সম্প্রতি ১২ বছর বয়সী গলার রোগে আক্রান্ত সুমাইয়া আক্তার নামের এক শিশুর চিকিৎসার জন্য সহায়তা চেয়ে বেশকিছু পোস্ট ফেসবুকে প্রচারিত হয়েছে। পোস্টগুলোতে তার চিকিৎসা সহায়তার জন্য ফিতরা বা জাকাতের টাকাও চাওয়া হয়েছে।
পোস্টগুলোতে বলা হচ্ছে– “ভিক্ষুকের মত নির্লজ্জ ভাবে পায়ে ধরে শুধু শেয়ার ভিক্ষা চাচ্ছি। সাহায্য করতে না পারলেও অন্তত একটি শেয়ার করুন। আপনার শেয়ারের মাধ্যমে হয়তো কোনো বিত্তবান, দানশীল ও দ্বীনদার ব্যক্তির নজরে আসবে ইনশাআল্লাহ। ফেতরা বা যাকাত হিসাবে কমপক্ষে একজনের ফিতরা যদি যদি পায় ছোট্ট বোনকে চিকিৎসা করা সম্ভব ইনশাল্লাহ।
নাম সুমাইয়া আক্তার, বয়স ১২, পিতা- মোঃ মহিদুল শেখ, গ্রাম-সুবিদপুর চিরাপাড়া, কাউখালী, পিরোজপুর। শারীরিক অসুস্থতার পরে টিভি হওয়ায় গলায় জটিল অপারেশন করতে হয়েছে। বর্তমানে বরিশাল শেরে -ই বাংলা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে অপারেশন ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় চার তলায় (নাক,কান,গলা) মহিলা ওয়ার্ড ৬নং বেডে ভর্তি আছেন।
সুমাইয়ার বাবা একজন দিনমজুর তাই অর্থের অভাবে চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সামাজের বিত্তবান ও মানবিক ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর বিশেষ অনুরোধ রইলো।”
এ পোস্টগুলোর শেষে টাকা পাঠানোর জন্য পিতা মহিদুল ইসলামের নাম উল্লেখ করে বিকাশসহ বিভিন্ন মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) নাম্বার উল্লেখ করা হয়েছে। তবে দেখা গেছে এসব পোস্টে ভিন্ন ভিন্ন বিকাশ নাম্বার যুুক্ত করা হয়েছে। হুবহু পোস্ট কপি করে কেবল নাম্বার পরিবর্তন করে পোস্টগুলো করা হয়েছে।
যেমন একটি পোস্টে বিকাশ ও নগদ পার্সোনাল নাম্বার হিসেবে দেয়া হয়েছে 01911129496 ও 01861343647 সংখ্যার দুটি নাম্বার। অপর এক পোস্টে যুক্ত করা হয়েছে 01617633720 সংখ্যার একটি নগদ পার্সোনাল নাম্বার। অন্য আরেক পোস্টে যুক্ত করা হয়েছে 01943733625 সংখ্যার বিকাশ ও নগদ পার্সোনাল নাম্বার। ০১৮৭৮৭৬০৫৪৯ সংখ্যার একটি রবি নাম্বার যুক্ত করা হয়েছে অপর আরেক পোস্টে। ০১৩২৫৭০৫৫০৮ শীর্ষক একটি পার্সোনাল বিকাশ, রকেট ও নগদ নাম্বার যুক্ত করা হয়েছে অন্য আরেকটি পোস্টে। সুমাইয়া আক্তার নামের ওই শিশুর চিকিৎসা সহায়তার জন্য বিভিন্ন পোস্টে আরও যুক্ত করা হয়েছে এমন কিছু নাম্বার হলো– 01830973418, 0185433893, 01602528493, 01778899196, 01863338422 এবং 01848386601 ইত্যাদি নাম্বার।
মোঃ ওমর ফারুক নাম দিয়ে কিছু পোস্টে 0112005552925 সংখ্যার এক্সিম ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যুক্ত করা হয়েছে।

শিশু সুমাইয়ার চিকিৎসা সহায়তার দাবিতে অর্থ তোলা হচ্ছে এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) , এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)
পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রথমদিকে বিভিন্ন ফেক আইডি থেকে বিভিন্ন গ্রুপে এসব পোস্ট করা হয়। পরবর্তীতে রিয়েল অ্যাকাউন্টধারীরও কপি-পেস্ট করে পোস্ট করেন কিংবা শেয়ার করে সেগুলো প্রচার করেন।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গলার টিবি রোগে আক্রান্ত শিশু সুমাইয়ার তথ্য ও ছবি ব্যবহার করে প্রতারক চক্র নিজেদের বিকাশ নাম্বার যুক্ত করে বিভিন্ন গ্রুপে সাহায্য চেয়ে পোস্ট করছে, এ পোস্টগুলোর সাথে সুমাইয়ার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই।
অনুসন্ধানে Md Mynul Islam নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সুমাইয়ার চিকিৎসা সহায়তা চেয়ে দেওয়া প্রথম পোস্টটি (আর্কাইভ) পাওয়া যায়। ওই পোস্টে থেকে জানা যায়– ১২ বছর বয়সী সুমাইয়া আক্তার গলার টিবি রোগে আক্রান্ত। তার বাসা ৪নং চিরাপাড়া পারসাতুরিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সুবিদপুর এলাকায়। তার সুমাইয়া তার বাবা মোঃ মহিদুল ইসলামের বড় মেয়ে।
ওই পোস্টে তিনি লেখেন– “৪নং চিরাপাড়া পারসাতুরিয়া ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড সুবিদপুর দিনমজুর অসহায় মোঃ মহিদুল ইসলামের বড় মেয়ে মোসা: সুমাইয়া আক্তার, বয়স ১২ বছর গলার ডান পাসে ছয়টি টিভি রোগে আক্রান্ত। মহিদুল সাধ্য অনুযায়ী বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার দেখানোর পরে তিনটি টিভি ফেটে যায় আর তিনটি টিভি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে। আর মেয়েটিও অসুস্থ হতে থাকে, তাই এমন অবস্থায় আজকে সকালে মেয়েটিকে নিয়ে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়। ডাক্তার বলছেন জরুরীভাবে অপারেশন করা দরকার আর তিনটি টিউমার ফেটে যাওয়ায় সেখানে ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। তাই অপারেশনের পরে টিভি গুলি ঢাকা মহাখালী ক্যান্সার হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
কিন্তু দিনমজুর মহিদুলের পক্ষে সুমাইয়ার চিকিৎসা চালানো অসম্ভব,তাই আমরা সবাই যদি মেয়েটার পাশে দাঁড়াই আল্লাহর রহমতে মেয়েটি বেঁচে যেতে পারে। যোগাযোগ-মোঃ মহিদুল ইসলাম 01778801201 মোঃ মাইনুল ইসলাম 01851279908 বিকাশ/নগদ।”

চিকিৎসা সহায়তার জন্য গত ১১ মার্চের আরেক পোস্টে (আর্কাইভ) তিনি লেখেন– “সহযোগিতার আবেদন; মোসাম্মদ সুমাইয়া আক্তার,বয়স ১২ বছর।
পিতা-মোঃ মহিদুল শেখ, গ্রাম-সুবিদপুর।
ইউনিয়ন- ৪নং চিরাপাড়া, কাউখালী, পিরোজপুর। শারীরিক অসুস্থতা অতঃপর টিভি হওয়ায় গলায় জটিল অপারেশন করতে হয়েছে।
বর্তমানে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল
হসপিটালে অপারেশন ও চিকিৎসাধীন অবস্থায়
চার তলায় (নাক,কান,গলা) মহিলা ওয়ার্ড
৬নং বেডে ভর্তি আছেন। সুমাইয়ার বাবা একজন দিনমজুর তাই অর্থের অভাবে চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বিত্তবান ও মানবিক ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ রইলো।
মোঃ মহিদুল -01778801201

মইনুল ইসলামের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ঘুরে দেখা যায় তিনি শিশু সুমাইয়ার এলাকারই বাসিন্দা এবং একজন সেচ্ছাসেবী, মানবসেবামূলক কাজ করে থাকেন। সেই সূত্রেই তিনি সুমাইয়ার জন্য চিকিৎসা সহায়তা চেয়ে পোস্ট দেন। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত ১৮ ফেব্রুয়ারির একটি পোস্টে সুমাইয়ার জন্য এ পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন বলে জানান।

সুমাইয়ার চিকিৎসার জন্য জনাব মইনুল ইসলাম যে এমএফএস নাম্বারটি দিয়েছেন সেটি হলো– 01851279908।
তবে পরবর্তীতে জনাব মইনুল ইসলামের গত ১১ মার্চের ফেসবুক পোস্ট থেকে ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে সাহায্য পাঠানোর নাম্বার বদলিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নাম্বার যুক্ত করে প্রচার করার ঘটনা ঘটেছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চেয়ে রিউমর স্ক্যানারের পক্ষ থেকে জনাব মইনুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সুমাইয়ার আরও কিছু ছবি এবং চিকিৎসার কাগজপত্র আমাদের পাঠিয়ে নিশ্চিত করেন– “এগুলোর একটি নাম্বারও ঠিক নেই। সবগুলোই ভুয়া। সুমাইয়ার জন্য চিকিৎসা সহায়তা পাঠানোর আসল নাম্বার হচ্ছে– 01851279908।”

তিনি আরও জানান– “সুমাইয়া বর্তমানে হাসপাতাল থেকে রিলিজ হয়ে নিজ বাড়ীতে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তার চিকিৎসার জন্য আপাতত আর কোনো সহযোগিতা নেয়া হচ্ছে না।”
মূলত, গলায় টিবি রোগে আক্রান্ত ১২ বছর বয়সী শিশু সুমাইয়ার জন্য তার বাবার পক্ষে চিকিৎসা ব্যয় বহন করা সম্ভবপর না হওয়ায় তাদের পক্ষে তাদের এলাকার মইনুল ইসলাম নামের এক সেচ্ছাসেবী ফেসবুকে সুমাইয়ার জন্য চিকিৎসা সহায়তা চেয়ে পোস্ট করেন। পরবর্তীতে মইনুল ইসলামের পোস্ট থেকে ছবি ও তথ্য নিয়ে বিকাশ নাম্বার বদলিয়ে প্রতারকচক্র নিজেদের বিকাশ, নগদ ইত্যাদি নাম্বার যুক্ত করে চিকিৎসার জন্য জাকাত-ফিতরার নামে আর্থিক সাহায্য তুলছেন, যার সাথে সুমাইয়ার পরিবারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
সুতরাং, সুমাইয়া আক্তার নামের এক শিশুর তথ্য ও ছবি ব্যবহার করে চিকিৎসার জনয় জাকাত-ফিতরার নামে আর্থিক সাহায্য উত্তোলনের বিষয়টি ভুয়া ও প্রতারণামূলক।
তথ্যসূত্র
- Original fundraising post for Sumaiya
- Statement of original fundraiser