বিগত কয়েক বছর ধরেই “চীনের মহাপ্রাচীর একমাত্র মানবসৃষ্ট স্থাপনা যেটি চাঁদ থেকেও খালি চোখে দেখা যায়” শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়।
২০২৪ সালে ইন্টারনেটে প্রচারিত এমনকিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)
২০১৮ সালের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)
২০১৫ সালের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)
২০১৪ সালের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, চীনের মহাপ্রাচীর চাঁদ থেকে খালি চোখে দেখা যায় না বরং পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ১৮০ মাইল উচ্চতায় অবস্থিত আন্তজার্তিক মহাকাশ স্টেশন থেকেও চীনের মহাপ্রাচীর স্পষ্টভাবে দেখা যায় না, সেখানে পৃথিবী থেকে প্রায় ২ লাখ ৩৭ হাজার মাইল দূরের চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে চীনের মহাপ্রাচীর খালি চোখে দেখতে পাওয়া অসম্ভব।
আনুমানিক ২২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীনের প্রথম রাজা কিন শি হুয়াং মহাপ্রাচীরের নির্মাণকাজ শুরু করেন। চীনের ছোটবড় সকল রাজ্যকে হারিয়ে চীনা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি চীনের অভ্যন্তরীণ পুরোনো দেয়ালগুলো ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সেইসাথে উত্তরাঞ্চলের যাযাবর গোষ্ঠীগুলোর লুটপাটের হাত থেকে বাঁচতে বিশাল প্রাচীর নির্মাণ শুরু করেন তিনি। পরবর্তীতে, বিভিন্ন সময়ে একাধিক সাম্রাজ্যের সম্রাটগণ প্রাচীরের পরিবর্ধন ও সংস্কার করেন। প্রাচীরের মাঝে শত্রুপক্ষের গতিবিধি নজরদারির জন্য ওয়াচ টাওয়ারও নির্মিত হয়। প্রাচীর নির্মাণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল মিং সাম্রাজ্যের সম্রাটগণের। তারা প্রাচীরের দৈর্ঘ্য উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্ধিত করেন এবং প্রাচীর নির্মাণে উচ্চমানের পাথরের ব্যবহার করেন যা প্রাচীরের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্ব দুই-ই বৃদ্ধি করে।
এখানে বলে রাখা ভালো, চীনের মহাপ্রাচীর কোনো একক স্থাপনা নয় বরং অনেকগুলো প্রাচীর একত্রে গ্রেট ওয়াল অব চায়না নামে পরিচিত। এসকল প্রাচীরের সম্মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ২১,১৯৬ কিলোমিটার বা ১৩,১৭১ মাইল এবং প্রশস্ততা গড়ে প্রায় ৪-৫ মিটার। যার অনেকটাই এখন ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। কিন্তু, চীনা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নিদর্শন হয়ে প্রাচীরের বাকি অংশ এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৮৭ সালে ইউনেস্কো প্রাচীন পৃথিবীর সপ্তাচর্যের মধ্যে অন্যতম এই স্থাপনাটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
চীনের মহাপ্রাচীর কি সত্যিই চাঁদ থেকে খালি চোখে দেখা যায়?
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা’র ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই মিথ প্রচলিত থাকলেও প্রকৃতপক্ষে চাঁদ থেকে চীনের মহাপ্রাচীর দেখা যায় না।
নাসার ওয়েবসাইটে, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন থেকে এক্সপেডিশন ১০ এর কমান্ডার লিরোয় শিও’র তোলা মহাপ্রাচীরের একটি ছবি পাওয়া যায়। উচ্চশক্তির ক্যামেরা লেন্সের সাহায্যে ছবিটি তোলা হয়। কিন্তু বিষয়টি নিশ্চিত করে যে, খালি চোখে চীনের মহাপ্রাচীরের এমন দৃশ্য দেখা সম্ভব নয়। শুধু উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরা লেন্স দ্বারাই এ ধরণের ছবি তোলা সম্ভব।
এছাড়াও, ওয়েস্ট টেক্সাস ইউনিভার্সিটি’র ওয়েবসাইটে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক Christopher Baird এক প্রশ্নের জবাবে জানান, চীনের মহাপ্রাচীর অনেক লম্বা হলেও এর প্রশস্ততা অনেক কম। ফলে কম উচ্চতার কক্ষপথ থেকেও চীনের মহাপ্রাচীর খালি চোখে দেখা দুষ্কর। শুধু চীনের মহাপ্রাচীই নয়, পৃথিবীর কোনো মানবসৃষ্ট স্থাপনাই অধিক উচ্চতা থেকে খালি চোখে দেখা যায় না।
এ বিষয়ে কী বলছেন মহাকাশচারীরা?
নাসার শাটল অ্যাস্ট্রনট জে অ্যাপট জানান, “যদিও মহাকাশ স্টেশন থেকে চীনের মহাপ্রাচীর ছাড়াও মানবসৃষ্ট আরো কিছু অবকাঠামো অনুধাবন করা যায় তবু পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ১৮০ মাইল উপরে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন থেকেই চীনের মহাপ্রাচীর খালি চোখে দেখা খুবই দুষ্কর। সেখানে পৃথিবী থেকে ২ লাখ ৩৭ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে চীনের মহাপ্রাচীর দেখতে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।”
তিনি আরো জানান, “চাঁদ থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে একটি সুন্দর গোলক(পৃথিবী) দেখা যায়, যার অধিকাংশই সাদা(মেঘ), কিছু নীল(সমুদ্র), টুকরো টুকরো হলুদ(মরুভূমি) এবং মাঝেমাঝে কিছু সবুজ রং(গাছপালার রং)। চাঁদ থেকে মানবসৃষ্ট কোনো বস্তুই দেখা সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে কয়েক হাজার মাইল উপরে পৌঁছলেই পৃথিবীতে অবস্থিত কোনো মানবসৃষ্ট বস্তু দেখা সম্ভব না।”
যেভাবে এলো এই জনশ্রুতি
১৯৩২ সালে রবার্ট রিপলি’র বিখ্যাত বিলিভ ইট অর নট ট্যাগলাইনে তিনি বলেন, “চীনের মহাপ্রাচীর ‘হতে পারে’ পৃথিবীর একমাত্র মানবসৃষ্ট স্থাপনা যা চাঁদ থেকে দেখা যায়”। পরবর্তীতে, তার এই ধারণাই সত্যি হিসেবে একসময় শহুরে শ্রুতিকথায় পরিণত হয়। যদিও রবার্ট রিপলি এককভাবে এ কৃতিত্বের দাবিদার নন। তারও অনেক বছর আগে, ১৯০৪ সালে হেনরি নরম্যানের লেখা ‘মানুষ এবং পুবের রাজনীতি’ বইতে বলা হয়েছিল যে, “প্রাচীরটি তৈরির সময়কাল যেমন বিস্মিত করে, তেমনি আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এটি চাঁদ থেকেও দেখা যায়।”
এছাড়াও, ১৯৩৮ সালে আমেরিকান পরিব্রাজক রিচার্ড হ্যালি বার্টনের ‘বুক অব মার্ভেলস:দ্য ওরিয়েন্ট’ প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, “চীনের প্রাচীর মানব সৃষ্ট একমাত্র স্থাপনা, যা চাঁদ থেকেও দেখা যায়।” বার্টনের ভ্রমণবিষয়ক বইগুলো বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ভালো সাড়া পেয়েছিল। সুতরাং, চীনের মহাপ্রাচীর বিষয়ক বিভ্রান্তি তৈরিতে তাঁরও বিশেষ ভূমিকা ছিল! আর এরপর প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ শ্রুতিকথা লোকমুখে প্রচলিত হয়ে এসেছে।
মূলত, বহু বছর ধরেই “চীনের মহাপ্রাচীর একমাত্র মানবসৃষ্ট স্থাপনা যেটি চাঁদ থেকেও খালি চোখে দেখা যায়” শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য ইন্টারনেটে প্রচার করা হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মানবসৃষ্ট এই স্থাপনাটি ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৮০ মাইল দূরের আন্তজার্তিক মহাকাশ স্টেশন থেকেই খালি চোখে দেখতে পাওয়া দুষ্কর। সেখানে পৃথিবী থেকে ২ লাখ ৩৭ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে চীনের মহাপ্রাচীর খালি চোখে দেখতে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই।
সুতরাং, “চীনের মহাপ্রাচীর একমাত্র মানবসৃষ্ট স্থাপনা যেটি চাঁদ থেকেও খালি চোখে দেখা যায়” শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য ইন্টারনেটে প্রচারিত হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- National Geographic: “ The Great Wall of China”
- Britannica: “Great Wall of China”
- NASA: “Great Wall”
- wtamu: “What makes the Great Wall of China the only man-made object visible from space?”
- Snopes: “Is the Great Wall of China Visible from the Moon?”
- The Telegraph: “Five myths about the Great Wall of China”
- Rumor Scanner’s own analysis