সম্প্রতি, হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর বাড়ি দাবিতে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এমব কিছু পোস্ট দেখুনঃ এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভাইরাল ফেসবুক পোস্টগুলোতে হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর বাড়ি দাবিতে প্রচারিত ছবিটি হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর বাড়ির নয় বরং এটি তুরস্কের সানলিউরফা প্রদেশের হাররান অঞ্চলে অবস্থিত একটি বাড়ির ছবি। উক্ত বাড়িটির সাথে হযরত ফাতিমা (রাঃ) এর কোনো সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।
হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর বাড়ি দাবিতে প্রচারিত ছবিটি সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ‘Adil Hafiza’ নামের একটি টুইটার আইডি থেকে “Harran evleri #Sanliurfa” ক্যাপশনে করা একটি টুইট বার্তার সন্ধান পায় রিউমর স্ক্যানার টিম।
উক্ত টুইট বার্তায় সংযুক্ত ছবি এবং ফেসবুকে হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর বাড়ি দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলোতে সংযুক্ত ছবির তুলনা করার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে দুটি ছবি একই স্থান থেকে তোলা হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, Sanliurfa হচ্ছে তুরস্কের একটি প্রদেশ এবং Harran এই প্রদেশেরই একটি শহরের নাম। তুর্কি শব্দ evleri এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে House (বাংলায়ঃ বাড়ি)। অর্থাৎ উক্ত টুইট দ্বারা মূলত তুরস্কের সানলিউরফা প্রদেশের হাররান অঞ্চলে অবস্থিত একটি বাড়িকে বোঝানো হয়েছে।
তাছাড়া, হাররানে অবস্থিত এই বাড়ি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে turktoyu.com নামক ওয়েবসাইট কর্তৃক Domed Harran Houses শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি আর্টিকেল খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। সেখানেও ফাতেমা (রাঃ) বাড়ি দাবিতে প্রচারিত ছবিটির ন্যায় একই রকম দেখতে অন্য আরেকটি ছবি রয়েছে।
উক্ত আর্টিকেলে বলা হয়, এথেন্স এবং মার্ডিনের শহরগুলোর মতো একসময়ের “বিজ্ঞান কেন্দ্র” হিসেবে পরিচিত Harrnan ছিলো একটি সুপ্রতিষ্ঠিত জনবসতি যেখানে শতাব্দী ধরে বহু সভ্যতা গড়ে উঠেছে।
গম্বুজযুক্ত বাড়িগুলো হাররানের অন্যতম ঐতিহ্যের প্রতীক যা খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। এটি একটি স্থানীয় স্থাপত্যের উদাহরণ যার অস্তিত্ব রক্ষার্থে ১৯ শতকে এটিকে পুনরায় সংস্করণের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং এখনও সানলিউরফার দক্ষিণ-পূর্বে এই বাড়িগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
উক্ত আর্টিকেলে আরো বলা হয়, হাররানের বাড়িগুলোর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হল এগুলোর গম্বুজে কোনো প্রকার গাছ ব্যবহার করা হয় না। মরুভূমির পরিবেশে গাছের সংকট হওয়ার কারণে গম্বুজ নির্মাণে ইটের ব্যবহারকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া এই এলাকায় ইট ছিলো সহজলভ্য।
সাধারণত ৩০-৪০টি ইটের সারির মাধ্যমে গড়ে ওঠা এই ঘরগুলোর সর্বোচ্চ উচ্চতা ৫ মিটার। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক পৃষ্ঠগুলোতে মূলত স্লাইম প্লাস্টার করা হতো। গ্রীষ্মকালে নিজেদের শীতল এবং শীতকালে উষ্ণ রাখতে সক্ষম এই বাড়িগুলো ১৯৮৯ সাল থেকে সুরক্ষার অধীনে রয়েছে। এই স্থান থেকে কোনোপ্রকার উপকরণ সংগ্রহ করা, চ্যানেল খনন করা এবং নতুন নির্মাণ নিষিদ্ধ। তবে এই বাড়িগুলোর মধ্যে একটিকে ১৯৯৯ সালে পুনরধিষ্ঠিত করার মাধ্যমে “Harran Culture House” নামে পর্যটনের পরিষেবায় রাখা হয়েছিল।
তাছাড়া, হাররানের এই বাড়িগুলোর ইতিহাস, নির্মাণশৈলী এবং শীত-গ্রীষ্মে কীভাবে এদের ভেতরের পরিবেশের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকতো সে ব্যাপারে অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম Vernacular domed houses of Harran, Turkey শিরোনামে একটি রিসার্চ আর্টিকেল খুঁজে পায়।
উক্ত আর্টিকেলের সূচনাতে বলা হয়, হাররান হলো তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বে ইউফ্রেটিস এবং টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী একটি সমতল ভূমির শহর যা তার আকর্ষণীয় স্থানীয় স্থাপত্য-শৈলীর দ্বারা সহজেই মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। সচরাচর এই ধরণের স্থাপত্য তুরস্কের আর কোথাও দেখা যায়না, যেখানে মূল নির্মাণ সামগ্রী হচ্ছে রোদে শুকানো ইট (Adobe)। বর্তমানে এই ধরনের স্থাপত্য কেবলমাত্র দক্ষিণ ইতালি, সাইপ্রাস, এবং লিবিয়ার ফেজান ও কুফরা এলাকাতেই দেখা যায়।
উক্ত আর্টিকেলে আরো উল্লেখ করা হয়, হাররানের শঙ্কু আকৃতিযুক্ত গম্বুজ-ঘরগুলোর শিকড় বোঝার জন্য হাররানের ইতিহাসের দিকে একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন। হাররান সম্পর্কে আমাদের এখন পর্যন্ত জানা লিখিত নথিগুলো এটাই নির্দেশ করে যে এর ইতিহাস ২৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মতো। উর্বর ভূমি এবং বাণিজ্যপথে এর অবস্থান হওয়ার কারণে, অনেক সভ্যতা হাররানে বিকাশ লাভ করেছে।
এছাড়া আরো বলা হয় যে, মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার মাধ্যমে হাররানের ঘরগুলো শিকড় অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। ২৫০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এই অঞ্চল শাসন করা আসিরিয়ানদের কিছু পাথরের শিল্পকর্মে হাররানের বাড়িগুলোর অনুরূপ চিত্র দেখা যায়। মিসোপটেমিয়ার প্রত্নতাত্তিক খননগুলোর মাধ্যমে জানা যায়, একটি বর্গাকার কক্ষে গম্বুজবিশিষ্ট এই বাড়িগুলো খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং এই বাড়িগুলোতে ব্যবহৃত গম্বুজের ব্যাস ছিল ০৫ থেকে ১০ মিটারের মধ্যে।
শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে এই অঞ্চলে কাঠ ছিলো বিরল। এজন্য লোকেরা তাদের ঘরগুলো তৈরি করেছিল অ্যাডোব, ইট এবং ছোট পাথর দিয়ে যা তাদের জন্য খুবই সহজলভ্য ছিল। হাররানের বাড়িগুলো আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল এটি খুব দ্রুত নির্মাণ করা যায়। যাযাবর জীবনধারা এবং জলবায়ু পরিস্থিতি মানুষকে এমন ধরনের বাড়ি তৈরিতে বাধ্য করেছিল যা সহজেই তাঁবুর মতো তৈরি করা যেতে পারে এবং একই সাথে তাপ এবং ঠাণ্ডা প্রতিরোধ করে।
১৯৯৮ সালের এই গবেষণাপত্রটিতে দেখা যায়, একজন পুরোনো কারিগর তার দেওয়া সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে গবেষকদের কিছু অবজারভেশন নিশ্চিত করেছেন। সেই কারিগর বলেন,‘‘আমরা খননের সময় প্রাচীন ভবনের গম্বুজগুলো দেখেই কীভাবে এই শঙ্কু আকৃতির গম্বুজগুলো তৈরি করতে হয় তা শিখেছি। বর্তমান বাড়িগুলো ১৯৩৯ সালের দিকে নির্মিত হয়েছিল যখন আমি একটি বালক ছিলাম। আমাদের একটি গম্বুজের জন্য ১৩০০টি ইটের প্রয়োজন হয়েছিল। তবে এই ইট আমরা হাররানে তৈরি করিনি বরং প্রাচীন ভবনগুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকেই এই ইটগুলো সরবরাহ করেছি। আমি একদিনে দুই ডোম তৈরি করতে পারতাম।”
উক্ত আর্টিকেলে আরো বলা হয় যে, হাররানের বাড়িগুলো তৈরিতে ব্যাবহৃত মূল উপকরণ যেহেতু মাটি এবং ক্লে (Clay) দ্বারা তৈরি ইট দ্বারা নির্মিত হয়েছিল তাই এদের আয়ুষ্কাল নির্দিষ্ট। এটা বলা যায় যে, বর্তমানে যে বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো ৭০-১৫০ বছরের বেশি পুরাতন নয়। এটা প্রবলভাবে সম্ভব যে সময়ের সাথে সাথে শঙ্কু আকৃতির গম্বুজযুক্ত হাররানের এই বাড়িগুলো বহুবার ধ্বংস হয়ে গেছে, এবং পুনর্নির্মিত হয়েছে। ফলে সময়ের সাথে সাথে তাদের আকারে পরিবর্তনও হয়েছে।
তবে, হাররানের বাড়িগুলো ঠিক কত বছরের পুরোনো তা নিয়ে আরো অনুসন্ধান চালালে, তুরস্কের মূলধারার গণমাধ্যম Daily Sabah এর একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায় যেখানে হাররানের এই বাড়িগুলোর বয়স ২৫০ বছরের বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অর্থাৎ হাররানের বাড়িগুলো নিয়ে করা গবেষণা এবং তুরস্কের গণমাধ্যমের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হাররানের বাড়িগুলোর সাথে প্রায় ২৫০০ হাজার বছরেরও পুরোনো ইতিহাস জড়িয়ে থাকলেও বর্তমানে যেসব গম্বুজবিশিষ্ট বাড়ি দেখা যায় সেগুলো সর্বোচ্চ ২৫০ বছর পুরোনো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাই এত অল্প সময়কাল পূর্বে তুরস্কে তৈরিকৃত এই বাড়িগুলোকে প্রায় ১৫০০ বছর পূর্বে আরবের মক্কা নগরীতে বসবাসকারী হযরত ফাতেমা (রাঃ) এর বাড়ি দাবিতে প্রচারিত হলে তা স্পষ্টতই মিথ্যাচার। তাছাড়া, হযরত ফাতেমা (রাঃ) জীবিত থাকাকালীন অবস্থাতেও তুরস্কে তার কোনো বাড়ি ছিল কিনা সে ব্যাপারে ঐতিহাসিক প্রমাণও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য যে, তুরস্ক ব্যাতীত দক্ষিণ ইতালি, সাইপ্রাস এবং লিবিয়ার কিছু এলাকায় এই ধরনের গম্বুজ আকৃতির বাড়ি থাকার ব্যাপারে তথ্য থাকলেও সোদি আরবের মক্কায় এই ধরনের বাড়ি রয়েছে কিনা সেটির ব্যাপারেও কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।
মূলত, তুরস্কের সানলিউরফা প্রদেশের হাররান অঞ্চলে অবস্থিত একটি বাড়ির ছবিকে হযরত ফাতিমা (রাঃ) এর বাড়ি দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। তবে, রিউমর স্ক্যানারের বিস্তর অনুসন্ধানে তুরস্কের উক্ত স্থানটিতে হযরত ফাতিমা (রাঃ) এর বাড়ি থাকার ব্যাপারে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, তুরস্কের সানলিউরফা প্রদেশের হাররান অঞ্চলে অবস্থিত একটি বাড়ির ছবিকে কোনোপ্রকার গ্রহণযোগ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই হযরত ফাতিমা (রাঃ) এর বাড়ির ছবি দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Twitter: Harran evleri
- Turktoyu: Domed Harran Houses
- Research Paper: Vernacular domed houses of Harran, Turkey
- National Geographic: Assyrian Empire
- Daily Sabah: Harran’s domed houses offer a peek into life 250 years ago