তুরস্কের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ নিয়ে প্রথম আলোয় অনূদিত কলামে বিকৃতি

গত ৩০ মে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’র প্রিন্ট সংস্করণে “এরদোয়ান জিতলেন, কিন্তু তুরস্ক কি জিতল” শিরোনামে প্রকাশিত অষ্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টুয়ার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মেহমেত ওজাল্প এর একটি কলামে (অনূদিত) দাবি করা হয়েছে, “জরিপে দেখা গেছে, তিনি (ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলু) জেলের বাইরে থাকলে ভালোভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানকে হারাতে পারতেন। ইমামোলুর অনুপস্থিতিতে সবচেয়ে দুর্বল ভাবমূর্তির নেতা কিলিচদারওলুকে বিরোধীরা সমর্থন দিতে বাধ্য হয়।”  

প্রথম আলোর প্রিন্ট সংস্করণটি দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

অনলাইনে সংস্করণে উক্ত কলাম পড়ুন এখানে।  

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রথম আলোয় ইংরেজি থেকে অনূদিত কলামের তথ্য দাবি করা হলেও মূল ইংরেজি কলামে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলুর বিষয়ে তিনি জেলে আছেন এবং তার অনুপস্থিতিতে দুর্বল ভাবমূর্তির নেতা কিলিচদারওলুকে বিরোধীরা সমর্থন দিতে বাধ্য হয় শীর্ষক তথ্যগুলো উল্লেখ নেই। তাছাড়া, নির্বাচনের সময় তিনি কারাবন্দীও ছিলেন না এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনুপস্থিতও ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ইমামোলুর অনীহা থাকলেও তার দলের প্রার্থীর পক্ষে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। 

অনুসন্ধানের শুরুতে প্রথম আলোর আলোচিত কলামটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, মেহমেত ওজাল্প এর লেখা কলামটি প্রথম আলো ‘এশিয়া টাইমস’ থেকে সংগ্রহ করে ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে। 

পরবর্তীতে হংকং ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম Asia Times এর ওয়েবসাইটে গত ২৯ মে প্রকাশিত কলামটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

এশিয়া টাইমস কলামটি সংগ্রহ করেছে The Conversation থেকে। 

Screenshot source: Asia Times 

অনুসন্ধানে অষ্ট্রেলিয়ার সংবাদমাধ্যম The Conversation এর ওয়েবসাইটে গত ২৮ মে প্রকাশিত মূল কলামটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot source: The Conversation 
প্রথম আলো মূল কলাম বিকৃত করেছে? 

The Conversation এ প্রকাশিত মূল কলামটি হুবহুই প্রকাশ করেছে Asia Times। তবে প্রথম আলো’র প্রিন্ট সংস্করণে প্রকাশিত একই কলামে মূল কলামের সাথে বেশ কিছু অসঙ্গতি নজরে এসেছে রিউমর স্ক্যানার টিমের। 

কলামটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রথম আলো এই কলামটির সংক্ষেপিত সংস্করণ প্রকাশ করেছে। কিন্তু পত্রিকাটি বিষয়টি তাদের কলামে উল্লেখ রাখেনি।

তাছাড়া, একরেম ইমামোলুর বিষয়ে The Conversation এর কলামে এসেছে, “জরিপে দেখা গেছে, তিনি (ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলু) ভালোভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানকে হারাতে পারতেন। ইমামোলু দৃশ্যপটের বাইরে থাকায় সবচেয়ে দুর্বল ভাবমূর্তির নেতা কিলিচদারওলুকে বিরোধীদের সমর্থন দিতে হয়েছিল।”

কিন্তু প্রথম আলো একই লাইনগুলোর অনুবাদ লিখেছে এভাবে, “জরিপে দেখা গেছে, তিনি (ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলু) জেলের বাইরে থাকলে ভালোভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানকে হারাতে পারতেন। ইমামোলুর অনুপস্থিতিতে সবচেয়ে দুর্বল ভাবমূর্তির নেতা কিলিচদারওলুকে বিরোধীরা সমর্থন দিতে বাধ্য হয়।” 

Screenshot collage: Rumor Scanner 

অর্থাৎ, প্রথম আলোর প্রিন্ট সংস্করণের ইংরেজি থেকে অনূদিত কলামে মূল কলামের লেখা বিকৃত করা হয়েছে।  

একরেম ইমামোলু কি জেলে আছেন? 

প্রথম আলো তাদের কলামে দাবি করেছে, তুরস্কের ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলু জেলে আছেন। এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে জানা যায়, গত বছরের (২০২২) ১৪ ডিসেম্বর সরকারি কর্মকর্তাদের মানহানির দায়ে একরেম ইমামোলুকে ২ বছর ৭ মাসের কারাদণ্ড দেয় দেশটির আদালত। মেয়র একরেম এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন বলে সে সময় জানিয়েছিল কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। যদি উচ্চ আদালতে এ কারাদণ্ড বহাল থাকে, তবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না তিনি। তবে এর আগ পর্যন্ত মেয়র পদে থাকা এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপে অংশ নিতে তার কোনো বাধা নেই। 

ইমামোলু এই সাজার ফলে এখন পর্যন্ত একদিনের জন্যও কারাবরণ করেননি। বরং তাকে তার দলের প্রার্থী কিলিচদারওলুর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে দেখা গেছে। এমনকি তিনি নির্বাচনে ভোটও দিয়েছেন।

অর্থাৎ, প্রথম আলোর কলামে ইমামোলু জেলে আছেন বলে যে দাবি করা হয়েছে তা সঠিক নয়। 

ইমামোলু কি রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছিলেন? 

তুরস্কের রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা সংক্রান্ত আইন বলছে, একজন ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য, তাকে সংসদ সদস্য হওয়ার মানদণ্ড পূরণ করতে হবে। আইনে বলা হয়েছে, ‘অবহেলা অপরাধ ব্যতীত যারা মোট এক বছর বা তার বেশি কারাদণ্ড এবং ভারী কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন, তারা সংসদের প্রার্থী হতে পারবেন না। তখন রাষ্ট্রপতি পদে তার প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। 

এ সংক্রান্ত দুইটি আইন দেখুন এখানে (১০১ নং) এবং এখানে (১১ নং)। 

তবে ইমামোলু চাইলেই নির্বাচনে দাঁড়াতে পারতেন। তুরস্কের ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা Dogrula এর একজন ফ্যাক্ট চেকার রিউমর স্ক্যানার টিমকে বলছিলেন, ইমামোলুর মামলা এখনও যেহেতু বিচারাধীন তাই তিনি তার প্রার্থী হতে বাধা ছিল না। একই কারণে তিনি এখনও মেয়র পদে রয়েছেন। 

অর্থাৎ, ইমামোলুর রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য আইনগত কোনো বাধা ছিল না। 

কিন্তু তার এই পদে দাঁড়ানোর ইচ্ছে ছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়। 

গত মার্চে ইমামোলু প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য তার দলের পক্ষ থেকে পাওয়া আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেন। 

গত বছরের (২০২২) মে মাসে ইমামোলু এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়া তার এজেন্ডায় নেই। 

অর্থাৎ, ইমামোলু চাইলেই রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হতে পারতেন। এতে আইনগত কোনো বাধা ছিল না তার। 

কী বলছেন মূল কলাম লেখক? 

কলামটির বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম যোগাযোগ করেছিল মূল লেখক মেহমেত ওজাল্পের সাথে, যিনি অষ্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টুয়ার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।  

মেহমেত ওজাল্পের সাথে যখন আমরা যোগাযোগ করি তখন তিনি ছুটিতে। মেইল মারফত আমাদের জানানো হয়, তিনি ১২ জুন পর্যন্ত ছুটিতে থাকবেন। তবে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে একইদিন রাতেই জনাব ওজাল্প আমাদের প্রশ্নের উত্তরগুলো পাঠান। 

একরেম ইমামোলু জেলে থাকা সংক্রান্ত কোনো মন্তব্য যেহেতু মেহমেত ওজাল্প করেননি, তাই আমরা তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো মতামত জানতে চাইনি। ওজাল্পের কাছে আমরা দুইটি বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম। 

প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল, তিনি (মেহমেত ওজাল্প) একরেম ইমামোলু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দৃশ্যপটের বাইরে ছিলেন বলে দাবি করেছেন তার কলামে। কিন্তু নির্বাচনে প্রচারণার কাজে ইমামোলুকে নিয়মিতই দেখা গেছে। প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়া একরেম ইমামোলুর এজেন্ডায় নেই বলেও মন্তব্য করেছিলেন ইমামোলু। এ বিষয়গুলো মেহমেত ওজাল্পকে জানানোর পর তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “একরেম ইমামোলু নির্বাচনে ছিলেন এবং কিলিচদারওলুকে সমর্থন করেছিলেন কিন্তু তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন না। কিলিচদারওলু স্বাভাবিকভাবেই চেয়েছিলেন এবং ইমামোলুর মতো তার দলের শক্তিশালী ব্যক্তিত্বদের সমর্থন পেয়েছিলেন। এটি এই সত্যটি পরিবর্তন করে না যে ইমামোলু তার বিরুদ্ধে নির্বাচনী অফিসকে অপমান করার মতো সন্দেহজনক অভিযোগে আদালতে মামলার কারণে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেননি।” 

তবে তার মন্তব্যটি যে সঠিক ছিলনা তা স্পষ্ট আমাদের উল্লেখিত আগের প্যারাতেই। 

মেহমেত ওজাল্প তার কলামে দাবি করেছেন, “জরিপে দেখা গেছে, তিনি (ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলু) ভালোভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানকে হারাতে পারতেন।” 

কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাসখানেক আগে পরিচালিত দুইটি জরিপের ফলে দেখা গেছে, এরদোয়ানই অন্য প্রার্থীদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন একাধিক জরিপই হয়েছে। মেহমেত ওজাল্পের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম, তিনি ঠিক কোন জরিপের তথ্য তার কলামে উল্লেখ করেছেন। 

এই প্রশ্নের জবাবে মেহমেত ওজাল্প রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “কয়েক বছর ধরে তুরস্কের পোলিং সংস্থাগুলোর অসংখ্য জরিপ দেখা গেছে যে একরেম ইমামোলু প্রার্থী হলে এরদোয়ানের বিরুদ্ধে জয়ী হবেন। এরদোয়ানের বিরুদ্ধে কারা শক্তিশালী প্রার্থী তা পরীক্ষা করার জন্যই এই জরিপগুলো করা হয়েছে। 

মেহমেত ওজাল্প দুইটি জরিপের লিংক পাঠিয়েছেন রিউমর স্ক্যানারের কাছে। দেখুন এখানে (ফেব্রুয়ারি, ২০২২), এখানে (মে, ২০২০)।

অর্থাৎ, মেহমেত ওজাল্প নির্বাচনের আগের অন্তত বছর খানেক পুরোনো জরিপের ফলাফলের তথ্য দিয়েছেন তার কলামে। কিন্তু প্রার্থী ঘোষণা পরবর্তী সময়ের জরিপগুলো বলছে, এরদোয়ানই অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন সেসময়। 

মূলত, গত ৩০ মে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’র প্রিন্ট সংস্করণে “এরদোয়ান জিতলেন, কিন্তু তুরস্ক কি জিতল” শিরোনামে প্রকাশিত অষ্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টুয়ার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক মেহমেত ওজাল্প এর লেখা একটি কলামে (অনূদিত) দাবি করা হয়েছে, “জরিপে দেখা গেছে, তিনি (ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলু) জেলের বাইরে থাকলে ভালোভাবেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এরদোয়ানকে হারাতে পারতেন। ইমামোলুর অনুপস্থিতিতে সবচেয়ে দুর্বল ভাবমূর্তির নেতা কিলিচদারওলুকে বিরোধীরা সমর্থন দিতে বাধ্য হয়।” কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মূল কলামে ইমামোলুর জেলে থাকা শীর্ষক কোনো তথ্য নেই এবং নির্বাচনের সময় তিনি কারাবন্দীও ছিলেন না। তাছাড়া, প্রথম আলো উক্ত কলামের সংক্ষেপিত সংস্করণ প্রকাশ করেছে। কিন্তু পত্রিকাটি এই বিষয়টি তাদের কলামে উল্লেখ রাখেনি।

উল্লেখ্য, গত ১৪ মে তুরস্কে প্রথম দফা নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য কোনো প্রার্থীই প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ ভোট পাননি। পরবর্তীতে গত ২৮ মে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে জয়ী হন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান।

প্রসঙ্গত, তুরস্কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিষয়ে পূর্বে গুজব ছড়িয়ে পড়লে তা সনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল রিউমর স্ক্যানার।  

সুতরাং, প্রথম আলোয় এরদোয়ানের বিষয়ে অনূদিত কলামে ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোলুর বিষয়ে প্রচারিত তথ্যগুলো বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img