দীর্ঘদিন ধরে ডিবি পুলিশের বরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘সতর্ক বার্তা’ শীর্ষক একটি তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।
পোস্টগুলোতে যা দাবি করা হচ্ছেঃ
‘আগামি কয়েক সপ্তাহ Coca cola বা Pepsi অথবা পানীয় জাতীয় কোন জিনিস যা বাজারে পাওয়া যায় সেই সব জিনিস খাবেন না!! কারন এতে কেউ HIV Blood মিশিয়ে দিয়েছে এটা ভারতের ‘এন ডি’ টি ভি তে দেখানো হয়েছিল!! দয়া করে সব বন্ধুদের শেয়ার করে একজন দায়িত্ববান নাগরিকের ভূমিকা পালন করুন।।দয়া করে এটি delete করার আগে, তোমার বন্ধুদের সাহায্য করো এটি পাঠিয়ে। 16 কোটি বাংলাদেশীদের কাছে পৌঁছে দাও। এটি কাউকে সাহায্য করতে পারে। যতবেশি সম্ভব এটি Forword করো।…’

চলতি বছর ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
২০২১ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
২০২০ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
২০১৯ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
২০১৮ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুনএখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
২০১৭ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ডিবি পুলিশের বরাতে ফেসবুকে ‘সতর্ক বার্তা’ শীর্ষক Coca cola বা Pepsi অথবা পানীয় জাতীয় পণ্য পান না করার পরামর্শ দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি ভিত্তিহীন। প্রকৃতপক্ষে ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করে বাংলাদেশে উক্ত দাবিটি প্রচার হয়ে আসছে।
সূত্রের সন্ধানে
দাবিটি নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, একই দাবিটি ২০১৭ সালের অন্তত মার্চ মাস থেকে ইন্টারনেটে বিদ্যমান।
সে সময়ে প্রচারিত এই পোস্টগুলোতে দাবি করা হয়, ‘ভারতের দিল্লি পুলিশের থেকে এই massageটা পুরো দুনিয়ার জন্য দেওয়া হয়েছে!! আগামি কয়েক সপ্তাহ Coca cola বা Pepsi অথবা পানীয় জাতীয় কোন জিনিস যা বাজারে পাওয়া যায় সেই সব জিনিস খাবেন না !! কারন এতে কেউ HIV Blood মিশিয়ে দিয়েছে এটা ভারতের ‘এন ডি’ টি ভি তে দেখানো হয়েছিল!! দয়া করে সব বন্ধুদের শেয়ার করে একজন দায়িত্ববান নাগরিকের ভূমিকা পালন করুন।।’
ফেসবুকের এই পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, Coca cola বা Pepsi অথবা পানীয় জাতীয় পণ্য পান না করার পরামর্শ দাবিতে প্রচারিত সতর্কবার্তাটির সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের দিল্লি পুলিশ ও ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিকে।
সে সময়ে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
এসব সূত্র ধরে অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড সার্চ করেও ভারতের দিল্লি পুলিশের এমন কোনো সতর্কবার্তা পাওয়া যায়নি। এছাড়া পোস্টগুলোতে ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হলেও গণমাধ্যমটিতে এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানে কোনো তথ্য বা প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের পুলিশের সারা বিশ্বের জন্য সতর্কবার্তা দেওয়ার বিষয়টিও অযৌক্তিক।
তবে ভারতীয় গণমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াতে ২০১৯ সালের ৪ জুন ‘FACT CHECK: Did Hyderabad Police claim soft drinks contain Ebola Virus?’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালে ভারতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে।
যেখানে বলা হয়, ভারতের হায়দ্রাবাদ পুলিশ ও জনসাধারণকে যেকোনো কোমল পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে সতর্ক বার্তা দিয়েছে। কারণ, এই পানীয়গুলোর উৎপাদন কারখানার একজন কর্মী তার ইবোলা ভাইরাসে দূষিত রক্ত এই পানীয়তে যোগ করে দিয়েছে। এছাড়া এই সতর্কবার্তার সাথেও এনডিটিভির নাম যুক্ত করে দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ভারতে এই ধরনের সতর্কবার্তা ২০১৪ সাল থেকেই কোমল পানীয় ব্র্যান্ডের নাম পরিবর্তন করে বিভিন্ন সময়ে প্রচার হয়ে আসছিল। ২০১৯ সালে হায়দ্রাবাদ পুলিশের বরাতে এমন দাবি পুনরায় ছড়িয়ে পড়লে তারা এটিকে ভুয়া নিশ্চিত করে মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সে (সাবেক টুইটার) একটি টুইট করে। এছাড়া সে সময় এনডিটিভিতেও এমন কোনো প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
দাবিটি নিয়ে আরও অনুসন্ধানে মার্কিন ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান স্নোপসে ২০১১ সালের ১৪ জুলাই ‘Is Pepsi Contaminated with HIV?’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই দাবিটির জন্ম আরও আগে। ২০১১ সালের জুলাইয়েও পেপসির পণ্যে এইচআইভি থাকার দাবিটি মোবাইল ফোনে ক্ষুদে বার্তা আকারে ও ইন্টারনেটে প্রচার হয়েছিল।
এই প্রতিবেদন থেকে উক্ত দাবির সঙ্গে দিল্লি পুলিশ ও এনডিটিভির যোগসূত্র পাওয়া যায়। অর্থাৎ ২০১১ সাল থেকেই Coca cola বা Pepsi অথবা পানীয় জাতীয় পণ্য পান না করার পরামর্শ দাবিতে প্রচারিত দাবিটির সঙ্গে দিল্লি পুলিশ ও এনডিটিভির নাম জড়িয়ে আছে।
খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে মানুষ কি এইচআইভি আক্রান্ত হতে পারে?
এ প্রশ্নের উত্তরে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল জানায়, খাবার বা পানীয়ের মাধ্যমে এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। মূলত, এইচআইভি ভাইরাস মানবদেহের তরল হোস্টের বাইরে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারে না। বাতাসের সংস্পর্শে আসা, রান্নার তাপ এবং পাকস্থলীর অ্যাসিড এই ভাইরাসকে মেরে ফেলে। তাই এভাবে এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকি নেই।
বাংলাদেশে দাবিটি যেভাবে বিবর্তিত হয়ে প্রচার হলো
এ সংক্রান্ত অনুসন্ধানে ২০১৭ সালের অন্তত আগস্ট থেকে প্রচারিত পোস্টগুলোর সূত্র বিবর্তিত হতে দেখা যায়। অর্থাৎ দিল্লি পুলিশের পরিবর্তে ডিবি পুলিশের নাম ও পোস্টগুলোর শেষে অনুরোধক্রমে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
আবার ২০১৮ সাল থেকে উক্ত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলোর শেষে অনুরোধক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
এছাড়া পোস্টগুলোতে স্বাস্থ্য পরামর্শমূলক আরও অতিরিক্ত কিছু অংশের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেগুলো ভারতের দিল্লি পুলিশের নামে প্রচারিত পোস্টগুলোতে উল্লেখ ছিল না।
এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ
১। আমেরিকান ডাক্তাররা মানুষের শরীরে এক নতুন ক্যান্সার খুঁজে পেয়েছেন যার কারন Silver Nitro Oxide. যখন তুমি মোবাইল কার্ড নোখ দিয়ে ঘসিয়ে তোলো তখন এটি তোমার শরীরে স্কিন ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে।
২। মোবাইলের চার্জ যখন শেষ দাগে তখন কোনো কল ধরোনা, এই সময় রেডুএশন (রেডিয়েশন) অন্যান্য সময়ের চেয়ে ১০০০ গুন বেশি থাকে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অতিরিক্ত উল্লিখিত এই অংশগুলোও বিদেশি বিভিন্ন পোস্ট থেকে অনূদিত হয়ে বাংলা ভাষায় প্রচার হয়ে আসছে।
এ নিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্টচেক বিভাগ এএফপি ফ্যাক্টচেক ২০২০ সালের ২৩ জুন ‘Experts say cancer-causing “silver nitro oxide” does not exist as viral post suggests’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত তাদের একটি প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি(EPA)’র বরাতে জানায়, সিলভার নাইট্রো অক্সাইড নামে কোনো রসায়নিকের অস্তিত্ব নেই।
এছাড়া আমেরিকান ক্যান্সার সোসাইটির চীফ মেডিকেল ও সায়েন্টিফিক কর্মকর্তা উইলিয়াম জি ক্যান্স এএফপিকে জানান, আইএআরসি এবং ইপিএ ডাটাবেসের অনুসন্ধানের উপর ভিত্তি করে ‘সিলভার নাইট্রো অক্সাইড’ কার্সিনোজেনিক ( যা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে সক্ষম) হওয়ার কোনো যুক্তিযুক্ত প্রমাণ নেই।
উল্লেখ্য, আইএআরসির পূর্ণরূপ হলো ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার। এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা পরিচালিত একটি আন্তঃসরকারি সংস্থা, যা ক্যান্সারের কারণ নিয়ে গবেষণার সমন্বয় করে।
এছাড়া বাংলাদেশে প্রচারিত পোস্টগুলোতে উল্লিখিত মোবাইলের রেডিয়েশন বা বিকিরণ সম্পর্কে অনুসন্ধানে এএফপির একই ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মোবাইল ফোনের সর্বোচ্চ বিকিরণ শক্তি মাত্র 2 ওয়াট,যা শরীরের কোন ক্ষতি করে না।
এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন থেকেও জানা যায়, মোবাইল ফোনের বিকিরণ মানুষের স্বাস্থ্যের উপর কোনো বিরূপ প্রভাব দেখায় না।
একই প্রসঙ্গে জানতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের ডেপুটি কমিশনার ফারুক হোসেন রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, ‘এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। এগুলা ডিবি পুলিশের কাজ নয়। ডিবি পুলিশের কাজ হচ্ছে ডিটেকটিভ কাজ। অস্ত্র ধরা, মাদক ধরা, ক্লু লেস মামলা তদন্ত করা।’
উপরিউক্ত তথ্যসমূহ সার্বিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, ডিবি পুলিশের বরাতে ফেসবুকে ‘সতর্ক বার্তা’ শীর্ষক Coca cola বা Pepsi অথবা পানীয় জাতীয় পণ্য পান না করার পরামর্শ দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি ভিন্ন ভাষা থেকে অনূদিত হয়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত আরও বিভিন্ন দাবি সংযুক্তির মাধ্যমে বিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার হয়ে আসছে।
মূলত, দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে Coca cola বা Pepsi অথবা পানীয় জাতীয় পণ্য পান না করার পরামর্শ দাবিতে একটি সতর্কবার্তা প্রচার করা হচ্ছে। এই সতর্কবার্তায় দাবি করা হচ্ছে, এসব পানীয়তে কেউ HIV Blood মিশিয়ে দিয়েছে। যা ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভিতে প্রচার করা হয়েছে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, উক্ত সতর্কবার্তাটি একটি বহুল প্রচলিত গুজব। যেটি ইতোপূর্বে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও বিভিন্ন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার হয়ে আসছে।
সুতরাং, ডিবি পুলিশের বরাতে ‘সতর্ক বার্তা’ শীর্ষক Coca cola বা Pepsi অথবা পানীয় জাতীয় পণ্য পান না করার পরামর্শ দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- NDTV: https://www.ndtv.com/search?searchtext=HIV-Blood-in-coca-cola-pepsi
- Times of India: FACT CHECK: Did Hyderabad Police claim soft drinks contain Ebola Virus?
- Hyderabad City Police: https://twitter.com/hydcitypolice/status/1149957568682323969
- Snopes: Is Pepsi Contaminated with HIV?
- CDC: HIV Transmission
- AFP: Experts say cancer-causing “silver nitro oxide” does not exist as viral post suggests
- WHO: Electromagnetic fields and public health: mobile phones
- Statement of DC ( Media and Public Relations, DMP)