গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। এরই মধ্যে “সোমালিয়ার জলদস্যুদের ভাড়া করে বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ ও ২৩ নাবিককে জিম্মি করেছে তারেক দাবি করছে ৫ মিলিয়ন মুক্তিপণ” শীর্ষক দাবিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি এবং সংবাদ প্রতিবেদনের একটি স্ক্রিনশট যুক্ত একটি ফটোকার্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়েছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সোমালিয়ান জলদস্যুদের দ্বারা ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাই হওয়ার ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কোনো প্রকার সম্পৃক্ততা নেই। প্রকৃতপক্ষে কোনো প্রকার নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়া সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনভাবে আলোচিত দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
অনুসন্ধানের শুরুতে প্রচারিত ফটোকার্ডটি পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। পর্যবেক্ষনে ফটোকার্ডটিতে একটি সংবাদ প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট যুক্ত থাকতে দেখা যায়।
ফটোকার্ডে যুক্ত প্রতিবেদনটির অনুসন্ধানে কি ওয়ার্ড সার্চের দেশীয় গণমাধ্যম ‘প্রতিদিনের বাংলাদেশ’ এর ওয়েবসাইটে গত ১৩ মার্চ “৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দাবি, চলছে দরকষাকষি” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদনের স্ক্রিনশটই আলোচিত ফটোকার্ডে যুক্ত করা হয়েছে।
উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ সহ জাহাজের ২৩ জন নাবিক। মুক্তিপণ হিসেবে জলদস্যুরা ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দাবি করছে।
প্রতিবেদনটিতে সোমালিয়ার জলদস্যুদের ছিনতাই এবং মুক্তিপণের বিষয়ে উল্লেখ থাকলেও সেখানে তারেক রহমানের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
পরবর্তীতে বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খোঁজ করে রিউমর স্ক্যানার টিম।
অনুসন্ধানে বিবিসি বাংলা’র ওয়েবসাইটে গত ১২ মার্চ “সোমালিয়ার জলদস্যুরা যেভাবে ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশের জাহাজের দখল নিল” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে কয়লা নিয়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। সেসময় জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়েছে বলে জানান জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের প্রধান নির্বাহী মেহেরুল করিম।
উক্ত প্রতিবেদনেও তারেক রহমান প্রসঙ্গে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এছাড়া ডয়েচে ভেলে বাংলা’র ওয়েবসাইটে গত ১৩ মার্চ “সোমালি জলদস্যুর কবলে বাংলাদেশের জাহাজ,২৩ নাবিক বন্দি” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত আরও একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুক্তরাজ্যের মেরিটাইম ট্রেড অপারেশন (ইউকে এমটিও) তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, এই ঘটনাটি ঘটেছে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ৬০০ নটিক্যাল মাইল পূর্বে। জলদস্যুরা একটি বড় ও একটি ছোট নৌযানে করে আসে। তারা ওই এলাকায় চলাচলকারী অন্য জাহাজগুলিতে সতর্ক করে দিয়েছে।
এই প্রতিবেদনেও জাহাজ অপহরণে তারেক রহমানের সম্পৃক্ততার কোনো দাবি করা হয়নি।
আরও অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরা’র ওয়েবসাইটে গত ১২ মার্চ “Pirates seize control of cargo ship near Somalia, say owners” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৫ থেকে ২০ জনের একটি সোমালি জলদস্যুদের দল বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে জিম্মি করে। জাহাজে ২৩ জন নাবিক ছিল। জাহাজটি মোজম্বিকের রাজধানী মাপুটো থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। ভারত মহাসাগরে এই ঘটনা ঘটে। জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং লিমিটেডের মালিকানাধীন।
এই প্রতিবেদনেও জাহাজ অপহরণে তারেক রহমানের কোনো সম্পৃক্ত থাকার কোনো প্রমাণ মেলেনি।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ছাড়াও দেশীয় কোনো মূলধারার গণমাধ্যম কিংবা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে এমভি আবদুল্লাহ অপহরণের সাথে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ মেলেনি।
অর্থাৎ, সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনায় সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে তারেক রহমানকে জড়িয়ে ফটোকার্ডটি প্রচার করা হয়েছে।
জলদস্যুরা কি এখন অবধি মুক্তিপন দাবি করেছে?
জাহাজসহ সব নাবিককে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে সোমালিয়ান জলদস্যুরা ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দাবি করেছে বলে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হলেও এটিকে গুজব বলে জানিয়েছেন অপহৃত জাহাজটির মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো দাবি-দাওয়া জানায়নি জলদস্যুরা। হয়তো জাহাজটিকে তাদের সেফ জোনে নেওয়ার পর তখন তারা তাদের দাবির বিষয়টি বলতে পারে।’
মূলত, গত ১২ মার্চ মোজম্বিকের রাজধানী মাপুটো থেকে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরব আমিরাতের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে ভারত মহাসাগরে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে অপহরণ করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এরপরই ১৩ মার্চ জাহাজে থাকা ২৩ জন নাবিকসহ জাহাজ ফিরিয়ে দিতে জলদস্যুরা ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দাবি করে জানিয়ে দেশীয় মূলধারার একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। যদিও মুক্তিপণের দাবির সংবাদকে গুজব বলে জানিয়েছে জাহাজটির মালিকপক্ষ। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ফটোকার্ডে জলদস্যুদের মুক্তিপণ দাবির একটি সংবাদ প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট সহ তাতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবি যুক্ত করে “সোমালিয়ার জলদস্যুদের ভাড়া করে বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ ও ২৩ নাবিককে জিম্মি করেছে তারেক দাবি করছে ৫ মিলিয়ন মুক্তিপণ” শীর্ষক শিরোনামে প্রচার করা হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিম যাচাই করে দেখেছে যে, উক্ত ফটোকার্ডে ব্যবহৃত সংবাদ প্রতিবেদনের স্ক্রিনশটটি মুক্তিপণের দাবি নিয়ে প্রতিদিনের বাংলাদেশে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদনের। উক্ত প্রতিবেদন কিংবা উক্ত ঘটনায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদনে ভারত মহাসাগরে ২৩ নাবিকসহ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর অপহরণ কিংবা মুক্তিপণ দাবির বিষয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, বাংলাদেশি পণ্যবাহী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ছিনতাইয়ের ঘটনায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জড়িত দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Protidiner Bangladesh : ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দাবি, চলছে দরকষাকষি
- BBC Bangla : সোমালিয়ার জলদস্যুরা যেভাবে ভারত মহাসাগরে বাংলাদেশের জাহাজের দখল নিল
- DW : সোমালি জলদস্যুর কবলে বাংলাদেশের জাহাজ,২৩ নাবিক বন্দি
- Al Jazeera : Pirates seize control of cargo ship near Somalia, say owners