বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’ গত ০৪ মে তাদের ‘এক টাকায় আহার’ নামক প্রজেক্টের ফেসবুকে পেজ থেকে রাজশাহীর একটি স্থানে খাবার বিতরণ সংক্রান্ত একটি পোস্ট করে।
পোস্টের (আর্কাইভ) ক্যাপশনে এ সংক্রান্ত তথ্যে উক্ত স্থানের নাম “মসজিদ পট্টি, চন্দ্রিমা থানা, রাজশাহী” বলে উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু পোস্টটির কমেন্ট এবং ফেসবুকে বেশকিছু স্বতন্ত্র পোস্টে মসজিদ পট্টি নামে রাজশাহীতে কোনো এলাকা না থাকা শীর্ষক দাবি ছড়িয়ে পড়েছে।
এক টাকায় আহার’ এর পোস্টে উক্ত দাবিতে কিছু কমেন্ট দেখুন –
একই দাবিতে কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজশাহীতে ‘মসজিদ পট্টি’ নামক স্থান না থাকার দাবিটি সঠিক নয় বরং রাজশাহীতে চন্দ্রিমা থানাধীন উক্ত নামে একটি স্থান রয়েছে যা লোকেমুখে পরিচিতি থাকলেও সাইনবোর্ড বা কোনো নেমপ্লেটে এই নাম নেই যা স্থানীয় মাদ্রাসার শিক্ষকসহ একাধিক ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে রাজশাহীতে চন্দ্রিমা নামে কোনো থানা রয়েছে কিনা সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের বোয়ালিয়া থানা ও পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের অংশ নিয়ে চন্দ্রিমা থানা গঠিত হয়।
তবে একাধিক মাধ্যমে (গুগল সার্চ, ফেসবুকের সার্চ টুলস, রাজশাহী সংশ্লিষ্ট ফেসবুক গ্রুপ) অনুসন্ধান করেও রাজশাহীতে মসজিদ পট্টি নামে কোনো স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে গুগলের ম্যাপ লোকেশন ব্যবহার করে ‘চন্দ্রিমা থানা মসজিদ পট্টি‘ লিখে সার্চ করলে সার্চের ফলাফলেও চন্দ্রিমা থানার অধীনে ‘মসজিদ পট্টি’ নামে কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তবে উক্ত সার্চ রেজাল্টে ‘ছোটবনগ্রাম’ নামক একটি এলাকার বেশকিছু স্থাপনার (যেমন ছোটবনগ্রাম উত্তর পাড়া জামে মসজিদ, ছোট বনগ্রাম পূর্ব পাড়া বড় জামে মসজিদ) লোকেশন দেখানো হয়।
ওপেন সোর্সে এ বিষয়ে আর কোনো তথ্য না পেয়ে রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে গত ০৫ই মে সকালে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা দাবি করেন, উক্ত স্থানের এমন নাম রয়েছে।
এ বিষয়ে গুগল ম্যাপ লোকেশন চাওয়ার প্রেক্ষিতে তারা রিউমর স্ক্যানারকে নিম্নোক্ত স্ক্রিনশটটি পাঠান।
বিঃদ্রঃ স্ক্রিনশটটির উপরে লগইন আইডির আইকন মুছে বাকিসব কিছু অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
স্ক্রিনশটটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রিউমর স্ক্যানার টিম গুগল ম্যাপের লোকেশনে ‘চন্দ্রিমা থানা মসজিদ পট্টি’ লিখে সার্চ করার পর ‘ছোটবনগ্রাম’ নামক যে স্থান সম্পর্কে জেনেছিল সেই একই স্থানই বিদ্যানন্দের পাঠানো স্ক্রিনশটে রয়েছে।
অর্থাৎ, বিদ্যানন্দেরও দাবি ‘ছোটবনগ্রাম’ নামক স্থানেই মসজিদ পট্টি রয়েছে।
এক টাকার আহার এর ফেসবুক পেজের পাশাপাশি একই প্রজেক্টের অফিশিয়াল গ্রুপেও একই পোস্ট (আর্কাইভ) করা হয়। উক্ত পোস্টে একই দিন (০৫ই মে) দুপুরে গ্রুপের অন্যতম এডমিন রেশমা আহমেদ এক ব্যক্তির জিজ্ঞাসার উত্তরে মসজিদ পট্টির ঠিকানা লিখেন, “চন্দ্রিমা, ছোটবোন গ্রাম পূর্ব পাড়া বড় মসজিদ এর পূর্ব দিকে রাস্তায় একটি বড় বস্তি এলাকা রয়েছে সেটা মসজিদ পট্টি নামে ডাকা হয়।”
লক্ষ্যণীয় যে, রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে পাওয়া লোকেশন, বিদ্যানন্দের পাঠানো লোকেশন স্ক্রিনশট এবং রেশমা আহমেদের করা কমেন্ট একই স্থানই নির্দেশ করছে।
এই বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফেসবুকে প্রকাশিত দুইটি ভিডিও নজরে আসে রিউমর স্ক্যানার টিমের।
রাজশাহীর স্থানীয় বাসিন্দা রকি ইসলামের একই দিন (০৫ই মে) দুপুরে তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত একটি ভিডিওতে (আর্কাইভ) মসজিদ পট্টি এলাকার বিষয়টি উঠে আসে।
তিনি চন্দ্রিমা থানা থেকে মসজিদ পট্টি পর্যন্ত যাওয়ার পথ ভিডিও করে দেখান এবং স্থানীয় দুইজন ব্যক্তির সাথে কথা বলেন। তারা জানান, উক্ত এলাকার নাম মসজিদ পট্টি এবং এক টাকায় আহার কর্তৃক খাবার বিতরণের তথ্যটিও সত্য বলে জানান।
পরবর্তীতে জাতীয় দৈনিক ‘আজকের পত্রিকা’র রাজশাহীর স্টাফ রিপোর্টার রিমন রহমানের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে প্রকাশিত আরেকটি ভিডিও (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে এক দোকানদার এলাকাটি মসজিদপাড়া বা মসজিদ পট্টি নামে পরিচিত বলে জানান। অন্য এক ব্যক্তি এলাকাটিকে চৌধুরীপাড়া মসজিদপট্টি নামে ডাকা হয় বলে জানান।
একই দিন (০৫ই মে) বিকেলে ‘আজকের, পত্রিকা’য় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “নগরীর চন্দ্রিমা থানার ছোটবনগ্রাম মোড় থেকে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলেই ছোটবনগ্রাম পূর্বপাড়া। এই মোড় থেকে কিছুটা পূর্বে এগিয়ে গেলেই রয়েছে একটি বস্তি। এই স্থানটির নামই মসজিদপট্টি। এটি সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড। এলাকাটিকে কেউ চৌধুরীপাড়া মসজিদপট্টি আবার কেউ ছোটবনগ্রাম পূর্বপাড়া মসজিদপট্টি হিসেবে চেনেন।”
স্থানটির বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানের জন্য রিউমর স্ক্যানার টিম ফের গুগল ম্যাপের শরণাপন্ন হয়।
ছোটবনগ্রাম’ নামক স্থানটির স্ট্রিটভিউ পদ্ধতি ব্যবহার করে উক্ত ‘ছোটবনগ্রাম পূর্বপাড়া’ নামক স্থানটিতে কোনো সাইনবোর্ড বা নামপ্লেটে ‘মসজিদ পট্টি’ নাম রয়েছে কিনা সেটি খুঁজে দেখি আমরা।
তবে উক্ত রাস্তার একাধিক দোকানের সাইনবোর্ড এবং বাসার নামফলকে খুঁজেও ‘মসজিদ পট্টি’ নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, উক্ত স্থানের স্ট্রিট ভিউটি সর্বশেষ ২০১৫ সালে আপডেট করা হয়। তাই উক্ত স্থানে পরবর্তী আট বছরে নতুন স্থাপনা এবং তাদের নামফলকের বিষয়ে কোনো তথ্য আপডেট হয়নি।
পরবর্তীতে উক্ত রাস্তার স্ট্রিট ভিউ’তে ‘স্বপন ইলেকট্রিক এন্ড মাল্টিমিডিয়া জোন‘ নামক একটি দোকান এবং দোকানটির সাইনবোর্ড পাওয়া যায়। সাইনবোর্ডে দোকানটির অবস্থান ‘ছোটবনগ্রাম পূর্বপাড়া, বড়মসজিদের মোড়, বোয়ালিয়া, রাজশাহী’ বলে উল্লেখ রয়েছে। রিউমর স্ক্যানার টিম দোকানটির সাইনবোর্ডে থাকা ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে দোকানটির স্বত্ত্বাধিকারী মো: স্বপন সরকারের সাথে আলাপ করে৷ তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “এলাকাটিকে অনেকে মসজিদ পট্টি নামেও ডাকে। তবে সাইনবোর্ডে ইউজ (ব্যবহার) হয় না।”
এ বিষয়ে আরও নিশ্চিত হতে একই রাস্তার স্ট্রিট ভিউতে রিউমর স্ক্যানার টিম ‘তালিমুল কুরআন হাফিজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার লিল্লাহ বোডিং‘ নামক একটি স্থাপনা এবং স্থাপনাটির সাইনবোর্ড খুঁজে পায়।
উক্ত সাইনবোর্ডে স্থাপনাটির অবস্থান ‘ছোটবনগ্রাম পূর্বপাড়া-বড় মসজিদ সংলগ্ন, সপুরা, রাজশাহী’ বলে উল্লেখ রয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিম উক্ত সাইনবোর্ডে থাকা ফোন নাম্বারটি যাচাই করে দেখতে পায়, এটি হাফেজ আবদুল মজিদ নামক এক ব্যক্তির নাম্বার।
পরবর্তীতে জনাব মজিদের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বর্তমানে উক্ত মাদ্রাসার সাথে সম্পৃক্ত নন বলে জানান। তবে তিনি একই এলাকার উত্তর পাড়ায় ‘দারুণ নাজাত মাদ্রাসা’ নামে আরেকটি মাদ্রাসায় দায়িত্বে রয়েছেন বলে জানান।
হাফেজ আবদুল মজিদের কাছে আলোচ্য বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, ” মসজিদের কিছু জায়গা আছে, ওখানে ওই এলাকায় যারা থাকে তাদের কাছে মসজিদ পট্টি হিসেবে নামটি পরিচিত। এমনিতে সাইনবোর্ড বা ব্যানারে কেউ ওই নাম ব্যবহার করে না।”
অর্থাৎ, স্থানীয় একাধিক ব্যক্তিই বলছেন, সংশ্লিষ্ট এলাকাটি মসজিদ পট্টি নামেও পরিচিত।
মূলত, গত ০৪ মে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কর্তৃক রাজশাহীর চন্দ্রিমা থানার মসজিদ পট্টি এলাকায় খাবার বিতরণ সংক্রান্ত পোস্ট দেওয়ার পর কমেন্ট এবং বেশকিছু স্বতন্ত্র পোস্টে মসজিদ পট্টি নামে রাজশাহীতে কোনো এলাকা না থাকার একটি দাবি ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, বিদ্যানন্দ রাজশাহীর চন্দ্রিমা থানা এলাকার ছোটবনগ্রাম পূর্ব পাড়া বড় মসজিদ এর পূর্ব দিকে রাস্তায় খাবার বিতরণ করেছে। উক্ত স্থানটি স্থানীয়দের কাছে মসজিদ পট্টি নামে পরিচিত বলে মাদ্রাসার শিক্ষকসহ একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেছেন।
প্রসঙ্গত, পূর্বে কয়েক ঘন্টা আগে পুড়ে যাওয়া কাপড় থেকে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন অলংকার তৈরি করেছে দাবিতে ভিন্ন একজনের তৈরি পুরোনো অলংকারের ছবি প্রচার করার প্রেক্ষিতে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের খাবার বিতরণ কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে রাজশাহীতে ‘মসজিদ পট্টি’ নামক স্থান না থাকা শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rajshahi Metropolitan Police: Police station history
- Google Map: চন্দ্রিমা থানা মসজিদ পট্টি
- Rocky Islam: Facebook Video
- Remon Rahman: Facebook Video
- Statement & Resource from Bidyanondo Foundation
- Ajker Patrika: রাজশাহীতে আছে ‘মসজিদপট্টি’, খাবারও দিয়েছে বিদ্যানন্দ
- Google Map: স্বপন ইলেকট্রিক এন্ড মাল্টিমিডিয়া জোন
- Google Map: তালিমুল কুরআন হাফিজিয়া কওমিয়া মাদ্রাসার লিল্লাহ বোডিং
- Rumor Scanner’s own analysis
- Statement from Hafez Abdul Mojid
- Statement from Shawpon Sarker