সম্প্রতি, “বাংলাদেশ থেকে সিএনজি নিয়ে কানাডায় গাড়ি চালান মিলন” শীর্ষক শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশ করেছে জাতীয় দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকা। পত্রিকাটি দাবি করেছে, “কয়েকজন আত্মীয়র ব্যাগে করে সিএনজি বানানোর মালামাল আনিয়ে নিজ হাতে গাড়িটি পুনঃস্থাপন করেছেন ইসমাইল হোসেন মিলন। এরপর সেখানে গাড়িটি সচল করে চালান তিনি।”
জনকণ্ঠের প্রতিবেদন দেখুন এখানে।
একই দাবিতে অন্য গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন জুম বাংলা।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
একই ঘটনা যুক্তরাজ্যের দাবি করে ফেসবুকের পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে সিএনজি নিয়ে কানাডায় এক বাংলাদেশি কর্তৃক গাড়ি চালানোর দাবিটি সঠিক নয় বরং যুক্তরাজ্যে চলা এই সিএনজিটির চালক একজন নারী। কোনোরকম তথ্যসূত্র ছাড়াই সিএনজিটি একজন বাংলাদেশির বলে বানোয়াট একটি দাবি প্রচার করা হচ্ছে।
জনকণ্ঠের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে অনুসন্ধান
এ সংক্রান্ত জনকণ্ঠ পত্রিকার প্রতিবেদনে আলোচিত ছবিটি ২৭ মে কানাডার টরেন্টো থেকে তোলা বলে দাবি করা হয়। একইসাথে এ সংক্রান্ত একটি ফেসবুক পোস্টের লিংকও যুক্ত করা হয় প্রতিবেদনের শেষে।
উক্ত লিংকে প্রবেশ করে ‘Troll Colleges Sylhet’ নামক একটি পেজের একটি পোস্ট (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়।
এই পোস্টেও দৃশ্যটি কানাডার বলে দাবি করা হয় এবং পোস্টটি ‘Channel Dhaka’ নামক একটি পেজ থেকে নেওয়া বলে জানানো হয়।
পরবর্তীতে কিওয়ার্ড সার্চ করে ‘Channel Dhaka’ নামক পেজটিতে আলোচিত ছবিটি (আর্কাইভ) খুঁজে পাওয়া যায়।
পোস্টে অবশ্য ভিন্ন দাবি দেখেছি আমরা। লেখা রয়েছে, “লন্ডনের রাস্তায় সিএনজি চালাচ্ছে সিলেটি প্রবাসী ইসমাইল হোসেন মিলন।”
অর্থাৎ, পোস্টে দৃশ্যটি লন্ডনের বলে দাবি করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় পোস্টের Edit History চেক করে দেখেছি আমরা। সেখানে দেখা যায়, গত বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাত ১০ টা ৩৫ মিনিটে যখন পোস্টটি প্রকাশ করা হয় তখন পোস্টের ক্যাপশনে লেখা ছিল, “বাংলাদেশ থেকে সিএনজি নিয়ে কানাডার রাস্তায় চালাচ্ছে সিলেটের স্পাউস ইসমাইল হোসেন মিলন। কয়েকজন আত্মীয়র ব্যাগে করে সিএনজি বানানোর মালামাল আনিয়ে নিজহাতে তিনি গাড়িটি পুনঃস্থাপন করেছেন। আজ বিকালে কানাডার টরোন্টো থেকে তোলা।”
পরবর্তীতে গতকাল (২৭ মে) বিকেল ৫ টা ৩১ মিনিটে পোস্ট এডিট করে বর্তমান ক্যাপশনটি দেওয়া হয়।
উক্ত পোস্টের একাধিক কমেন্ট পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, একাধিক ব্যক্তি স্থানটি যুক্তরাজ্যের লন্ডনের বলে লিখেছেন। কেউ নির্দিষ্ট করে স্থানটির নামও (লন্ডনের টাফালগার স্কয়ারে কানাডা দূতাবাসের সামনে) লিখেছেন। একজন তার কমেন্টে Obayed Hossain নামে এক ব্যক্তিকে মেনশন করে বলেছেন, ছবিটি তিনিই তুলেছেন যুক্তরাজ্য থেকে।
এই তথ্যের সূত্র ধরে ওবায়েদ হোসেনের ফেসবুক প্রোফাইল (আর্কাইভ) পর্যবেক্ষণ করে ছবিটি খুঁজে পাইনি আমরা।
একই সময়ে অনুসন্ধান করে Bangladeshi Community UK -BCUK নামক ফেসবুক গ্রুপে গত ২৫ মে বাংলাদেশ সময় রাত ৯ টা ৫৩ মিনিটে ওবায়েদ হোসেন কর্তৃক প্রকাশিত এক পোস্টে (আর্কাইভ) আলোচিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।
ছবিটির ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, লন্ডনের টাফালগার স্কয়ারে আজ প্রথমবার তিনি এই দৃশ্য দেখেছেন।
একই গ্রুপ পর্যবেক্ষণ করে গত ১২ এপ্রিল প্রকাশিত এক পোস্টেও (আর্কাইভ) লন্ডনে আরেকটি সিএনজির ছবি খুঁজে পাওয়া যায়।
এ থেকে প্রতীয়মান হয়, লন্ডনে সিএনজি চলতে দেখা বিরল কোনো দৃশ্য নয়।
তাছাড়া, ব্রিটিশ আইনেও যুক্তরাজ্যে সিএনজি চালিত যান চলাচলে বাধা নেই। এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেখুন এখানে।
আলোচিত ছবিটির বিষয়ে জানতে পরবর্তীতে ওবায়েদ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তিনি জানান, ২৫ মে তিনি লন্ডনের টাফালগার স্কয়ারের পল মল স্ট্রিট থেকে ছবিটি তুলেছেন। একই সময়ে তোলা একই সিএনজির আরেকটি ছবিও তিনি রিউমর স্কয়ারের কাছে পাঠান।
এটিসহ দুইটি ছবির মূল ফাইল জনাব ওবায়েদ রিউমর স্ক্যানারের কাছে পাঠালে আমরা ছবি দুইটির মেটাডাটা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়েছি যে, ওবায়েদের পাঠানো দুটো ছবিই তার নিজেরই তোলা। গত ২৫ মে লন্ডনের স্থানীয় সময় ১২ টা ৩৪ মিনিটে ছবিগুলো তোলা হয়৷
ওবায়েদের পাঠানো দ্বিতীয় ছবিটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ড্রাইভারের আসনে একজন নারী রয়েছে। ওবায়েদ নিজেও বিষয়টি আমাদের নিশ্চিত করেছেন। তাছাড়া, সিএনজিতে পতাকা সদৃশ যে বস্তুটি দেখা যাচ্ছে তার সাথে সৌদি আরবের পতাকার মিল রয়েছে।
অর্থাৎ, উক্ত সিএনজির চালক একজন বাংলাদেশি পুরুষ শীর্ষক যে দাবি করা হচ্ছে তা সঠিক নয়।
লন্ডনের রাস্তায় সিএনজি চলার একটি ভিডিও-ও (আর্কাইভ) নজরে এসেছে আমাদের। তবে উক্ত সিএনজি আর আলোচিত ছবিটির সিএনজি একই নয় (একাংশের বডি কালারে ভিন্নতা)। এই সিএনজিতে অবশ্য সৌদি আরবের পতাকা সদৃশ কোনো বস্তুও দেখা যায়নি।
আলোচিত সিএনজির ছবিটির সাথে কথিত মিলনের গল্পটির সত্যতা জানতে একাধিক উপায়ে অনুসন্ধান করে দেখার চেষ্টা করেছি আমরা। উক্ত গল্পের সূত্রপাত হিসেবে Channel Dhaka এর পেজের পোস্টটি ফেসবুক মনিটরিং টুল মারফত নিশ্চিত হওয়ার পর রিউমর স্ক্যানার টিমের পক্ষ থেকে পেজটির এডমিন প্যানেলের সাথে যোগাযোগ করা হয়।
Channel Dhaka কর্তৃপক্ষ রিউমর স্ক্যানার টিমকে জানিয়েছে, ছবিটি একটি গ্রুপ থেকে নিয়ে সার্কাজমের উদ্দেশ্যে ক্যাপশনে কথিত মিলনের নামে বানোয়াট গল্পটি উল্লেখ করেছেন তারা।
রিউমর স্ক্যানার টিমের সাথে কথা বলার পরপরই আলোচিত পোস্টটির ক্যাপশনটি তারা আরো একবার এডিট করে Channel Dhaka. কথিত মিলনের গল্পটি কেটে দিয়ে ক্যাপশনে এবার লেখা হয়েছে, “লন্ডনের রাস্তায় সিএনজি।”
অর্থাৎ, আলোচিত গল্পটিও বানোয়াট।
মূলত, সম্প্রতি কানাডায় ইসমাইল হোসেন মিলন নামে এক বাংলাদেশি সিএনজি চালাচ্ছেন শীর্ষক একটি দাবির সাথে সিএনজির একটি ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে রিউমর স্ক্যানারের বিস্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, দাবিটি সঠিক নয়৷ কানাডা নয় বরং যুক্তরাজ্যের লন্ডনে কানাডার দূতাবাসের সামনে থেকে তোলা ছবিতে যে সিএনজিটি দেখা যাচ্ছে সেটির চালক একজন নারী। তাছাড়া, কয়েকজন আত্মীয়র ব্যাগে করে সিএনজি বানানোর মালামাল আনিয়ে নিজ হাতে গাড়িটি পুনঃস্থাপন করেছেন ইসমাইল হোসেন মিলন শীর্ষক যে দাবি করা হয়েছে তাও বানোয়াট। একটি সার্কাজম পেজ থেকে উক্ত দাবিটি ছড়িয়ে পড়ার পর রিউমর স্ক্যানারের সাথে এ বিষয়ে আলাপের পর পেজটি উক্ত গল্প পোস্টের ক্যাপশন থেকে সরিয়ে নিয়েছে।
সুতরাং, ‘বাংলাদেশ থেকে সিএনজি নিয়ে কানাডায় গাড়ি চালান বাংলাদেশি মিলন’ শীর্ষক দাবিতে ফেসবুক ও গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Bangladeshi Community UK -BCUK: Group Post
- Statement from Obayed Hossain
- Statement from Channel Dhaka
- Rumor Scanner’s own analysis