ফ্রিজে রাখা দুধ পান করে সাপের বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনাটি ভুয়া

সম্প্রতি, ফ্রিজে রাখা দুধ পান করে সাপের বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যুর বিষয়ে একটি ঘটনা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। 

যা দাবি করা হচ্ছে

ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে দুইটি ছবি রয়েছে। প্রথম ছবিতে একটি ফ্রিজ খোলা অবস্থায় ভেতরে কোল্ড ড্রিংকসের দুইটি বোতল এবং নিচের একটি তাকে সাপ সদৃশ একটি বস্তু দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় ছবিতে এক ব্যক্তির আঙ্গুলের ডগায় সাপ সদৃশ আরেকটি প্রাণী দেখা যাচ্ছে। 

পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, “সকালে একই পরিবারের দুই নিষ্পাপ শিশুকে বিছানায় মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাদের মৃত্যুর সম্ভাব্য কারণ তদন্ত করে তাদের খাদ্য-পানের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে বাচ্চাদের মা বলেন, বাচ্চারা বাইরে থেকে কিছু খায়নি, কিন্তু ঘুমানোর সময় প্রতিদিনের মত আজও এক গ্লাস করে দুধ দেওয়া হয়।

ফ্রিজে দুধের পাত্র পরিদর্শন করলে পাত্রের নীচে ৩/৪ ইঞ্চি বিষধর সাপের এই বাচ্চাটি মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরিবারের কথা মনে পড়ে সব্জি বাজার থেকে শাক এনে শাকের বান্ডিল না খুলে ফ্রিজে রেখেছিল। সম্ভবত সাপের বাচ্চা শাকের বান্ডিল থেকে বেরিয়ে দুধের জগে পড়েছিল।”

Screenshot source: Facebook
Screenshot source: Facebook

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যা, ফ্রিজে রাখা দুধ পান করে সাপের বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনাটি সত্য নয় বরং কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে উক্ত দাবিটি বিভিন্ন স্থানের নাম দিয়ে ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে।

ফ্রিজে রাখা দুধ পান করে সাপের বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনার বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে একাধিক প্রাসঙ্গিক কিওয়ার্ড এবং ম্যানুয়াল সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো খবর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, যে স্থানগুলোতে এই ঘটনা ঘটেছে বলে দাবি করা হয়েছে সেসব স্থানের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতেও অনুসন্ধান করে এ সংক্রান্ত কোনো খবর মেলেনি। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম দেখেছে, ফ্রিজে রাখা দুধ পান করে সাপের বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনাটি অন্তত ২০১৫ সাল থেকে ইন্টারনেটে বাংলাদেশের বাইরে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্থানের নাম ব্যবহার করে প্রচার হয়ে আসছে। 
যেমন, একই ঘটনা ভারতের দাবিতে ২০১৫ সালের একটি পোস্ট (আর্কাইভ) দেখুন –

Screenshot source: Facebook 

একই ঘটনা ভারতের বিভিন্ন স্থানের নাম ব্যবহার করে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

Screenshot from Facebook

একইভাবে একই ঘটনা পাকিস্তানের দাবিতেও প্রচার হয়ে আসছে। এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)। 

Screenshot from Facebook

তবে, রিউমর স্ক্যানার টিম ভারত এবং পাকিস্তানের ঘটনা দাবির বিষয়টি অনুসন্ধান করে সংশ্লিষ্ট পোস্টগুলোতে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র উল্লেখ পায়নি। তাছাড়া একাধিক প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করেও এই বিষয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের গণমাধ্যম কর্তৃক প্রকাশিত কোনো সংবাদও খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

ছবির বিষয়ে অনুসন্ধান 

সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে মানুষের হাতের আঙুলে থাকা ছোট সাপের ছবিটির মূল উৎস যাচাইয়ের ক্ষেত্রে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে Deviant Art নামের একটি ওয়েবসাইটে ছবিটির মূল উৎস খুঁজে পায় রিউমর স্ক্যানার টিম। উক্ত ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, Robert Kemmerer নামের একজন ফটোগ্রাফার ২০১৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী ছবিটি উক্ত সাইটে আপলোড করেন এবং এটি Blind Snake এর ছবি। 

Screenshot source: Deviant Art

পরবর্তীতে Blind Snake সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধানে, প্রাণীবিষয়ক ওয়েবসাইট A-Z Animal কর্তৃক প্রকাশিত ডাটাবেজ থেকে জানা যায়, সারা বিশ্বে এদের ২০০ টির মতো স্বতন্ত্র প্রজাতি রয়েছে এবং এই সাপ সম্পূর্ণ নির্বিষ। 

Screenshot Source: A-Z Animal

পোস্টগুলোতে থাকা অপর একটি ছবিতে যে সাপ সদৃশ বস্তু বা প্রাণি রয়েছে তা স্পষ্ট না হওয়ায় অনুসন্ধানে ছবিটির বিষয়ে কোনো তথ্যপ্রমাণ মেলেনি। 

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম দক্ষিণ আফ্রিকা ভিত্তিক সাপ বিষয়ক সংস্থা African Snakebite Institute এর সিইও জোহান মারাইসের (Johan Marais) সাথে যোগাযোগ করেছিল। ছবির রেজুলেশন কম হওয়ায় জোহান রিউমর স্ক্যানারকে জানান, এটি যে সাপ তা নিশ্চিত তবে ছবি পরিস্কার না হওয়ায় সাপের পরিচয় নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
 
তবে ফেসবুকে Snake Awareness নামে সাপ উদ্ধার এবং সাপ বিষয়ে সচেতনতামূলক একটি পেজের অধীনে থাকা একটি গ্রুপে উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে করা পোস্টে (আর্কাইভ) একই ছবির বিষয়ে পেজটির ফাউন্ডার রফিক ইসলাম প্রথম ছবির সাপটিকে Common wolf snake বা ঘরগিন্নি সাপ বলে দাবি করেছেন। তার দাবি, এটি কোনো বিষধর সাপ নয়, তাই আলোচিত তথ্যগুলোও সঠিক নয়।

Screenshot source: Facebook 

সাপটির পরিচয় কীভাবে নিশ্চিত হলেন সে বিষয়ে জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম রফিক ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, “সাপ দেখতে দেখতে যে অভিজ্ঞতা হলো তা থেকেই আসলে নিশ্চিত হলাম বিষয়টি। যেটা দেখলাম এটার ঘাড়ের দিক এবং বডিশেপে সাদা ছোপ ছোপ দাগ আছে। ঘরগিন্নিতে সাধারণত এমনই থাকে। এরা বাসা বাড়িতেই থাকে। এই কয়েকটা বিষয় যেমন বডি শেপ, সাইজ এই কয়েকটা প্যারামিটারে এটা ঘরগিন্নি বলে নিশ্চিত হয়েছি।”

African Snakebite Institute এর দেওয়া তথ্যমতে, কমন উলফ স্নেক সাধারণত ক্ষতিকর প্রকৃতির হয়না। 

ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, বাজার থেকে কিনে আনা শাকের সাথে এই সাপ বাড়িতে এসেছে এবং ফ্রিজে ঢুকেছে। পরবর্তীতে সেই সাপটি কোনোভাবে দুধের জগের মধ্যে পড়ে সেটিকে বিষাক্ত বানিয়েছে এবং সেই দুধ খেয়ে দুই শিশু মারা গেছে। 

এই বিষয়টি জানতে রিউমর স্ক্যানার টিম সাপের Venom এবং Poison এই দুই ধরণের বিষ নিয়ে অনুসন্ধান চালিয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডা এর ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, Poison হল এমন পদার্থ যা গিলে ফেললে কিংবা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করলে তা দেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, সাধারণত কেউ Venom গলাধঃকরণ করলে তাহলে সেটি জীবদেহে কোনো বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করেনা বরং এটি তখনই বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে যখন ইনজেকশন কিংবা কোনো বিষাক্ত প্রাণির (সাপ, মাকড়সা ইত্যাদি দ্বারা) কামড়ের দ্বারা ত্বকের নিচের অংশের টিস্যুতে প্রবেশ করবে। 

Screenshot source: University of Florida

অর্থাৎ কেউ যদি সাপের বিষ পান করে তাহলে সেটা আমাদের পরিপাকতন্ত্র হজম করে ফেলবে। 

তবে National History of Museum কর্তৃক প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে সাপের বিষ পান করাকে নিরূৎসাহিত করা হয়েছে। কেননা, যদিও সাপের বিষ পান করা সম্ভব তবে, পরিপাক নালীর কোথাও যদি কোনোরূপ ক্ষত থাকে তাহলে সেই ক্ষত দ্বারা দেহে বিষ শোষিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তাছাড়া সাপের বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনাটির বিষয়ে ভারতের ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা Check4spam এর সাথে কথা বলেছেন দেশটির বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিদ এবং সাপ বিশেষজ্ঞ Vava Suresh। তিনি জানিয়েছেন, “সাপের বিষের দ্বারা মানুষের তখন ক্ষতি হবে যখন তা কেবল রক্তের সাথে মিশবে।”

মূলত, দুধ পানের মাধ্যমে সাপের বিষক্রিয়ায় একই পরিবারের দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনাটির কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র ছাড়াই ২০১৫ সাল পরবর্তী সময় থেকে ভিন্ন ভিন্ন ছবি ও স্থানের নাম ব্যবহার করে ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। রিউমর স্ক্যানারের বিস্তর অনুসন্ধানে এ ঘটনার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও খুঁজে পাওয়া যায়নি। যে দুইটি ছবি ব্যবহার করে উক্ত ঘটনাটি সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানে যে দুইটি সাপ দেখা যাচ্ছে সেগুলোও নির্বিষ বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রসঙ্গত, ব্ল্যাক মাম্বা সাপের প্রতি কামড়ে ১০০-১২০ গ্রাম বিষ বের হয় এবং একসাথে ১০-১৫ জন মানুষের মৃত্যুও হয় শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান করে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, ফ্রিজে রাখা দুধ পান করে সাপের বিষক্রিয়ায় দুই শিশুর মৃত্যু শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

  • Deviant Art: Laughing ‘Blind Snake’
  • A-Z Animal: Blind snakes are non-venomous. 
  • University of Florida: What is the difference between poison and venom? If you drink venom, will it kill you?
  • National History of Museum: Although possible, drinking venom is certainly not advisable
  • Check4Spam: [Internet Rumour] Kids Die Due to Drinking Milk In Fridge Poisoned By Snake.
  • Rumor Scanner’s own analysis. 
  • Statement from Johan Marais, African Snakebite Institute
  • Statement from Rafiq Islam, Snake Awareness

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img