিপরীতে থাকা ব্যক্তি ঠিক তার বিপরীত দিকে পৃথিবীকে সরাতে চাইছে। আরও সহজভাবে বললে বাংলাদেশ যেহেতু আমেরিকার একেবারে বিপরীত দিকে অবস্থান করছে সেহেতু আপনার লাফ দিয়ে পৃথিবীকে যেদিকে সরাতে চাইছেন, আমেরিকায় লাফ দেওয়া একজন ব্যক্তি তার বিপরীত দিকে সরানোর চেষ্টা করছে। ফলে, পৃথিবীর উপর আপনার এবং তার প্রযুক্ত বল পরস্পর কাটাকাটি হয় যাচ্ছে! পৃথিবীর এমনিতেও যে নগন্য বল অনুভব করার কথা সেটিও আর হচ্ছে না! অর্থাৎ, নিজ নিজ স্থানে থেকে যদি পৃথিবীর ৭০০ বিলিয়ন মানুষ একইসাথে লাফ দেয় তবুও পৃথিবীর উপর নিট প্রযুক্ত বলের কোনো  কোনো তারতম্য ঘটবে না। সুতরাং, পৃথিবীর কোনো সরণও ঘটবে না।

Source: বিজ্ঞানচিন্তা 

কিন্তু যদি এমন হয় যে, পৃথিবীর সব মানুষ একই স্থান থেকে একই সাথে লাফ দিচ্ছেন? অর্থাৎ, পৃথিবীর সব মানুষ একেবারে লম্বভাবে কিরণ দেওয়া সূর্যের নিচে দাড়িয়ে পৃথিবীকে তার বিপরীত দিকে ঠেলার চেষ্টা করলে কি পৃথিবীর কোনো সরণ ঘটবে? এ প্রশ্নের উত্তরও হলো ‘না’! এক বিন্দুও সরণ ঘটবে না। এবারে বল কাটাকাটি না হলেও সরণ যে ঘটবে না তার কারণ নিউটনের গতির সূত্র! নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে , আপনি লাফ দেওয়ার সময় পৃথিবীর উপরে যে বল প্রয়োগ করছেন, পৃথিবীও আপনার উপর একই পরিমাণ বল প্রয়োগ করছে। ফলে, আপনি লাফ দিলে পৃথিবী সরে যাবে ঠিকই; কিন্তু মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণার একে অপরকে আকর্ষণের সূত্র অনুসারে, আপনি যখন অভিকর্ষের প্রভাবে আবার মাটিতে এসে পড়বেন তত্ত্বীয়ভাবে পৃথিবীও আপনার উপর আছড়ে পড়বে! অর্থাৎ, আপনি লাফ দেওয়ার ফলে পৃথিবীর যা সরণ ঘটেছিল আপনি যে মুহূর্তে ভূমিতে পা রাখবেন ঠিক সেই মুহূর্তেই আপনার প্রদত্ত বলের ফলে পৃথিবীর সরণ শূন্যে নেমে আসবে। এটা যেমন একজন মানুষের ক্ষেত্রে ঠিক। তেমনি পৃথিবীর ৭০০ বিলিয়ন মানুষ একসাথে লাফিয়ে উঠলেও একই ঘটনা ঘটবে। অর্থাৎ, পৃথিবীর সব মানুষ একই স্থান থেকে, একই সময়ে, একই দিকে লাফ দিলেও পৃথিবীর কোনো সরণই ঘটবে না; কারণ পৃথিবীপৃষ্ঠে অবতরণের মুহূর্তেই সৃষ্ট সরণ শুন্য হয়ে যাবে।

Source: West Texus A&M University

অর্থাৎ, পৃথিবীর সব মানুষ একসাথে লাফিয়ে কখনো পৃথিবীর কক্ষপথ পরিবর্তন করতে পারবে না। কিন্তু, যদি ধরেও নেওয়া যায় যে, লাফিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথ একটু একটু করে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে, তবু কি পৃথিবীর তাপমাত্রা কমতো?

সাইন্টিফিক আমেরিকান এর তথ্যমতে, পৃথিবীর কক্ষপথ সূর্যে থেকে ১৪৯.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করছে। সূর্য থেকে এই দূরত্বের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা থাকে গড়ে ১৫°সেলসিয়াস। যদি পৃথিবীর এই গড় তাপমাত্রা আরো ৩° সেলসিয়াস কমাতে হয় তবে পৃথিবীর বর্তমান কক্ষপথকে সূর্য থেকে আরো ৩ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরত্বে নিয়ে যেতে হবে! 5.97×10²⁴kg ভরের পৃথিবীকে সেই দূরত্বে নিয়ে যেতে যে শক্তি প্রয়োজন তার পরিমাণ হলো 5×10³¹ জুল! এটি কত বিপুল পরিমাণ শক্তি সে আন্দাজ যারা করতে পারছেন না তাদের জানিয়ে রাখি বর্তমান পৃথিবীতে উৎপাদিত বার্ষিক সর্বমোট বিদ্যুৎ শক্তির পরিমাণ হলো 10¹⁹ জুল। যা পৃথিবীকে কক্ষপথ সরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির মাত্র 0.0000000000002 শতাংশ! অর্থাৎ, এক বছরে পৃথিবীতে উৎপাদিত বিদ্যুতের পুরোটাই যদি পৃথিবীর কক্ষপথ সরানোর কাজে লাগানো হয় তবে পৃথিবী মোট দূরত্বের মাত্র 0.0000000000002 শতাংশ অতিক্রম করতে পারবে! 

Source: Scientific American

এছাড়াও, শক্তির বিকল্প উৎস হিসেবে নিউক্লিয়ার এনার্জির ব্যবহার হলে ব্যাপারটি কেমন ঘটবে সে সম্পর্কেও সায়েন্টিফিক আমেরিকানের নিবন্ধ থেকে জন্য যায়। তাদের তথ্যমতে, নিউক্লিয়ার বোম বা পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে নির্গত শক্তি কাজে লাগিয়ে যদি পৃথিবীকে তার কক্ষপথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ দূরত্ব (৩মিলিয়ন কিলোমিটার) অতিক্রম করতে হলে, ৫০০ বছর ধরে প্রতি সেকেন্ডে একটি করে পারমাণবিক বোমার বিষ্ফোরণ ঘটাতে হবে! 

Source: Scientific American

পাশাপাশি, Science abc এর তথ্যমতে, রকেট উৎক্ষেপনের ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠে যে বলের সৃষ্টি হয় সে বল কাজে লাগিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথ সরানোর চেষ্টা করা হলে, ১১ টনের ১ বিলিয়ন রকেট মহাকাশে উৎক্ষেপণের ফলে পৃথিবীর গতি বদলাবে প্রতি সেকেন্ডে ২০ ন্যানোমিটার। এখানে জানিয়ে রাখি, মানুষের একটি চুলের প্রস্থ প্রায় ৮০০০০ ন্যানোমিটার! অর্থাৎ, এক বিলিয়ন রকেট মিলেও পৃথিবীর গতি মানুষের চুলের প্রস্থের সমানও পরিবর্তন করতে পারবে না!

Source: Science abc

অর্থাৎ, লাফ দেওয়ার ফলে যদি পৃথিবীর সরণ ঘটতো; তবুও পৃথিবীর কক্ষপথ কাঙ্ক্ষিত দূরত্বে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না। ফলে, বিশ্ব লাফ দিবসের যে মূল উদ্দেশ্য- ‘লাফ দেওয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর কক্ষপথ পরিবর্তন করে বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানো’ সেটি অধরাই থেকে যাবে। সুতরাং, পৃথিবীর সবাই একই সময়ে লাফিয়ে কক্ষপথ পরিবর্তনে মাধ্যমে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমানোর ধারণাটি একটি নেহাতই অবৈজ্ঞানিক এবং অবাস্তব ধারণা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img