ছবিটি শ্রীকৃষ্ণের জীবন্ত হৃৎপিণ্ডের নয়

সম্প্রতি, “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন দেহ ত্যাগ করেন, তখন তাঁকে দাহ করা হয়, তাঁর সমস্ত শরীরে পাঁচটি উপাদান মিশে গিয়েছিল, কিন্তু তাঁর হৃৎপিণ্ড একজন সাধারণ জীবিত মানুষের মতো স্পন্দিত ছিল এবং তিনি একেবারে নিরাপদ ছিলেন, তাঁর হৃদয় আজ পর্যন্ত নিরাপদ, যা খুব কম মানুষই জানেন!………।” শীর্ষক শিরোনামে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে 

যা দাবি করা হচ্ছে

হৃৎপিন্ডের ছবিকে শ্রীকৃষ্ণের জীবন্ত হৃৎপিন্ডের ছবি দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। ছবিটির ক্যাপশোনে বলা হচ্ছে, “ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন দেহ ত্যাগ করেন, তখন তাঁকে দাহ করা হয়, তাঁর সমস্ত শরীরে পাঁচটি উপাদান মিশে গিয়েছিল, কিন্তু তাঁর হৃৎপিণ্ড একজন সাধারণ জীবিত মানুষের মতো স্পন্দিত ছিল এবং তিনি একেবারে নিরাপদ ছিলেন, তাঁর হৃদয় আজ পর্যন্ত নিরাপদ, যা খুব কম মানুষই জানেন। ভগবান জগন্নাথ কাঠের মূর্তির ভিতরে অধিষ্ঠান করে একইভাবে প্রহার করেন!মহাপ্রভুর মহা রহস্য

সোনার ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা হয়….!

মহাপ্রভু জগন্নাথ (শ্রী কৃষ্ণ) কে কলিযুগের ঈশ্বরও বলা হয়।

প্রতি 12 বছর পর পর মহাপ্রভুর মূর্তি বদলানো হয়, সেই সময় পুরো পুরী শহরে কালো আউট হয়, অর্থাৎ পুরো শহরের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়, লাইট নিভানোর পর মন্দির চত্বর ঘিরে ফেলা হয়। সেই সময় সিআরপিএফ, কেউ মন্দিরে যেতে পারবে না!

মন্দিরের ভিতরে ঘন অন্ধকার, পুরোহিতের চোখ বেঁধে আছে, পুরোহিতের হাতে গ্লাভস আছে, তিনি পুরানো মূর্তি থেকে “ব্রহ্ম পদার্থ” বের করে নতুন মূর্তির মধ্যে ঢেলে দেন। এই ব্রহ্ম পদার্থ কী তা আজ পর্যন্ত কেউ জানে না। আজ পর্যন্ত কেউ দেখেনি। হাজার হাজার বছর ধরে এটি এক মূর্তি থেকে অন্য প্রতিমা স্থানান্তরিত হচ্ছে।

এটি একটি অতিপ্রাকৃত পদার্থ, এটিকে স্পর্শ করলেই মানুষের শরীরের ন্যাকড়া উড়ে যায়। এই ব্রহ্ম পদার্থটি ভগবান শ্রী কৃষ্ণের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু এটা কী, কেউ জানে না, বছরে দুই মাস আষাঢ় এলেই ভগবান জগন্নাথ ও অন্যান্য মূর্তি পরিবর্তন করা হয়। এই সুযোগ এসেছে 19 বছর পর, যদিও মাঝে মাঝে ১৪ বছরেও হয়, এই উপলক্ষকে বলা হয় নব-কালভার!

কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন পুরোহিত বলতে পারেননি মহাপ্রভু জগন্নাথের মূর্তির মধ্যে কি আছে???

কিছু পুরোহিত বলে যে আমরা যখন তাকে তার হাতে নিয়েছিলাম, সে খরগোশের মতো লাফিয়ে উঠছিল… একটি চোখ বেঁধে ছিল… আমাদের হাতে গ্লাভস ছিল তাই আমরা কেবল এটি অনুভব করতে পারি…!

আজও জগন্নাথ যাত্রা উপলক্ষে পুরীর রাজা স্বয়ং সোনার ঝাড়ু দিয়ে ঝাড়ু দিতে আসেন।

ভগবান জগন্নাথ মন্দিরের সিংহ গেট থেকে ভিতরে প্রথম পা দিলেই সাগরের ঢেউয়ের আওয়াজ শোনা যায় না, অথচ আশ্চর্যের বিষয় হল মন্দির থেকে এক পা বের হলেই সাগরের শব্দ। শোনা হবে…!

আপনি অবশ্যই বেশিরভাগ মন্দিরের চূড়ায় পাখিদের বসে থাকতে এবং উড়তে দেখেছেন, তবে জগন্নাথ মন্দিরের উপর দিয়ে কোনও পাখি যায় না, পতাকাটি সর্বদা বাতাসের বিপরীত দিকে উড়ে যায়, দিনের যে কোনও সময় প্রভুর প্রধান শিখর। জগন্নাথ মন্দিরে ছায়া পড়ে না!

ভগবান জগন্নাথ মন্দিরের 45 তলার চূড়ার পতাকা প্রতিদিন বদলানো হয়, মনে করা হচ্ছে একদিনের জন্যও পতাকা না বদলাতে পারলে 18 বছর বন্ধ থাকবে মন্দির!

একইভাবে, ভগবান জগন্নাথ মন্দিরের শীর্ষে একটি সুদর্শন চক্রও রয়েছে, যা প্রতিটি দিক থেকে দেখলে আপনার দিকে মুখ করে!

ভগবান জগন্নাথ মন্দিরের রান্নাঘরে, প্রসাদ রান্না করার জন্য 7টি মাটির হাঁড়ি একে অপরের উপরে রাখা হয়, যা একটি কাঠের আগুনে রান্না করা হয়, যার সময় উপরে পাত্রের থালাটি প্রথমে রান্না করা হয়।

ভগবান জগন্নাথ মন্দিরে প্রতিদিন তৈরি করা প্রসাদ ভক্তদের জন্য কখনই কমে না, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল মন্দিরের দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে প্রসাদও শেষ হয়ে যায় এবং অনেক আশ্চর্যজনক জিনিস রয়েছে, আমাদের সনাতন ধর্মের।

সনাতন ধর্মের জয় হোক

শ্রী জগন্নাথ জির মহিমা”

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায় যে, হৃৎপিন্ডের ছবিটি শ্রী কৃষ্ণের জীবন্ত হৃৎপিন্ডের নয় বরং এটি ডিমিট্রি সাইকালভ নামের একজন রাশিয়ান শিল্পীর তৈরী একটি শিল্পকর্ম যা কাঠ, গাছের বাকল ও মাটি দিয়ে তৈরী।

রিভার্স ইমেজ সার্চে, Artofit.org নামে একটি ওয়েবসাইটে Picture of the Day: Heart and Soil শীর্ষক শিরোনামে এই ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।

পরবর্তীতে, ২২ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও  “Heart of Nature by Dimitri Tsykalov” শীর্ষক শিরোনামে ছবটি খুঁজে পাওয়া যায়।

এরপর Dimitri Tsykalov এর অফিশিয়ল ওয়েবসাইটে woodland সেকশনে ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।  

ছবিটির নীচে ক্যাপশন হিসেবে “Heart| 2002| wood, bark, and soil,170x 100x 100cm” লেখাটি দেখতে পাওয়া যায়। এ থেকে সহজেই বোঝা যায় শিল্পকর্মটি কাঠ, কাছের বাকল ও মাটি দিয়ে বানানো হয়েছিলো ২০০২ সালে।

এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়, হৃৎপিণ্ডের ছবিটি প্রকৃতপক্ষে একটি শিল্পকর্মের ছবি। ছবির হৃৎপিণ্ডটি নিতান্তই মাটি, কাঠ ও গাছের বাকলের তৈরী, এর কোনো ঐশ্বরিক ও অলৌকিক গুণ নেই।

অনুসন্ধানে, ১৭ জুন ২০১৫ তারিখে ‘The Indian Express’ এ “Deities at Jagannath temple in Puri replaced after 19 years in elaborate ceremony” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১২ থেকে ১৯ বছর পর পর জগন্নাথ মন্দিরে মূর্তি বদলানো ও মূর্তিতে আত্না স্থানান্তরের এই আচারটির নাম “নবকলেবর”। এই আচারটি অন্ধকারে সম্পন্ন করার রীতি রয়েছে বিধায় এটি মধ্যরাতে করা হয়। তবে, নবকলেবর পালনের জন্য পুরো শহর জুড়ে বাতি নিভিয়ে ব্ল্যাক আউটের বিষয়ে কোনো তথ্য প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে পুরী’র রাজা নিজে সোনার ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিয়েছেন এমন কোনো তথ্যও ঐ সংবাদে নেই। 

এছাড়া, নবকলেবরের পরের দিন নতুন মূর্তিগুলো জনসাধারণের সামনে প্রকাশের সময় পুরীর রাজা নিজ হাতে সোনার ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিয়েছেন দাবির প্রেক্ষিতে এই তথ্যের নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি। শেষ নবকলেবর হয়েছে ২০১৫ সালে এবং এর আগে হয়েছিলো ১৯৯৬ সালে। ২০১৫ সালে পুরীর রাজা ছিলেন দিব্যসিংহ দেব। The India Express এর তথ্য অনুসারে তিনি নবকলেবর অনুষ্ঠানে্র কিছু আচারে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তবে তিনি সোনার ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা ঝাড়ু দিয়েছেন এমন কোনো তথ্যা পাওয়া যায়নি।

মূলত, ভারতের পুরীর জগন্নাথ মন্দিরকে খুব জাগ্রত মন্দির বলে বিশ্বাস করা হয়। মন্দিরে থাকা জগন্নাথ, বলভদ্র,  সুভদ্রা ও সুদর্শনের মূর্তিগুলো প্রতি ১২ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে পরিবর্তন করে নতুন মূর্তি বসানো হয়ে থাকে এবং সেসময় পুরাতন মূর্তি থেকে “ব্রহ্ম পদার্থ” বলে এক ঐশ্বরিক পদার্থ নতুন মূর্তি গুলোতে স্থানান্তরের মাধ্যমে নতুন মূর্তি গুলোকে প্রাণ দেওয়া হয়, বা আত্মা স্থানান্তর করা হয়। আলোচিত ছবিটিকে পুরীতে থাকা শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরের জীবন্ত হৃৎপিণ্ড দাবি করা হচ্ছে। তবে, প্রকৃতপক্ষে ঐ হৃদপিন্ডটি ডিমিট্রি সাইকালভ নামের রাশিয়ান এক শিল্পীর শিল্পকর্ম যা কাঠ, গাছের বাকল ও মাটি দিয়ে বানানো হয়েছে।  

উল্লেখ্য, দীপাবলি উপলক্ষে এম্পায়ার বিল্ডিং এ আলোকসজ্জায় কালি প্রতিমার প্রতিকৃতি ফুটিয়ে তোলার দাবিতে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়লে তা শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।

সুতরাং, রাশিয়ান শিল্পীর কাঠ, গাছের বাকল ও মাটি দিয়ে তৈরী হৃৎপিণ্ডের শিল্পকর্মের ছবিকে শ্রীকৃষ্ণের জীবন্ত হৃৎপিণ্ড দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img