শেখ হাসিনা সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার গুজব

সম্প্রতি, গত ২৯ মার্চ mdmintumoral1 নামক একটি টিকটক অ্যাকাউন্ট থেকে শেখ হাসিনা সরকারকে স্যাংশন দিলো যুক্তরাষ্ট্র দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা

ভিডিওটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)

টিকটকের এই ভিডিওটি এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষাধিক বার দেখা হয়েছে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনা সরকারকে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে ঘোষণা দেয়। নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে বিবৃতি দিলেও এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনা সরকারকে কোনো  নিষেধাজ্ঞা দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। 

অনুসন্ধানের শুরুতেই আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। আলোচিত ভিডিওটি’র শিরোনাম এবং ইন্ট্রোতে উল্লেখিত দাবিগুলোর সাথে ভিডিওটি’র বিস্তারিত অংশের মিল পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে প্রচারিত ভিডিওটির লগো দেখে কি-ওয়ার্ড সার্চ করে ‘প্রথম কলকাতা’ ইউটিউব চ্যানেলে ১৮ মার্চ ‘আসছে মার্কিন স্যাংশন; প্রশ্নবিদ্ধ ৭ জানুয়ারির বাংলাদেশের নির্বাচন ! আদৌ মার্কিন চাপে রয়েছে ঢাকা ?’ শিরোনামে প্রকাশিত মূল ভিডিওটি পাওয়া যায়। মূল ভিডিওটি ৮ মিনিট দুই সেকেন্ডের। 

Image comparison: Rumor Scanner

আলোচিত ভিডিওটির ইন্ট্রোতে দাবি করা হয়, বাংলাদেশকে সেই আন এক্সপেক্টেড ঝটকাটা দিয়েই দিলো যুক্তরাষ্ট্র। আগে বলেছিল অবাধ ও সুষ্ঠ হয়নি নির্বাচন, তারপর দীর্ঘদিন চুপ থেকে আচমকাই ইউ টার্ন আমেরিকার। এবার আঙুল তুলল কীভাবে? কোন দিক থেকে খামতি ছিল বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে? কিচ্ছু নজর এড়াইনি, কি কি পয়েন্ট আউট করে দেখালো দু দুটো মার্কিন সংস্থা? জবাবেই বা কি বললো হাসিনা সরকার? এবার কি স্যাংশন অবধারিত? বিএনপি সহ অন্যান্য সরকার বিরোধী দলগুলোর সোনায় সোহাগ।’

ভিডিওটিতে আরও বলা হয়, নির্বাচন শেষের পর দুই মাস পেরোতেই যুক্তরাষ্ট্রের দুই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক সংস্থা সাফ জানালো ৭ জানুয়ারীর নির্বাচনে গুণগত মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের ভোটের ফল বেরোনোর পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার পর যুক্তরাষ্ট্র একটা আধা, আধুরা অস্পষ্ট আপ্সা স্ট্যান্ড পয়েন্টে দাড়িয়ে ছিল ।

আরও বলা হয়, আগেই জানা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দুই পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ করছে। কে ভেবেছিল বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে ১৮০ ডিগ্রি এ্যঙেলে ঘুরে গেছে আমেরিকা। সব কিছু  এবার ভুল প্রমাণিত হয়ে গেল।

বাংলাদেশর নির্বাচন নিয়ে এনডিআই ও আইআরআই এর ২৯ পাতার রিপোর্ট এবং রিপোর্টটি নিয়ে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন ‘৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ‘গুণগত মান’ ক্ষুণ্ণ হয়েছে, মূল্যায়ন দুই মার্কিন সংস্থার’ কথাও বলা হয় ভিডিওটিতে। 

এছাড়াও বলা হয়, মূল কথা সব দিক থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামলীগকে চাপে ফেলার চেষ্টা করেছে যুক্তরাষ্ট্র । তাহলে কি বাইডেনের চিঠি বাংলাদেশের সঙে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছে সব কিছু নিমিষের মধ্যে মিথ্যে হয়ে গেলো!? যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের পর থেকে এতদিন একরকম ছবি সাজালো বাংলাদেশের সামনে তারপর এই বুলবদল । মার্কিন রিপোর্টে বাংলাদেশের নির্বাচনকে তুলোধুনোর পর এই প্রশ্নগুলোই উঠছে। তবে এই বিষয়ে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামলীগের বক্তব্য , তাদের জবাব কি? 

ভিডিওর শেষের দিকে বলা হয়,  বাংলাদেশের নির্বাচনের গুনগত মান নিয়ে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে এত সহজেই কি ছেড়ে দিবে বাইডেন প্রশাসন ? । ভোট পর্যবেক্ষণ না মূলত ভোটকে মূল্যায়ন করেছে এনডিআই ও আইআরআই।যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। তাই কখন কি ঘটে যায় তা প্রেডিক্ট করা কঠিন। 

অর্থাৎ, পুরো ভিডিওটিতে কোথাও বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিয়েছে এমন কথা ছিলো না । 

বাংলাদেশের নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কেমন ছিলো জানতে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট-ডিপার্টমেন্ট এর ওয়েবেসাইটে COUNTRIES & AREAS অপশনে বাংলাদেশ ক্লিক Highlights এ ৮ জানুয়ারী Parliamentary Elections in Bangladesh শিরোনামে একটি বিবৃতি পাওয়া যায় ।

বিবৃতিটিতে সবগুলো দল এই নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র হতাশ হয়েছে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্টের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য পর্যবেক্ষকদের মতো এই মতামত ব্যক্ত করে যে, জানুয়ারির ৭ তারিখে হওয়া বাংলাদেশের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠ ছিল না।

Screenshot: U.S. Department of State

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতির মাধ্যমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার।

বিবৃতিতে ম্যাথিউ মিলার বলেন, আজ, স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের পদক্ষেপ নিচ্ছে।  এই ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন ও  বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যরা রয়েছে। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এর আগে একই বছরের ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বাংলাদেশের জন্য নতুন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেন। এ নীতির অধীনে বাংলাদেশের ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী’ ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা না দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।

বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেন, আজ, আমি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য অভিবাসন ও জাতীয়তা আইনের ধারা ২১২ (এ) (৩) (সি) (“৩সি”) এর অধীনে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করছি। এই নীতির অধীনে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদান সীমিত করবে । এর মধ্যে বর্তমান ও প্রাক্তন বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালের ৩ মে বাংলাদেশ সরকারকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়।

চলতি বছরের ১৬ মার্চ এনডিআই (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট) এবং আইআরআই (ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট) বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ‘NDI/IRI Technical Assessment Mission Releases Final Report on the 2024 Bangladesh Elections’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়,  ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, চলাকালীন ও পরে সম্ভাব্য নির্বাচনী সহিংসতা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশে প্রেরন করা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) টেকনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট মিশন (টিএএম) আজ তার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী সহিংসতার বিষয়ভিত্তিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনে সহিংসতার ঝুঁকি প্রশমন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আইআরআই ও এনডিআই’র তুলনামূলক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন, সরকারের নির্বাহী ও আইন বিভাগ, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য অংশীজনদের কাছে সুপারিশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

Screenshot:  International Republican Institute

মূলত, বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী ‍যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠ হয় সে বিষয়ে বিবৃতি দেন এবং নির্বাচনে অনিয়ম হলে জড়িত বা দায়ী ব্যক্তিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও বলা হয়। তবে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিরপেক্ষ হয়নি উল্লেখ করলেও এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে শেখ হাসিনা সরকারকে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ (বিএনপি) বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের এর নির্বাচন বর্জনের মাঝেই গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করে শেখ হাসিনা সরকার টানা চতুর্থ বারের মতো সরকার গঠন করে।

সুতরাং, শেখ হাসিনা সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মর্মে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img