রাসেল’স ভাইপার সাপের খবরে গণমাধ্যমে নোনাবোড়া বা জলবোড়া সাপের ছবি প্রচার

গতকাল ১৯ জুন মূলধারার টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজ এর অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি সাপের ছবি ব্যবহার করে “ভোলায় তজুমদ্দিনে খেলার মাঠে রাসেল ভাইপার পিটিয়ে মারল এলাকাবাসী” শিরোনামে একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করা হয়। 

ডিবিসি নিউজ এর ফেসবুক পেজে প্রচারিত ফটোকার্ডটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ফটোকার্ডটি পোস্টের এক ঘন্টার মধ্যেই ফটোকার্ডটিতে ৮ হাজারেরও অধিক পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

একই ঘটনায় ডিবিসি নিউজ ছাড়াও প্রতিদিনের সংবাদ নামক অন্য আরেকটি সংবাদমাধ্যম তাদের ওয়েবসাইটে রাসেল’স ভাইপার প্রাপ্তির দাবির সংবাদে একই সাপের ছবি ব্যবহার করেছে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভোলার তজুমদ্দিনে তীব্র বিষধর রাসেল’স ভাইপার সাপ প্রাপ্তির দাবির খবরে একাধিক গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিটি রাসেল’স ভাইপার সাপের নয়, বরং এটি মৃদু বিষধর নোনাবোড়া বা জলবোড়া সাপের ছবি, যার কামড়ে মানুষের মৃত্যুর সম্ভাবনা নেই।

অনুসন্ধানের প্রাথমিক পর্যায়ে অনলাইনে বিদ্যমান রাসেল’স ভাইপারের ছবি কিংবা গঠনগত বৈশিষ্ট্যের সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সাপটির পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। রাসেল’স ভাইপারের বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii এবং রাসেল’স ভাইপারের মাথার আকৃতি ত্রিকোণাকার এবং রাসেল’স ভাইপারের গায়ে স্পষ্ট গোলাকার অনেকটা চেইনের মতো দাগ থাকে৷ তাছাড়া, বাংলাদেশ এলাকায় প্রাপ্ত রাসেল’স ভাইপারে সাধারণত উজ্জ্বল আকৃতির বাদামি বর্ণের মধ্যে স্পষ্ট গোলাকার দাগ থাকে। উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সাপটির সাথে মিলে না। 

অপরদিকে প্রচারিত ছবিটির সাথে ডগ ফেসড ওয়াটার স্ন্যাক বা নোনাবোড়া বা জলবোড়ার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। Herpetofaunabd নামের একটি ওয়েবসাইটে ডগ ফেসড ওয়াটার স্ন্যাকের বৈজ্ঞানিক নাম বলা হয়েছে Cerberus rynchops এবং সাপটির মাথা প্রশস্ত, চোখ গুলো ছোট। সাপটির উপরের চোয়াল এটিকে কুকুরের মুখের ন্যায় চেহারা দিয়েছে। চোখ এবং নাকের অবস্থান মাথার বেশ উপরে। চোখ থেকে শুরু করে শরীরের পার্শ্বীয় অংশে একটি দীর্ঘ কালো রেখা থাকে। সাপটির শরীর মোটা এবং খসখসে আঁশযুক্ত। শরীরের পৃষ্ঠীয় রঙ ধূসর-বাদামী এবং কালো ছোপ ছোপ দাগ থাকে। পেটের দিক সাদা বা হালকা রঙের যেখানে গাঢ় ছোপ ছোপ দাগ থাকতে পারে বা নাও পারে।

Comparison : Rumor Scanner

উপরোল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে প্রচারিত ছবিটির মিল পাওয়া যায়৷ যা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটি রাসেল’স ভাইপারের নয়, বরং নোনাবোড়া বা ডগ ফেসড ওয়াটার স্ন্যাকের।

Comparison : Rumor Scanner

এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার যোগাযোগ করে সাপ ও সাপের উদ্ধার নিয়ে কাজ করা প্ল্যাটফর্ম Snake Rescue Team Bangladesh এর প্রেসিডেন্ট মোঃ রাজু আহমেদ ও জেনারেল সেক্রেটারি প্রিতম সুর রায়ের সাথে৷ উভয়ই আলোচিত দাবিতে প্রচারিত সাপটি রাসেল’স ভাইপার নয়, বরং নোনাবোড়া বা ডগ ফেসড ওয়াটার স্ন্যাক সাপ বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন। 

মোঃ রাজু আহমেদ রিউমর স্ক্যানারকে জানান, রাসেল’স ভাইপারের বৈজ্ঞানিক নামঃ Daboia russelii, বাংলা নাম: চন্দ্রবোড়া এবং বিষের ধরন: বিষধর (মূলত হেমোটক্সিক)। রাসেল’স ভাইপার চেনার উপায় হলো এদের শরীরে গোলাকৃতির প্যাটার্ন দেখা যায়, মাথা ত্রিকোণ আকৃতির হয়ে থাকে এবং বরেন্দ্রভূমি ও পদ্মা তীরবর্তী এলাকায় পাওয়া যায়। অপরদিকে ডগ ফেসড ওয়াটার স্ন্যাকের বৈজ্ঞানিক নামঃ Cerberus rynchops, বাংলা নামঃ নোনাবোড়া এবং বিষের ধরন: মৃদু বিষধর, যা মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, এর কামড়ে মৃত্যুর কোন ঝুঁকি নেই। সাপটি চেনার উপায় হলো: এদের দেহে আড়াআড়িভাবে কালো বিক্ষিপ্ত দাগ দেখা যায়, মাথার আকৃতি ত্রিকোণ নয় এবং সমুদ্র, উপকূল, সুন্দরবন এলাকায় দেখা যায়।

এ বিষয়ে প্রিতম সুর রায় প্রচারিত সাপটিকে নোনাবোড়া দাবি করে নোনাবোড়া ও রাসেল’স ভাইপারের মধ্যকার পার্থক্যগুলো সম্পর্কে রিউমর স্ক্যানারকে জানান, 

“১. রাসেল’স ভাইপারের দেহের বর্ণ কিছুটা উজ্জ্বল প্রকৃতির ও বাদামী বর্ণের। অন্যদিকে নোনাবোড়া সাপের দেহ তুলনামূলক কম উজ্জ্বল এবং ধূসর বর্ণের।

২. রাসেল’স ভাইপারের দেহে গোলাকার আকৃতির স্পট থাকে। নোনাবোড়া সাপের দেহে আগোছালো কালো ব্যান্ড লক্ষ্য করা যায়। কোন গোলাকার স্পট থাকে না।

৩. রাসেল’স ভাইপারের মাথার আকৃতি পুরোপুরি ত্রিকোণাকৃতির, কিন্তু নোনাবোড়া সাপের মাথা কিছুটা সরু-আকৃতির হয়ে থাকে।

৪. রাসেল’স ভাইপারের চোখগুলো ভেতরের দিকে অবস্থিত, অন্যদিকে নোনাবোড়া সাপের চোখগুলো কিছুটা উপরের দিকে অবস্থিত।

৫. রাসেল’স ভাইপারের তুলনায় নোনাবোড়া তুলনামূলক লম্বা এবং সরু আকৃতির হয়ে থাকে।

৬. রাসেল’স ভাইপার শুকনো এবং নীচু জমিতে বসবাস করে, অন্যদিকে নোনাবোড়া বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের স্বল্প-নোনা পানিতে বেশী দেখা যায় এবং এরা মূলত জলজ প্রজাতির সাপ।

৭. রাসেল’স ভাইপার বিপদের আশংকা দেখলে জোড়ে হিস-হিস আওয়াজ করলেও, নোনাবোড়ার ক্ষেত্রে এরকম কিছু লক্ষ্য করা যায় না।

৮. রাসেল’স ভাইপার বিষধর হলেও, নোনাবোড়া মৃদু বিষধর প্রজাতির সাপ এবং এদের কামড়ে মানুষের মৃত্যুর কোন সম্ভাবনা নেই।”

মূলত, গতকাল ১৯ জুন মূলধারার গণমাধ্যম ডিবিসি নিউজ টিভি তাদের ফেসবুক পেজে “ভোলায় তজুমদ্দিনে খেলার মাঠে রাসেল ভাইপার পিটিয়ে মারল এলাকাবাসী” শিরোনামে একটি সাপের ছবিসহ একটি ফটোকার্ড প্রকাশ করে। একই ঘটনায় একই ছবি ব্যবহার করে আরেক সংবাদমাধ্যম প্রতিদিনের সংবাদও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, গণমাধ্যম দুইটিতে ব্যবহৃত ছবিটি তীব্র বিষধর সাপ রাসেল’স ভাইপারের নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি মৃদু বিষধর ডগ ফেসড ওয়াটার স্ন্যাক বা নোনাবোড়া বা জলবোড়ার। 

সুতরাং, ভোলায় রাসেল’স ভাইপার সাপ প্রাপ্তির দাবির খবরে একাধিক গণমাধ্যমে নোনাবোড়া বা জলবোড়া সাপের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img